জয়া মতিন, বিবিসি নিউজ, দিল্লি :
ভারতের একটি আদালতের এক যুগান্তকারী রায় অনুযায়ী, হিজাব পরা হয়তো মুসলিমদের সংস্কৃতির অংশ হতে পারে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা যায় এর সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। এই রায়টি দিয়েছে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কর্নাটকের তিন বিচারকের একটি বেঞ্চ। এই রাজ্যের সরকার স্কুলে মেয়েদের হিজাব পরা নিষিদ্ধ করেছিল, আদালত সেই নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখে এই যুক্তিতে যে ইসলামে হিজাব পরার কোন ‘বাধ্য-বাধকতা’ নেই।
হিজাব নিয়ে তীব্র বিতর্কে এর পক্ষে-বিপক্ষে ভারত যখন মারাত্মকভাবে বিভক্ত, তখনই আদালতের এই রায় এলো। তবে কর্নাটকের আদালতের এই রায় এখন চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে- হাইকোর্টের রায়ের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল রুজু করা হয়।
কিন্তু আদালতের এই রায় নিয়ে আইনজ্ঞ এবং বিশেষজ্ঞরা এখন তাদের মতামত তুলে ধরছেন, তারা এই রায়ের তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা করছেন, কারণ বহু জাতি-ধর্মের বৈচিত্রপূর্ণ দেশ ভারতে ধর্ম বিশ্বাসের প্রতীক জনসমক্ষে প্রদর্শন করা একেবারেই সাধারণ বিষয়।
আদালতের এই রায়টির মূল ভিত্তি তথাকথিত ‘এসেনশিয়ালিটি টেস্ট’- অর্থাৎ কোন ধর্মের অপরিহার্য বিষয়গুলো আসলে কী। ভারতের আদালতগুলো এখন ধর্মীয় বিষয়ের বিতর্ক নিরসনে বেশি করে এই ‘এসেনশিয়ালিটি টেস্ট’ বা ‘অপরিহার্যতার পরীক্ষা’ ব্যবহার করছে।
ইসলামে কি হিজাব পরা অপরিহার্য?
কর্নাটকের হাইকোর্ট ১২৯ পৃষ্ঠার যে রায় দিয়েছে, তার ভিত্তি ছিল মূলত এই প্রশ্নটিই। মামলার শুনানি মূলত আবর্তিত হয়েছে এই প্রশ্নকে ঘিরেই।
এই মামলার বাদী ছিলেন কর্নাটকের উদুপি জেলার একটি সরকারি কলেজের একদল মুসলিম ছাত্রী, যাদেরকে ক্লাসে হিজাব পরে যেতে নিষেধ করা হয়েছিল। ছাত্রীরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, কিন্তু কলেজ তাদের প্রতিবাদকে পাত্তা দেয়নি। ফলে বিষয়টি আদালতে গড়ায়।
এই ছাত্রীরা যুক্তি দিয়েছিল যে, হিজাব নিষিদ্ধ করা কেবল বৈষম্যমূলকই নয়, এটি তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং ধর্ম পালনের স্বাধীনতারও লঙ্ঘন। তারা বলেছিলেন, তাদের ধর্ম বিশ্বাসে মাথা ঢেকে রাখার কথা আছে। সরকার এটিকে চ্যালেঞ্জ করে, তারা বলেছিল, আবেদনকারীদেরকেই প্রমাণ করতে হবে যে তাদের ধর্মে আসলেই হিজাব পরা ‘অত্যাবশকীয়।’আদালতে এই মামলা নিয়ে ১১ দিন ধরে উত্তপ্ত বিতণ্ডা হয়েছে, শুনানি মূলতবি হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত আদালত এই উপসংহারে পৌঁছেছে যে, আবেদনকারীরা এটা প্রমাণে একেবারেই ব্যর্থ হয়েছেন যে, হিজাব পরা ধর্মে ‘অত্যাবশকীয়’ করা হয়েছে। কোরআনের অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করে আদালত রায় দেয় যে, “ব্যাপারটা এমন নয় যে হিজাব পরার রীতি না মানলে, যারা এটা মানছে না, তারা পাপী হয়ে যাবে, আর ইসলামও তার গৌরব হারিয়ে ফেলবে বা ইসলাম চলে যাবে।”
আদালত তাদের রায়ে আরও বলেছে, “কাজেই রাজ্য সরকারের অধিকার আছে হিজাব ছাড়া স্কুল ইউনিফর্ম পরতে বলার।” ছাত্রীদের আপত্তি নাকচ করে দিয়ে আদালত বলেছে, ছাত্রীদের সাংবিধানিক অধিকারের ক্ষেত্রে এখানে যেটুকু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে বলে বলা হচ্ছে, তা ‘যুক্তিসঙ্গত।’
আদালতের রায়ে আরও বলা হয়, “কাজেই, ধর্মে যেটাকে বাধ্যতামূলক করা হয়নি, সেটিকে গণপ্রতিবাদের মাধ্যমে বা আদালতে আবেগময় ভাষায় যুক্তিতর্ক দিয়ে ধর্মের অত্যাবশকীয় অংশে পরিণত করা যাবে না।” তবে ভারতের সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞ এবং আইনজ্ঞরা বলছেন, এই প্রশ্নের মীমাংসা করার এখতিয়ার আদালতের নেই। সুপ্রিম কোর্টের একজন সিনিয়র আইনজীবী রেবেকা জন বলছেন, “এখন আপনি ধর্মতত্ত্বের এমন সব জায়গায় ঢুকে পড়ছেন, যেটা সম্পর্কে বিচারক বা আইনজীবীরা খুব কমই জানেন।”
‘অপরিহার্যতার পরীক্ষা’
রেবেকা জন বলছেন, “ধর্ম পালনের ব্যাপার যখন আসে, তখন কিন্তু ধর্মীয় রীতি পালনের কোন একক পথ নেই- একটি নির্দিষ্ট ধর্মের ছায়াতলে হয়তো বহু মানুষ এসেছেন, কিন্তু প্রত্যেকেই যার যার মতো করে এই ধর্ম পালন করছেন।”
“এমনকি হিজাবও বহু ধরণের মানুষের কাছে বহু কিছুর প্রতীক। এটাকে নিন্দা করার একটা সহজ পথ হচ্ছে এটিকে একধরণের ‘নিপীড়ন’ বলে চালিয়ে দেয়া, কিন্তু গোটা বিশ্ব জুড়ে হিজাব এখন প্রতিরোধের প্রতীক। কাজেই কারও অবয়ব ঢাকার জন্য কোনটি অপরিহার্য সেটা আমরা ঠিক করে দিতে পারি না, নানা কারণে মানুষ এই হিজাব পরে।”
রেবেকা জন বলছেন, আদালত এই কাজটি করার মাধ্যমে আসলে মেয়েদেরকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। অনেক জটিল এবং অন্তরঙ্গ কিছু বিষয়কে মোটা দাগে সাদা-কালো বলে দেখাতে চাইছে।
ভারতীয় সংবিধানে জনশৃঙ্খলা, স্বাস্থ্য বা নৈতিকতার কথা বিবেচনা করে রাজ্যগুলোকে ধর্মীয় স্বাধীনতা খর্ব করার অধিকার দেয়া হয়েছে। তবে ‘এসেনশিয়াল রিলিজিয়াস প্র্যাকটিস টেস্ট’ বা ‘অত্যাবশকীয় ধর্মীয় রীতি পালনের পরীক্ষা’ কিন্তু আদালতের সৃষ্টি। এই পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়, কোন কোন ধর্মীয় রীতি পালনের বিষয়টি ধর্ম পালনের স্বাধীনতার অধিকার দ্বারা সুরক্ষিত।
সুপ্রিম কোর্ট ‘এসেনশিয়াল পার্ট অব এ রিলিজিয়ন, বা ‘কোন ধর্মের অপরিহার্য অংশ’ কথাটি প্রথম ব্যবহার করে ১৯৫৪ সালে। আদালত তখন তাদের এক পর্যবেক্ষণে বলেছিল, একটি ধর্মীয় রীতিকে তখনই অপরিহার্য বলা যাবে, যদি এটি বাদ দেয়া হলে ‘ধর্ম মৌলিকভাবে বদলে যায়।’
আইন বিশেষজ্ঞ এবং প্রফেসর দীপা দাস এসেভেডো বলছেন, ‘এটি ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর ক্ষমতায়নে ভূমিকা রেখেছিল, কারণ এর মর্মার্থ হচ্ছে, যে বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ বা পরিবর্তনের ক্ষমতা রাজ্য সরকারের নেই, সেগুলো বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় নিজেরাই ঠিক করবে।”
কিন্তু তিনি বলছেন, পরবর্তীকালে ভারতীয় আদালতগুলো এই ডকট্রিন বা তত্ত্বকে ব্যবহার করেছে একেবারে উল্টো কাজে, অর্থাৎ তারা নিজেরাই এসব বিষয়ে নাক গলিয়ে সেগুলো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। “কাজেই এই ডকট্রিনে যেখানে ‘ধর্মীয় জরুরী’ বিষয়ের কথা বলা ছিল, সেটি এখন পরিবর্তিত হয়ে ‘ধর্মের জন্য কোনটা জরুরী’ সেই প্রশ্নের দিকে চলে গেছে।”
যুক্তরাষ্ট্র বা এরকম অন্য দেশের আদালতের চেয়ে এটা একেবারেই ব্যতিক্রম। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে যদি বাদী বলেন যে, কোন একটি রীতি তার ধর্মের অংশ, আদালত কোন প্রশ্ন ছাড়াই সেটা মেনে নেয়। কিন্তু ভারতে এই সিদ্ধান্ত এখন আদালত নিজেই নিয়ে নিচ্ছে, কোন কোন ক্ষেত্রে একেবারে নির্বিচারে।
পছন্দ বেছে নেয়ার প্রশ্ন
দু’হাজার সতের সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তাৎক্ষণিক তালাক (তিন তালাক) নিষিদ্ধ করে। আদালত বলেছিল, তিন তালাক প্রথা ইসলামের অত্যাবশকীয় কোন অংশ নয়। ১৯৯৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট হিন্দু এবং মুসলিমদের মধ্যে জমি নিয়ে এক বিরোধের নিস্পত্তি করতে গিয়ে বলেছিল, ইসলাম ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে মসজিদ ‘অপরিহার্য’ নয়, কারণ নামাজ যে কোন জায়গায় পড়া যায়। কাজেই আদালত রায় দেয় যে, ঐ মসজিদের চারপাশের জমি হিন্দুদের দেয়া যায়।
দু’হাজার আঠারো সালে আদালত সবরিমালা মন্দির নিয়ে এক মামলার ক্ষেত্রেও এই ‘এসেনশিয়াল টেস্ট’ ব্যবহার করে। ঐ মন্দিরে একটি নির্দিষ্ট বয়সের নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু আদালত রায় দেয়, যে কোন বয়সের নারী ঐ মন্দিরে প্রবেশ করতে পারবে। আদালত তাদের রায়ে বলেছিল, নারীদের মন্দিরে প্রবেশের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা, সেটি ‘অপরিহার্য ধর্মীয় রীতি’র মধ্যে পড়ে না।
দু’হাজার ষোল সালে কেরালার হাইকোর্ট কোরআনের পাঠের ব্যাখ্যার ভিত্তিতে রায় দিয়েছিল যে, এতে লেখা আছে মাথা আবৃত করে রাখা ধর্মীয় কর্তব্য, সুতরাং এটি ইসলামে অপরিহার্য বলে বিবেচিত হবে। আদালত যে মামলার রায় দিতে গিয়ে একথা বলেছিল, সেই মামলার বাদী ছিলেন একদল মেডিক্যাল ছাত্রী। তাদেরকে পরীক্ষার হলে হিজাব পরতে নিষেধ করা হয়েছিল এই যুক্তিতে যে, এতে তারা পরীক্ষায় নকল করা বা জালিয়াতির সুযোগ পাবে।
কর্নাটকের আদালতে যারা হিজাব পরার অধিকার চেয়ে মামলা করেন, তারা এই রায়টির কথা উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু এবার আদালত তাদের যুক্তি খারিজ করে দেয়।
আইনজ্ঞ ফাইজান মুস্তাফা ২০১৭ সালে তার ‘ফ্রিডম অব রিলিজিয়ন ইন ইন্ডিয়া’ শিরোণামের এক গবেষণা নিবন্ধে লিখেছেন, “আদালত যেভাবে এই পরীক্ষা ব্যবহার করছে, তাতে কোন ধারাবাহিকতা নেই, তারা এই ‘অত্যাবশকীয়তার’ ব্যাপারটি নির্ধারণের পদ্ধতি বার বার পরিবর্তন করছে, এর ফলে ধর্মীয় স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন হচ্ছে।”তিনি যুক্তি দিচ্ছেন যে, ভারতের সংবিধানে ধর্মীয় স্বাধীনতার যে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে, এই ‘এসেনশিয়াল টেস্ট’ এখন সেই স্বাধীনতা খর্ব করছে।তবে, অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা আবার ঠিক নিশ্চিত নন, এক্ষেত্রে আদালতের ঠিক কোন ডকট্রিন অনুসরণ করা উচিৎ।
“এ প্রশ্নের সহজ উত্তর যদি আমার কাছে থাকতো,” বলছেন প্রফেসর দীপা দাস এসেভেডো। “সত্যি কথা বলতে কি, একেবারে সঠিক ডকট্রিন বলে কিছু নেই। আমরা আশা করবো যেসব আইন আমরা তৈরি করছি এবং যারা এসব আইনের ব্যাখ্যা দেন, এসব আইন প্রয়োগ করেন, তারা সেটা যতটা ন্যায্য এবং উদারভাবে করা যায়, সেভাবে করবেন। কিন্তু সেটা তো সবসময় ঘটে না। আর একেবারে সঠিক ডকট্রিন প্রয়োগ করলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, সেটাও তো নয়।”
রেবেকা জন বলছেন, এখানে পছন্দ বেছে নেয়ার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। “কোন নারী হিজাব পরে ঠিক কাজটি করছেন কীনা, সেটা বলার আমরা কে? এখানে ধর্মে এটি অপরিহার্য কীনা সে প্রশ্নের চেয়ে আদালতের উচিৎ ছিল নারীদের যুক্তিকে গুরুত্ব দেয়া।”
তিনি আরও বলেন, “আপনাকে যদি ইউনফর্ম পরার বিষয়টি মানতে বাধ্য করতে হয়, তাহলে তো এটা সবার ক্ষেত্রেই করতে হবে। আপনি তো তাহলে কাউকে কপালে টিপ পরতে বা হাতে পবিত্র সুতাও পরতে দিতে পারেন না। যখন আপনি এই নিয়ম কেবল একটি শ্রেণীর মানুষের বেলায় প্রয়োগ করবেন, তখন তো সেটা বৈষম্যমূলক।”