উচ্চ শিক্ষার মান উন্নয়নে গবেষণা ও প্রকাশনার সঙ্গে অনুবাদের ওপর সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলো অনুবাদ করা দরকার।
শনিবার (১২ মার্চ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত ‘শতবর্ষের মিলনমেলা’ অনুষ্ঠানে ‘বাংলাদেশের পথযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ শীর্ষক আলোচনাসভায় তিনি এ কথা বলেন।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোর উন্নয়ন নয়, পরিমাণগত বিকাশের সঙ্গে গুণগত উৎকর্ষ যাতে হয়- সেই দিকে অ্যালামনাইরা লক্ষ্য রাখুন।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত মানোন্নয়নে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন কী করতে পারে, সে বিষয়ে নিজের মত তুলে ধরে এই শিক্ষাবিদ জানান, গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা, প্রকাশনা ও অনুবাদ- এই তিনটি নিয়ে কাজ করতে হবে।
“কেবল গবেষণা নয়, গবেষণাকে হতে হবে সৃষ্টিশীল ও উপকারী। গবেষণার সঙ্গে প্রকাশনাও দরকার। খুব বেশি করে দরকার হবে অনুবাদ। যেটা আমরা করতে পারিনি।”
উচ্চশিক্ষাসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনে অনুবাদের গুরুত্ব তুলে ধরে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বলেন, “আমরা মাতৃভাষার মাধ্যমে অভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর চেষ্টা করেছিলাম, সেটা পারিনি।
“তার কারণ আমরা তেমন বই লিখতে পারিনি, অনুবাদও করতে পারিনি। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলো অনুবাদ করা দরকার এবং সেই অনুবাদ একা কেউ করতে পারবে না।
“অনুবাদ হচ্ছে একটি সমবায়ী কাজ। অনেকের সঙ্গে করতে হয়, পরামর্শ নিতে হয়। অনুবাদের কাজে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন অংশ নিতে পারে।”
শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নে আবাসিক হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টিকর খাবারের দিকে নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যের দিকে তাকাতে হবে। পুষ্টিকর খাবার না থাকলে তো শিক্ষা হবে না।
এসময় ডা. মোহাম্মদ মুর্তজার নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের নামকরণের প্রসঙ্গ তুলে ধরে শহীদ বুদ্ধিজীবী এই চিকিৎসকের পরামর্শের কথা স্মরণ করেন এই শিক্ষাবিদ।
“ডা. মুর্তজা আমাদের বন্ধু ছিলেন। তিনি চিকিৎসা করতেন, শিক্ষার্থীদের বলতেন আমি যে প্রেসক্রিশনটা দিলাম এটাতে তোমার অসুখ সারবে, কিন্তু আসল অসুখ সারবে না।
“আসল অসুখ হচ্ছে পুষ্টির অভাব। এই পুষ্টি তো আমার ব্যবস্থাপত্রে থাকবে না। এই কথাটা খুবই সত্য, পুষ্টির ব্যবস্থা যদি না করি, স্বাস্থ্য যদি না থাকে, তাহলে শিক্ষা কীভাবে এগুবে?”
শিক্ষা জীবনে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে প্রাণবন্ত থাকার কথা স্মরণ করে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সংস্কৃতি এবং শিক্ষা পরস্পরের পরিপূরক ছিল। আবসিক হলগুলো সাংস্কৃতিক কর্মে মুখর ছিল।
“আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত ঐতিহ্যের কথা যখন আমরা বলি, তখন আমাদের স্মরণ আসে যে, আমাদের সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয় শুধু শিক্ষার দিকেই এগিয়ে ছিল তা নয়, সংস্কৃতির দিকেও এগিয়ে ছিল।…
“ছাত্রজীবনে ছাত্র সংসদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা ছিল সবচেয়ে আনন্দের। আমি কেবল ক্লাসরুম বা পাঠাগারে শিখিনি, শিখেছি এই ছাত্র সংসদের বা হল ইউনিয়নের কার্যক্রমে, ডিবেট, নাটক, ম্যাগাজিনে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ- ডাকসু নির্বাচন সচল না থাকায় দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “আমি নয় বছর ডাকসুর কোষাধ্যক্ষ ছিলাম, সেই নয় বছর দেশে সামরিক শাসন ছিল, তবুও ছাত্র সংসদ ছিল।
“তারপরই যখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এলো, তখন আশ্চর্যের বিষয় হল, তখন থেকে ছাত্র সংসদের নির্বাচন কার্যক্রম থেমে গেল। ছাত্র সংসদের নির্বাচন ছিল বার্ষিক উৎসব। সেখান থেকে মেধাবীরা বেরিয়ে আসত।
“মেধাহীন ছাত্ররা নির্বাচিত হত না। ভবিষ্যতের নেতৃত্ব সেখান থেকে গঠিত হত। সেটা যে নেই দুঃখের ব্যাপার।”
আলোচনাসভায় শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি আগামী ১০০ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোথায় যাবে, সে বিষয়ে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ভাবতে আহ্বান জানান।
শতবর্ষ উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় যে অবকাঠামোগত উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সে বিষয় উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “ফিজিক্যাল মাস্টার প্ল্যানের পাশাপাশি একাডেমিক মস্টার প্ল্যানও তৈরি করতে হবে।
👉ডায়নামিক ওয়েবসাইট দিয়েই গড়ে তুলুন আপনার প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসার ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি। সেবা দেয়ার জন্য সবসময় আপনার পাশে আছে ‘ভার্সডসফট’।
“আবাসন সঙ্কট নিরসনে মূল সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে। ধারণক্ষমতার দিকে খেয়াল না রেখে আসন বাড়ালে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না।”
আলোচনা অনুষ্ঠানের এই পর্বে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী ও ডাকসুর সাবেক জিএস বেগম মতিয়া চৌধুরী, লেখক ও রাজনীতিক ইনাম আহমদ চৌধুরী, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক হামিদা আখতার বেগম, অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের কার্যনির্বাহী সদস্য শামসুজ্জামান দুদু এবং ঢাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মো. রহমত উল্লাহ বক্তব্য দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের আয়োজনে ‘শতবর্ষের মিলনমেলা’ অনুষ্ঠানের উদ্বোধনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ।
‘সমন্বয়হীনতা এবং সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ঘাটতি’ রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আবাসিক সংকটে জর্জরিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মানোন্নয়নে কিছু বিভাগ একত্রীকরণ করে সময়োপযোগী নতুন বিভাগ খোলা, শিক্ষার্থীর সংখ্যা পুনর্বিবেচনা এখন ভাবা যেতে পারে।
“উন্নত দেশ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের সীমিত সুযোগ, বুদ্ধিবৃত্তি চর্চায় অতীতের তুলনায় পিছিয়ে পড়া, সান্ধ্যকালীন কোর্সের সহজ আয়ের কারণে গবেষণা ও উদ্ভাবনে অনাগ্রহকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করলে অন্যায় হবে না। এসব থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে সমবায়ী উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ।”
উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, “এই বিশ্ববিদ্যালয় ৩৩ লাখ গ্র্যাজুয়েট তৈরি করেছে। অনেক দেশ আছে, যাদের জনসংখ্যাও তেমন নেই। বিশ্বে এমন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় পাওয়া যাবে না, যারা দেশ স্বাধীন ও দেশ গঠনে এতো বড় ভূমিকা পালন করছে।”
অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, “যে বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের একটি ডিগ্রি দিয়েছে, সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আমরা কী ঋণ শোধ করতে পারি, সেটি হচ্ছে আজকের এই মিলনমেলার অবজেক্টিভ।
“আজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বৈশ্বিক র্যাংকিয়ে এক হাজার অবস্থানে। আগামী দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাতে ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে থাকে, সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন কাজ করে যাচ্ছে।”
এ জন্য সবার আগে শিক্ষার মান ও পরিবেশ উন্নয়নে গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, “সরকারের ওপর নির্ভর করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে ১০০ অবস্থানে পৌঁছানো সম্ভব নয়।
“উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মূলত অ্যালামনাইদের অনুদানে চলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে র্যাংকিংয়ে বিশ্বের ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আনতে আমরা ১০০ কোটি টাকার ফান্ড গঠনের একটি লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছি।”
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণতম শিক্ষার্থী ও বাংলাদেশের প্রথম অর্থ সচিব মো. মতিউল ইসলাম, ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি রকীবউদ্দীন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষ উদযাপন কমিটির সভাপতি সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী, অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব রঞ্জন কর্মকার বক্তব্য দেন।
মিলনমেলার শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের মোড়ক উন্মোচন এবং ‘শিল্পীর রং তুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ শীর্ষক চিত্রপ্রদর্শনী উদ্বোধন করা হয়।
দিনব্যাপী এ আয়োজনের শেষে বিকালে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।