ফিরতে হবে শেকড়ের কাছে ।। জাকির আবু জাফর

প্রবন্ধ-কলাম সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

‘ইনসাফ’ একটি শব্দ। আরেকটি শব্দ ‘ন্যায়-বিচার’। দুটো শব্দ মনে রাখবো । কেনো মনে রাখবো- আসবো এখানে। তার আগে কিছু কথা বুঝে নেয়া জরুরি!
মোটাদাগে জগতের প্রতিটি বিষয় একটি আরেকটির বিপরীতে অবস্থান করছে। যেমন আলো অন্ধকার, দিন রাত, আকাশ জমিন, পূর্ব পশ্চিম, ডান বাম, সামনে পেছনে, সাদা কালো, সৎ অসৎ, ভালো মন্দ, জানা অজানা, দেখা অদেখা ইত্যাদি। এভাবে প্রতিটিই একটির উল্টো দিকে আরেকটি দাড়িয়ে।

দার্শনিক প্লেটো বিশ্ব জগতের বিষয়ে দুটো দিক উত্থাপন করেছেন। দুটোর একটি হলো বাস্তব, আরেকটি হলো ভাব। তার মতে- বাস্তুবই বস্তু আর বস্তু হলো নশ্বর যা ক্ষণিকের। আর ভাব অবিনশ্বর যা চিরকালের। এর ভিত্তিতেই তিনি বলেছেন – দৃশ্যজগতের বস্তু সত্য নয়। ভাবই সত্য। দৃশ্যবস্তু হচ্ছে সেই ভাবের প্রকাশ মাত্র। ভাবের কোনো লয় নেই ক্ষয় নেই। এটি স্থান এবং সময়ের উপরও নির্ভর করে না। এ ভাবকেই প্লেটো বলেছেন – বিশ্বের আত্মা!

হযরত ঈসা আ. কে একবার তাঁর সঙ্গীরা জিজ্ঞেস করলেন – হে ঈসা! আল্লাহ তায়ালার বন্ধু কারা- যাদের কোনো ভয় নেই, দুশ্চিন্তাও নেই! জবাবে ঈসা আ. বেশ কটি গুণের উল্লেখ করলেন। বললেন এসব গুণ যাদের থাকবে বা আছে তারাই আল্লাহর বন্ধু। সেই গুণগুলো বলতে গিয়ে লোকদেরকে দুটি ভাগে বিভক্ত করে দিলেন তিনি। একটি আল্লাহর বন্ধু। অপরটি আল্লাহর বন্ধু নয়।

তিনি বললেন- আল্লাহর বন্ধু হলেন তারা,যারা দুনিয়ার অভ্যন্তরীণ রহস্যের দিকে তাকায়, যখন সাধারণ মানুষ তাকায় দুনিয়ার বাহ্যিক খোলসের দিকে। তারপর বললেন – সাধারণ মানুষের দৃষ্টি যখন দুনিয়ার ত্বরিত ফলাফলের দিকে, তখন তাদের অর্থাৎ আল্লাহর বন্ধুদের দৃষ্টি দুনিয়ার শেষ পরিণতির দিকে। ফলে দুনিয়ার যেসব উপকরণ তাদেরকে ধ্বংস করে দেবে বলে তাদের আশংকা! সেগুলো তারা নিজেরা আগেই ধ্বংস করে দেয়। দুনিয়ার যেসব উপকরণ তাদেরকে অচিরেই ছেড়ে যাবে বলে তারা জানে, সেগুলো তারা নিজেরা আগে আগেই ছেড়ে দেয়। দুনিয়া তাদের কাছে একটি সৃষ্ট বস্তু মাত্র, তাই তারা একে সংস্কার করে না। নষ্ট হয়ে গেলে মেরামত করে না। দুনিয়া তাদের অন্তরে মৃত।, তারা একে পুনরুজ্জীবিত করে না। দুনিয়ার প্রতি আসক্ত লোকজন তাদের চোখে উন্মাদ। তারা দুনিয়াকে প্রত্যাখ্যান করে এর মধ্যেই প্রফুল্ল জীবন যাপন করে।

প্রথম যে দুই শ্রেণির কথা বলেছেন তিনি তার দ্বিতীয়টি হলো- যাদের দৃষ্টি পৃথিবীর খোলসের ওপর। পৃথিবীর উপরের রঙচঙা প্রচ্ছদের ওপর। বাইরের তামাশার প্রতি এরা উন্মুখ। এদের কাছে জগতই সর্বস্ব। জগৎই সবকিছুর মূল! এদের জীবনের বড় লক্ষ্য যে করেই হোক সম্পদ এবং ক্ষমতা চাই। প্রথমত সম্পদ! তারপর ক্ষমতা! সম্পদের ক্ষেত্রে দৃষ্টি হলো- পাও তো লও! লও তো খাও! খাও তো আরও খাও! খাও আর খাও! আরও আরও খাও! ভোগ করো জনমের মতো। যত পারো তত ভোগ। ভোগ আর ভোগ। কেননা পৃথিবী তো ভোগেরই সামগ্রী। তাই এখানে ন্যায় অন্যায় বিচারের দরকার কি! সৎ অসতের প্রয়োজন কি! কেনো দেখতে হবে সাদা কালোর ব্যবধান! তাই যত পারো করো ভোগ! তারপর জমাও। জমিয়ে পাহাড় গড়ো। এক পাহাড় হলে আরেক পাহাড় গড়ে নাও। দেশে না হলে বিদেশে গড়ো। একদেশ হলে আরেক দেশে গড়ো। দু তিন বাড়ি নয় ডজন ডজন বাড়ি বানাও। বানাও রাজপ্রাসাদ। বানাও বালাখানা। শীতকালীন গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ। সম্ভব হলে বর্ষাকালীনও! দুবাই- এর নীল জলের কূলে বানাও। কিংবা বানাও কোনো বেগম পাড়ায়! তারপর সুযোগ বুঝে উড়াল তোলো। এভাবে এক দুই প্রজন্ম নয় গড়ো চোদ্দ প্রজন্মের নিরাপদ আবাস!

সাদা কথা যেভাবে পারো যেমন করে পারো সব নিজের অধীন করো। কে বঞ্চিত হলো। কে পেলো না এসব ভাবার সময় কই! এ দলটির চোখে ভোগের রঙিন চশমা ছাড়া আর কিছু নেই। এদেরই চোখ শুধু পৃথিবীর খোলসের দিকে।

পৃথিবীর গভীরের রহস্য বোঝার চোখ নেহায়াতই কম। সমস্যার বাইরের দিক নিয়ে ব্যস্ত সবাই। গভীরে তলিয়ে দেখার মানুষ নেই। নিজেকে ধ্বংস করে দুনিয়ার সুযোগ খোঁজে মানুষ। অথচ দুনিয়া বর্জন করে নিজেকে খোঁজার কথা মানুষের! আসল রেখে নকলের পিছু ছোটার মিছিল বড় দীর্ঘ। কিন্তু নকল বেছে আসলের সন্ধানী খুবই কম।
মানুষ নিজেকে পরিতৃপ্ত করার ইচ্ছে রাখে। নিজেকে খুশি করানোর কাজ করতে চায়। কিন্তু পরিতৃপ্তির কাজ ঝেড়ে অতৃপ্তির কাজেই মশগুল। যা করলে নিজেকে খুশি করানোর বিষয় থাকে, মানুষ সেসব ছাড়িয়ে অখুশির কাজেই অগ্রগামী।

কথাগুলো কেনো বললাম? বললাম, আমরা আমাদের সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সমস্যার শুধু উপরের পিঠ নিয়ে ব্যস্ত। ভেতর নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। অথচ সমস্যার গভীরে না গেলে সমাধান কখনো যথার্থ হবে না। একটি সমাজ দৃঢ়ভাবে দাড়িয়ে থাকে প্রধানত সেই দুটো শব্দের ওপর যা শুরুতে উল্লেখ করেছি- ইনসাফ এবং ন্যায়-বিচার! আসুন সমাজের দিকে তাকাই। কি আছে আমাদের সমাজে! ইনসাফ আছে কি! ন্যায়-বিচার? না দুটোর কোনোটিই নেই ঠিকঠাক। না ইনসাফ, না ন্যায়-বিচার।
সমাজের লোকেরা এ দুটোকে ছাপিয়ে নিজেদের লালসার জাল বিছিয়ে রাখেনি? পৃথিবীর সম্পদ অর্জনের প্রতিযোগিতা তীব্র করেনি? ঠকিয়ে বড়লোক হবার কৌশল গ্রহণ করেনি? এর বাইরেও কৌশল আছে – ক্ষমতাবানদের ছায়া। এ ছায়া যার ওপর পড়ে তার সম্পদ পাহাড় ছাড়িয়ে উঁচু হয়ে ওঠে। কোনো আইনের শেকল তাকে আটকাতে পারে না। কোনো বাধাই তার সামনে বাধা হয়ে দাড়ায় না।

সে তখন যা পায় তা-ই গিলতে থাকে। তা-ই হজম করতে থাকে। সে তখন ভাবতে থাকে – সবকিছু তার হাতের মুঠোয়। কে ঠেকায় তার দুর্মর গতি! পৃথিবীর এ মানুষগুলোই দুনিয়ার খোলসের দিকে চেয়ে থাকে। এরাই শুধু বস্তকেই জীবনের সর্বস্ব ভেবে নেয়। বিস্ময়ের বিষয় হলো- এদের জীবনে সবই থাকে, শুধু সুখ এবং শান্তি থাকে না। নিরাপত্তাও থাকে না এতটুকু। এরা নিজেদের সম্পদ রক্ষার চিন্তায় এতটাই ব্যকুল হয়, যার জন্য মনে সুখ থাকে না। জীবনে শান্তি থাকে না। এবং সবমিলিয়ে নিরাপদ হয় না তাদের জীবন। শেষ পর্যন্ত তারা সমাজে চোর লুটেরা এবং অমানুষ হিসেবে অপমানের বোঝা টানে। টানতে হয়। নিমিষে নিঃস্ব হওয়ার গটনাও ঘটে! অথচ মানুষ যদি মানুষ হয়, সে কখনও পৃথিবীর খোলস নিয়ে মেতে থাকবে না। থাকতে পারে না। সে জানে দুনিয়ার এ খোলস বালিয়াড়ির মতোই। জোয়ারের একটি টানে এটি মিশে যাবে জলধির সাথে!

* জাকির আবু জাফর কবি ও কথাশিল্পী, সাহিত্য সম্পাদক- দৈনিক নয়াদিগন্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *