এমন কথা কেউ কি কোনোকালে শুনেছেন বা বলেছেন- বাঘ তুমি বাঘ হও! সিংহ তুমি সিংহ হও! হে ঘোড়া তুমি ঘোড়া হও! কিংবা গরুকে গরু হতে, ছাগলকে ছাগল হতে, ভেড়াকে ভেড়া হওয়ার মন্ত্রণা দিয়েছেন কেউ! শেয়ালকে ডেকে কেউকি বলেছেন তুমি শেয়াল হও! এমনকি গাধাকে গাধা হওয়ার কথাও কেউ কোনো দিন বলেননি। অথচ একজন মানুষকে দিব্যি এবং দ্বিধাহীন উচ্চারণে বলা হয়- তুমি মানুষ হও! মানুষ হও! কেনো? কী এমন রহস্য মানুষের সাথে জড়ানো! যে কারণে মানুষকে মানুষ হতে বলা হয়! মানুষ হতে উপদেশ দিতে হয় বারবার! তবে কি অবয়বে মানুষ হলেও সেকি মানুষ নয়! এ সত্যই বড় সত্য- আকারে মানুষ হলেই সে মানুষ নয়! তবে কিসে মানুষ! কিভাবে মানুষ!
আমরা যাদের মানুষ বলে জানি, তারা সবাই মানুষ নয়? যদি নয়! তবে, কেনো নয়! কী কারণে মানুষ মানুষ হয়েও মানুষ নয়! কিংবা মানুষ মানুষ না থাকার কারণ কী! কখন মানুষ মানুষ থাকে না!
বাবা মা সন্তানকে বলছেন- মানুষ হও। শিক্ষক ছাত্রকে বলছেন- মানুষ হও। আদর্শ সমাজনেতাও ডেকে ডেকে মানুষকে মানুষ হতে বলছেন। তাহলে সমাজে মানুষরূপী চলমান দোপায়ারা কারা! যারা মানুষরূপী হয়েও মানুষ নয়? কোন শ্রেণীর প্রাণীর অন্তর্গত এরা! কেনো তবে তারাও মানুষের মতো বসবাস করে। সমাজ সংসার করে! চাওয়া পাওয়ার পিপাসায় অস্থির হয়ে ওঠে! সমাজ পরিচালনায় হয়ে যায় বড় নেতা!
তাহলে মানুষ হও কথাটি কী? কতটা গুরুত্বপূর্ণ এটি! শুধুই কি কথার কথা এটি! বলার জন্য বলা! নাকি এর ভেতর লুকিয়ে আছে কোনো রহস্য! নয় তো মানুষকে মানুষ হতে বলার কারণটি কী!
চলুন এর জন্য খানিকটা সৃষ্টির গোড়ায় দৃষ্টির আলো দেয়া যাক।
সমগ্র সৃষ্টি জগতের মধ্যে প্রাণীদের তিনটি শ্রেণী রয়েছে।
প্রথম শ্রেণী হলো- ফেরেশতাকুল।
দ্বিতীয় শ্রেণী- জীবজন্তু।
তৃতীয় শ্রেণী – মানবজাতি ও জিন জাতি।
এই তিনটি শ্রেণীর প্রথম শ্রেণী ফেরেশতাকুল। বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ফেরেশতাদের শুধু নৈতিক শক্তি আছে। কোনো প্রকার জৈবিক শক্তি তাদের নেই।
দ্বিতীয় শ্রেণী- জীবজন্তুর আছে কেবলই জৈবিক শক্তি। এদের কোনো নৈতিক শক্তি নেই।
আর তৃতীয় শ্রেণী- মানুষ এবং জিন জাতিকে নৈতিক এবং জৈবিক- এ দুটো শক্তিই সমানে সমান দেয়া হয়েছে।
প্রথম শ্রেণীটি অর্থাৎ ফেরেশতাকুলের সৃষ্টি অন্য সৃষ্টিকুলের আগেই সম্পন্ন করেছেন মহান আল্লাহ। ফেরেশতাদের তিনি সম্ভ্রান্ত করেছেন নৈতিক শক্তির ঐশ্বর্য ও নূরের তরঙ্গমালার অধীন করে। গতি ও জ্যোতির সমন্বিত আয়োজনে ফেরেশতারা মহা বিশ্বের সংরক্ষণ, তত্ত্বাবধান এবং প্রয়োজনে কাজ করেন। করেন মহান আল্লাহর হুকুমনামার চুলচেরা নির্দেশনায়। এ বিশাল সাম্রাজ্যের পরিচালনায় ফেরেশতারা মহান আল্লাহর সুযোগ্য সৈন্যবাহিনী। তিনি তাঁর সব আদেশ নির্দেশ সম্পন্ন করেন ফেরেশতাদের মাধ্যমে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- তাঁর এ সৈন্যসংখ্যা কত এটি সৃষ্টিজগতের কারো জ্ঞানের আওতায় নেই। এই সংখ্যা নিয়ে সৃষ্টি জগতের কেউ অনুমান করারও যোগ্যতা রাখেন না।
মহান আল্লাহ ফেরেশতাদের এমনই নম্র এবং দৃঢ স্বভাবের বানিয়েছেন, তারা আল্লাহর হুকুমের সামনে মোমের মতো গলে যান। আর আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়নে বিস্ময়কর দৃঢ়! মন্দ কাজের শক্তি বা সামর্থ্য কোনোটিই দেয়া হয়নি তাদের। এক কথায় ফেরেশতাদের কোনো জৈবিক শক্তি নেই। ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় কেবলই নৈতিক চরিত্রের সৌন্দর্য প্রদর্শন করাই তাদের কাজ। মহান আল্লাহ যে ফেরেশতাকে যে কাজের উপযুক্ত করেছেন সে কাজই তার জন্য নির্দিষ্ট। সে কাজেই তার অনুপুঙ্খ জ্ঞান। এর বাইরের কোনো বিষয়ে তাকে জ্ঞান দেয়া হয়নি। যার জন্য যে কাজের হুকুমনামা সে শুধু সে কাজটিই যথার্থ নিয়মে সম্পাদনা করেন। ডান বাম করার কোনো অবকাশ নেই তার। কম বেশি করার সুযোগও একদমই নেই। আগে পরে করারও সুযোগ রোহিত।
এবার দৃষ্টি ফেরানো যাক জীবজগতের দিকে। জীবজন্তুর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো তারা শুধুই ভোগের ভেতর জীবন কাটিয়ে দেয়। জৈবিক চাহিদার তৃষ্ণায় জেগে থাকে তাদের জীবন। বনে জঙ্গলে বা অভয়ারণ্যে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগটি বেশ। তারা খায়। ঘুমায়। ঘুরে বেড়ায়। বড়রা ছোটদের আক্রমণ করে। দুর্বল সবসময় সবলের কবলে ধরাশায়ী। তাদের নির্দিষ্ট ঘরবাড়ি নেই। চাষাবাদ নেই। কোনো আইন কানুনও নেই। নিয়ম বা নীতিরও কিছু নেই। মানুষের সমাজ থেকে পালিয়ে বেড়ায় তারা। তাদের বিবেক নেই। তেমন করে বুদ্ধিও নেই। শুধু জীবন ধারণের প্রয়োজনে যেটুকু জ্ঞান দরকার সেটুকুই দেয়া হয়েছে তাদের। ফলে তাদের হালাল হারামের বেড়া নেই। সত্য মিথ্যার দাগ নেই। ন্যায় অন্যায়ের পর্দাও নেই।
এখন আসা যাক মানুষের দিকে। মানুষ মহান আল্লাহর খলিফা। মানুষ বিবেকবান। বুদ্ধিমান। ইনসাফ ও ন্যায়বিচার করার ক্ষমতাসম্পন্ন। সত্য মিথ্যার ব্যবধান সম্পর্কে জ্ঞাত। হালাল হারামের সীমানা সম্বন্ধে জানা। সুন্দর অসুন্দরে পার্থক্যে পরিচিত। গ্রহণ বর্জনের স্বাধীনতার পথ অবারিত। সৎ অসতের চিহ্ন চেনা। ভালো মন্দের গন্ধ সম্পর্কে বোঝে। আল্লাহর হুকুম পালনের গুরুত্ব সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। নিষেধনামার সতর্কতা সম্পর্কেও অবগত।
মজার বিষয় হলো- মানুষের এ গুণগুলো ফেরেশতাদের সাথে তুল্য। এসবই মানুষের নৈতিক সম্পদ। একইভাবে জীবজন্তুর বৈশিষ্ট্যগুলোও পুরোপুরি মানুষের মধ্যে বিরাজমান। যেমন পশু খায়, মানুষও খায়। পশু ঘুমায়, মানুষও ঘুমায়। পশু বর্জ্য ত্যাগ করে, মানুষও করে। পশুর প্রজন্ম হয়, মানুষেরও হয়। এ থেকে মানুষ কোনো জঘন্য কাজ করলে এমন কাজকে আমরা বলি- পাশবিক। নৃশংস কোনো ঘটনার নিন্দায় আমরা বলি- লোকটি জানোয়ার। অন্যভাবে বলি- লোকটি জন্তুর মতো। কিংবা শেয়াল কুকুরের মতো! অথবা হায়েনার মতো! সাদা কথায় পশু বা জানোয়ার যা করে মানুষ তা-ই করল!
এখানেই বোঝার বিষয়টি লুকিয়ে আছে গভীরভাবে। এখানেই বুঝতে হবে- মানুষ কখন মানুষ থাকে! কখন মানুষের মর্যাদা থেকে খারিজ হয়ে যায়!
মানুষের ভেতর নৈতিকতা এবং পাশবিকতা সমানতালে বিদ্যমান! যখন একজন মানুষ পাশবিকতার ঊর্ধ্বে উঠে নৈতিকতা অর্জন করে; তখন সে আল্লাহর খলিফা! আর যখন নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে জৈবিক চাহিদার দাস হয়ে ওঠে তখন সে পশু থেকে অধম!
জগতে মানুষের সব কাজের বাটখারা হলো ন্যায় এবং অন্যায়ের ধারণা। কাজ কিংবা কথা যা-ই হোক। প্রকাশ্য অথবা গোপন। সব কাজই হয় ন্যায় অথবা অন্যায়ের সঙ্গী। আহার বিহারও এরই ভেতর! এমনকি বিশ্বাস অবিশ্বাসও। প্রতিটি পদক্ষেপে নৈতিক অথবা পাশবিক বিষয় খাড়া। প্রতিটি চিন্তাও হয় ন্যায়, নয়তো অন্যায়ের সহযোগী।
জৈবিক বিষয়ের প্রতিটি বাঁকে নৈতিক দৃষ্টি জরুরি। জৈবিক চাহিদা পূরণের মাধ্যমও নৈতিক পথ। যখন কেউ অনৈতিক কাণ্ডে ডুবে যায়। নীতির সঙ্গ ছেড়ে দেয়। ভালো মন্দ ভাবার মন নিভে যায়। তখন সে আর মানুষ থাকে না। তখন সে পশুত্ব ছাড়িয়ে আরো নিচে পতিত হয়। এমন মানুষের বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেছেন- তারা পশুর মতো, কিন্তু না পশুর চেয়েও অধম।
কারণ পশুকে পশু করেই সৃষ্টি করা হয়েছে। পাশবিকতাই তার বৈশিষ্ট্য। পশুর আচরণই তার যথার্থ। তাই পশু পাশবিক হবে, এ তো সাদামাটা কথা। কিন্তু মানুষ তো পশু নয়। মানুষ তো জীবজন্তু নয়! মানুষ তো নয় জানোয়ার! সে তো মানুষ! তার পাশবিকতা লালনের জন্য নয়। দমনের জন্য। প্রদর্শনের জন্য নয়! ভীষণভাবে লুকিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু যখন মানুষ পাশবিকতা লালন করে, পশুর মতো আচরণ করে তখন সে আর মানুষ থাকে না। এমনকি পশুও থাকে না। পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট জীব হিসেবে চিহ্নিত হয়! পশুর বৈশিষ্ট্যেও মানায় না তাকে। এদের দেখে ফেরেশতারা লজ্জিত হন! এমনকি পশুরাও লজ্জিত! এদের প্রতি মানুষের অভিসম্পাত! ঘৃণার চাবুক এদের প্রহার করে নিত্য! হয় তো সমাজে সম্মানিত এরা! হয়তো ক্ষমতার দণ্ডে হাত মজবুত এদের। হয় তো এরাই সমাজ-গাড়ির চালক! কিন্তু এরা যে মানুষ নয়! অবিচার, অনাচার, অন্যায়, আর জুলুমের পঙ্কিলতায় এরা অতিশয় নিকৃষ্টতর! একথা বোঝার ক্ষমতাও তাদের থাকে না। ফলে এরা টাকার কুমির বনে যায়! কিন্তু মনের দিক থেকে হতদরিদ্র! এরা বিরাট সম্পদওয়ালা। কিন্তু ভেতর থেকে বড় গরিব! সব থেকে বড় কথা- মানবিক বিচারে এরা সর্বস্বহারা! পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে জন্মেও এরা মানুষ থাকে না!
লেখক : কবি, কথাশিল্পী, শিশুসাহিত্যিক ও গীতিকার