স্যমন্তক ঘোষ
ভারতে জাকাত দেওয়ার প্রবণতা যথেষ্ট। বছরে আনুমানিক যে টাকা জাকাতে যায়, তা মুম্বই পুরসভার বাৎসরিক খরচের সমান।
২০২১ সালের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৪০ কোটির ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা ২০ কোটির আশপাশে। অর্থাৎ, ভারতের মোট জনসংখ্যার ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ ইসলিম ধর্মাবলম্বী।
এই ২০ কোটি মানুষের কত সংখ্যক জাকাত দেন, তার নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। সারা বছরে মোট কত টাকা জাকাতে প্রদান করা হয়, তা নিয়েও কোনো সুস্পষ্ট হিসেব নেই। গত দুই দশকে এ নিয়ে কিছু গবেষণামূলক কাজ হলেও, মোট জাকাতের পরিমাণ নথিভুক্ত নয়। সম্ভবত, তা নথিভুক্ত করা সম্ভবও নয়।
কত মানুষ জাকাত দেন
ভারতে কত মানুষ বা কত সংখ্যক পরিবার জাকাত দেয়, তা নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। দু’ দশক আগের একটি জাতীয় সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, ভারতে দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ২৬ শতাংশ। গত দু’দশকে এই সংখ্যার সামান্যই বদল হয়েছে। কিন্তু মুসলিম সমাজের মধ্যে দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা বেশি। শতাংশের হিসেবে তা ৪০ থেকে ৪৫। ফলে ধরেই নেওয়া যায়, ১৪ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যার অর্ধেকরও বেশি মানুষ জাকাত দিতে পারেন না। বস্তুত, ইসলামিক অনুশাসনে সকলের জাকাত দেওয়ার কথাও নয়। নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পত্তি থাকলে তবেই জাকাত দেওয়া যায়।
ভারতের বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার জাফারুল ইসলাম খান ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, তার ধারণা, ১৪ শতাংশ মুসলিম জনগণের আট থেকে ১০ শতাংশ মানুষ কম বেশি জাকাত দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ, আট থেকে ১০ কোটি মানুষ জাকাত দেন।
বছরে মোট জাকাতের পরিমাণ
দু’দশক আগের ওই জাতীয় সমীক্ষায় হিসেব করে দেখানো হয়েছিল, ভারতের মুসলিম সমাজের উচ্চবিত্ত এবং উচ্চমধ্যবিত্ত অংশ সব মিলিয়ে বছরে ৯ কোটি ৮১ হাজার টাকা জাকাতে ব্যয় করেন। ২০১৬ সালে হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকা অ্যাসোসিয়েশন অফ মুসলিম প্রফেশনালসের (এএমপি) একটি সমীক্ষার হিসেব তুলে ধরেছিল। তারা জানিয়েছিল, ভারতে প্রতি বছর ৩০ হাজার কোটি টাকার জাকাত জমা হয় বলে এএমপি মনে করে।
ডিডাব্লিউকে জাফারুল ইসলাম জানিয়েছেন, ”এখনো পর্যন্ত কোনো সরকারি বা অসরকারি সংস্থা মোট জাকাতের পরিমাণ জানাতে পারেনি। এ নিয়ে খুব বেশি কাজও হয়নি। কারণ, এই হিসেব পাওয়া কঠিন। তবে সব মিলিয়ে সংখ্যাটি ৩০ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা।”
জাকাতের পরিমাণ জানা কেন কঠিন
ভারতে বেশ কিছু সংস্থা এখন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জাকাতের অর্থ সংগ্রহ করে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এএমপি, জামাতে ইসলামির জাকাত সেন্টার ইন্ডিয়া, জাকাত ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়ার মতো সংস্থা। প্রতি বছর কয়েক কোটি টাকা সংগ্রহ করে তারা তা গরিব এবং অনাথদের মধ্যে দান করে। দান করা হয় মাদ্রাসার গরিব পড়ুয়া এবং বিধবাদের মধ্যেও।
সাংবাদিক জাভেদ আখতার মনে করেন, ”ইদানীং শহরাঞ্চলে এই ধরনের সংস্থাকে জাকাত দেওয়ার প্রবণতা বাড়লেও গ্রামে-গঞ্জে-মফস্বলে মানুষ এখনো ব্যক্তিগত উদ্যোগেই জাকাত দিতে পছন্দ করেন বেশি। এবং এর একটা বড় অংশ নগদে দেওয়া হয়। ফলে সেই টাকা কোনো হিসেবের মধ্যে থাকে না।” গ্রামের দিকে এখনো অনেকে পরিবারে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র্য ব্যক্তিদের এই সময় সাহায্য করেন। অনেকে পরিবারের কারো চিকিৎসার জন্য অর্থ ব্যয় করেন। সেই সমস্ত অর্থ ধরলে মোট জাকাতের পরিমাণ আরো বাড়বে বলেই জাভেদ মনে করেন।
জাফারুল ইসলামের বক্তব্য, শহরাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি জাকাত দেওয়া হয় ভিখিরিদের। যে কারণে, রমজান মাসে মুসলিম অঞ্চলগুলিতে ভিখিরিদের ভিড় লক্ষ্য করা যায়। শহরাঞ্চলের মানুষ পরিবারের মধ্যে খুব বেশি জাকাত দেন না বলে তার ধারণা। কারণ সেখানে একটি সামাজিক বাধা কাজ করে। অনেকেই বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে অনাথাশ্রম বা মাদ্রাসায় জাকাত দেন। এই সংস্থাগুলির কাছ থেকে মোট জাকাতের একটি আনুপাতিক হিসেব পাওয়া যায়। যা ৪০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি।
কাশ্মীরের সাংবাদিক রাউফ ফিদা জানিয়েছেন, সেখানেও ছোট ছোট সংস্থা গড়ে উঠেছে গত কয়েকবছরে, যারা রমজান মাসে বাড়ি বাড়ি এসে জাকাত সংগ্রহ করে। পরে সেই টাকা বিভিন্ন সামাজিক সেবার কাজে ব্যবহার করা হয়। তবে সুযোগ থাকলে সেখানেও মানুষ ব্যক্তিগত উদ্যোগে জাকাত দিতে বেশি পছন্দ করেন। উল্লেখ্য, দিল্লি এবং কলকাতাতেও রমজান মাসে নানা সংস্থা বাড়ি বাড়ি গিয়ে জাকাত সংগ্রহ করছে ইদানীং। মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকেই এখন এই ধরনের সংস্থাকে জাকাতের অর্থ প্রদান করে।
মোট জাকাতের পরিমাণ মুম্বই পুরসভার বাৎসরিক খরচের বেশি
ভারতে জাকাতের বাৎসরিক পরিমাণ যদি ৩০ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা হয়, তাহলে তা ভারতের অন্যতম ব্যয়বহুল পুরসভা মুম্বইয়ের বাৎসরিক মোট লেনদেনের বেশি। এই হিসেবটি নিয়ে নানা মহলে নানা কথা শুরু হয়েছে গত কয়েকবছর ধরে।
এএমপি গোটা দেশে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। সেখানে চার হাজার ৫৮৯ জন মানুষের কাছে প্রশ্নপত্র পাঠিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল তারা কীভাবে জাকাত দেন। তার ভিত্তিতে তারা একটি রিপোর্ট তৈরি করেছিল। যাতে বলা হয়েছিল, ৭৭ শতাংশ মতদাতা মনে করেন, জাকাতের টাকা একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে ব্যয় করলে গোটা দেশের মুসলিম সমাজের সার্বিক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।
জাকাতকে কেন্দ্র করে যে সংগঠনগুলি গড়ে উঠেছে, তারাও একই কথা মনে করে। সাংবাদিক জাভেদ মনে করেন, একটি জাতীয় তহবিল তৈরি করা যায় জাকাতের জন্য। সকলে সেখানে জাকাতের অর্থ জমা করবেন। একটি নির্দিষ্ট বোর্ড সেই অর্থ সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অংশের উন্নয়নে ব্যয় করলে গোটা মুসলিম সমাজের জন্য তা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে।
তবে আদৌ ভারতের মতো দেশে এমন কাজ করা সম্ভব কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। যে সংস্থাগুলি ইতিমধ্যেই জাকাত সংগ্রহের কাজ করে, তাদের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। তবে সকলেই একটি কথা স্বীকার করেছেন। ভারতের মতো দেশে জাকাতে যে পরিমাণ অর্থ জমা হয়, তা বিপুল।
স্যমন্তক ঘোষডয়চে ভেলে দিল্লি ব্যুরোর সাংবাদিক। ভারতের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজের নানা ইস্যু কভার করেন।