প্রবাসী আইনজীবী পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে প্রসিকিউশনকে এডভাইস ও ট্রাইবুনালে অবজার্ভার হিসেবে অংশ নিতে পারেন: চিফ প্রসিকিউটর
ইউকে লইয়ার্স অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ (ইউল্যাব) আয়োজিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, ন্যায় বিচার প্রদানে তারা শতভাগ সচেষ্ট। দেশবিরোধী সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হতে বাধ্য। এক্ষেত্রে প্রবাসী বাংলাদেশী আইনজীবীরা পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে প্রসিকিউশনকে এডভাইস করতে এবং ট্রাইবুনালে অবজার্ভার হিসেবে অংশ নিতে পারেন।
ইস্ট লন্ডনের বারাকা ইটারিতে বাংলাদেশী আইনজীবীদের অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ব্যারিস্টার ও সলিসিটর আসাদুজ্জামান। উপস্থাপনা করেছেন- ব্যারিস্টার ও সলিসিটর ফখরুল ইসলাম। আলোচনায় অংশ নিয়েছেন- ব্যারিস্টার ও সলিসিটর নুরুল গাফফার, সলিসিটর মেহেদী হাসান, ব্যারিস্টার ইকবাল হোসেন, ব্যারিস্টার ও সলিসিটর ওয়াহিদুর রহমান, ব্যারিস্টার ও সলিসিটর গোলাম আযম, ব্যারিস্টার ও সলিসিটর আব্দুল হালিম সরকার, ব্যারিস্টার আরিফুল কবির চৌধুরী, ব্যারিস্টার সৈয়দ হাসান, ব্যারিস্টার ও সলিসিটর সালাহউদ্দিন সুমন, ব্যারিস্টার ফয়সাল জামিল, ব্যারিস্টার আবু সাদাত ডালিম, ব্যারিস্টার নুমান,ব্যারিস্টার বাকি, হিসাবরক্ষক ইউসুফ আলী,
দৈনিক সময় ও মানব টিভি সম্পাদক সাঈদ চৌধুরী, সাপ্তাহিক দেশ সম্পাদক তাইসার মাহমুদ, সাংবাদিক এনাম আহমদ চৌধুরী প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। নির্বাহী বিভাগের কুক্ষিগত করে রাখা বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসংক্রান্ত আলোচনায় প্রধান্য পায়। উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের নীতিমালা, অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদোন্নতিসহ সার্বিক বিষয়ে বেশ কিছু পরামর্শ উপস্থাপন করেন ইউল্যাব নেতৃবৃন্দ। ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় বিচার ব্যবস্থায় ন্যায় বিচার ও মানবাধিকার রক্ষার জন্য সময়ে সময়ে যে সংস্কার সাধিত হয় তা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন বিজ্ঞ অনেক আইনজীবী।
শেখ হাসিনার সরকার নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অতীত কর্মকান্ডের ব্যাপক সমালোচনা করে প্রবাসী আইনজীবীগন বর্তমান প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম-সহ নতুনভাবে মনোনীত সৎ ও সাহসী আইনজ্ঞদের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তারা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সব ধরনের বিদ্বেষমূলক বক্তব্য গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করায় কর্তৃপক্ষকে অভিনন্দন জানান।
অনুষ্ঠানে দৈনিক সময় ও মানব টিভি সম্পাদক সাঈদ চৌধুরী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহন করেন।
সাঈদ চৌধুরী: যে আদালতে এখন আপনি প্রধান প্রসিকিউটর, সে আদালতেই একদিন অবিচার হয়েছে। মানুষ হত্যার শিকার হয়েছেন। আজকে আপনার নেতৃত্বে যে বিচার হবে, আন্তর্জাতিক বিশ্ব তাকিয়ে আছে, আপনি কতটা দৃঢ়তার সাথে বলতে পারেন যে সুবিচার নিশ্চিত হবে?
তাজুল ইসলাম: আমি একশো পার্সেন্ট দৃঢ়তার সাথে আপনাদের এনসিওর করছি, এবং আপনার এই গণমাধ্যম (মানব টিভি)’র মাধ্যমে আমি গোটা দুনিয়ার কাছে এই ম্যাসেজটা রাখাতে চাই যে, এই ট্রাইব্যুনালকে যেভাবে অবিচারের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে, সেইদিন অতিতে পরিণত হয়েছে। এই ট্রাইব্যুনাল গোটা জাতির প্রত্যাশা অনুযায়ী সংবিধানের নিরাপওা এবং ন্যায়বিচারের মাধ্যমে বাংলাদেশের সংঘটিত যে বর্বরতা, মানবতা বিরোধী অপরাধ, এটার চিরস্থায়ী কবর দিতে চাই। এখানে এমন একটা নিরপেক্ষ বিচার করতে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, যার মাধ্যমে আগামী প্রজন্ম জানবেন যে, এখানে অপরাধীদের সত্যিকারের বিচার হয়েছে। স্বৈরশাসকরাও বুঝবেন যে, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য একটা জাতিকে নৃশংস হত্যা, দমন করা, গনহত্যা চালানো, মানবতা বিরোধী অপরাধ করা, ভবিষ্যতে যারা স্বৈরশাসক হতে চান তাদের জন্য এটা একটা লেসন হয়ে থাকুক এই বিচার ব্যবস্থা। আমরা সবাইকে আশ্বস্ত করছি। প্রত্যেকটা স্টেপ আপনারা অবজার্ব করুন। এটা শুধু কথা মালার বিষয় না। বিষয় কাজের মধ্যে দিয়ে প্রমাণ করি, এই ট্রাইব্যুনালের বিচার পদ্ধতি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ হবে, নিরপেক্ষ আছে এবং এর মাধ্যমে সুষ্ঠু বিচার আমরা নিশ্চিত করব।
সাঈদ চৌধুরী: আপনি যে আদালতে ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য সচেষ্ট ছিলেন, প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়েছিলেন, যথেষ্ট যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন। কিন্তু তা মানা হয়নি।
জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের হত্যা করা হয়েছে। রাষ্ট্র কি স্বপ্রণোদিত হয়ে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইবে?
তাজুল ইসলাম: কোন হত্যাকান্ড? যেগুলা আগে হয়েছে। সেগুলার ব্যাপারে আমি বলতে পারছি না। কারণ যেগুলো অতিত হয়ে গেছে। সেটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রশ্ন। সরকার যদি এসব ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া হবে। এই ট্রাইব্যুনালে যেহেতু ওই বিচারগুলো আর পেন্ডিং নেই, সুতরাং চিপ প্রসিকিউটর হিসাবে আমার আর কিছু করার সুযোগ নেই। অতীতে বিচারে যে হত্যাকান্ডের ব্যাপারে রাস্ট্র যদি কোন পদক্ষেপ গ্রহন করে অথবা আইনের কোন সংশোধনীর মাধ্যমে সংঘটিত অবিচারের ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ গ্রহন করতে পারে। আমরা অন্তত এটা বলতে পারবো, আগামীতে যে বিচারগুলো হবে সে ব্যাপারে প্রশ্নযুক্ত করার কোনো সুযোগ থাকবে না।
সাঈদ চৌধুরী: বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। দৃশ্যমানভাবে যাদের কথা এসেছে, তাদেরকে কি আপনার কোর্টে আইনের আওতায় আনার সুযোগ আছে?
তাজুল ইসলাম: না ফিনান্সিয়াল যে সমস্ত আপরাধ, লুটপাট করে দেশের টাকা পাচার করা, এটা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের জুরিসডিকশনের বিষয় নয়। এটার জন্য সরকারের ভিন্ন আইন আছে, সংস্থা আছে, দুর্নীতি দমন কমিশন আছে, স্পেশাল আদালত আছে, সেখানে এগুলো বিচার করা হবে।
সাঈদ চৌধুরী: দেশে বিদেশে আপনার আদালতকে নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করছে, ডক্টর ইউনুসকে নিয়ে যারা নানা রকম বাজে মন্তব্য করছে। তাদেরকে আপনি বিচারের আওতায় আনার কোনো সুযোগ আছে কিনা?
তাজুল ইসলাম: দেখুন, অপরাধী সবসময় তার অপরাধকে ঢাকার জন্য নানা ধরনের আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। তারা জাতির প্রতি যে বর্বরতা চালিয়েছে, অবিচার করেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, এটা থেকে তাদের বাঁচার তো আর কোন রাস্তা নেই। সুতরাং একমাত্র রাস্তা হচ্ছে- এই বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। সেটার জন্য তারা চেষ্টা করছে এবং তারা করবে। এতে ন্যায়বিচারের কার্যক্রম থেমে থাকবে না। এবং এর মাধ্যমে তাদের বাঁচারও কোন সুযোগ নেই। এই অপপ্রচারকারীরা ব্যর্থ হবে। বাংলাদেশের মানুষ তাদের ব্যর্থ করে দেবে। এ ব্যাপারে আমি আপনাকে নিশ্চিত করতে পারি।
সাঈদ চৌধুরী: অনেকে মনে করছেন সারা জাতির ঐক্যবদ্ধ হবে, বিশেষত অপপ্রচারের বিরুদ্ধে। প্রধান প্রসিকিউটর হিসেবে আপনার কি ধারনা?
তাজুল ইসলাম: চিফ প্রসিকিউটর হিসাবে রাজনৈতিক বিষয়ে আমি বক্তব্য দেওয়ার কথা না। তারপরেও আপনি যে প্রশ্নটা করেছেন, সেটার সাথে জাতীয় প্রত্যাশার সম্পৃক্ততা আছে। বাংলাদেশের মানুষ তাদের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন ড. ইউনুসের এই অন্তর্বর্তীকালীন এই বিপ্লবী সরকারের দায়িত্ব গ্রহনের ক্ষেত্রে। সুতরাং তার সরকারের প্রতি গোটা জাতির প্রত্যাশা আছে যে, তিনি এমন একজন এক্সেপটেবল পার্সন, গণমানুষের যে আকাঙ্ক্ষা, এই রাষ্ট্র যেভাবে ধ্বসে পড়েছে, সেখান থেকে তুলে আনার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এবং সেই পদক্ষেপ অনুযায়ী কাজ চলছে। ৬টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছেন তিনি এবং প্রতিটি সংস্কার কমিশন এখন কাজ করছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসাবে মনে করি এবং আমি বিশ্বাস করি এই সরকার সফল হবেন। কারণ এই সরকারের পিছনে যে জনসমর্থন আছে, কখনোই কোন সরকারের পিছনে এত বেশি জনসমর্থন ছিল না। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষ, শুধু আওয়ামী লীগ ব্যতীত প্রত্যেকটি মানুষ এই সরকারকে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং তাদের প্রত্যাশা পুরণের ব্যাপারে আশাবাদী। আমিও বিশ্বাস করি এই সরকার সেই সংস্কার করতে সক্ষম হবেন। বাংলাদেশ নামক রাস্ট্রকে যেভাবে মানুষ দেখতে চায়, সেরকম একটা রাষ্ট্র এই সরকার উপহার দেবে।
সাঈদ চৌধুরী: এইখানে যাদের সাথে আপনি কথা বলবেন, বাংলাদেশি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড, আমাদের যারা মেধাবি, বিশেষত আইনের ক্ষেত্রে যাঁরা প্রাজ্ঞ। আপনার আদালতে কিংবা বাংলাদেশের আইনের সাফল্য-সমৃদ্ধির জন্য তাদের কোন ধরনের অংশগ্রহণ আপনারা কি প্রত্যাশা করছেন?
তাজুল ইসলাম: দেখুন, বিচার প্রক্রিয়া তো একটা সুনির্দিষ্ট পন্থায় চলে। হঠাৎ করে কাউকে ইনবল্ব করা যায় না। আমাদের ট্রাইবুনালে অবজার্ভার হিসেবে অংশ নিতে পারেন। বাংলাদেশে এবং এই দেশথেকে যেভাবে সম্ভব হয়, তাদের পেশাগত জ্ঞান এবং দক্ষতা দিয়ে আমাদের প্রসিকিউশনকে এডভাইস করতে পারেন। বিদেশের যে সমস্ত অপপ্রচার এই ট্রাইব্যুনাল এবং বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য যেসব সিন্ডিকেটের অপপ্রচার চলবে, সেগুলোকে কাউন্টার করার জন্য ভূমিকা রাখতে পারবেন। সুতরাং আদালত কক্ষে না হলেও বাইরে থেকে তাদের ভূমিকা রাখার অজস্র সুযোগ আছে এবং বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে আমরা তাদের কাছে আহব্বান জানাবো- এই দেশ এবং জাতির প্রতি আপনাদের দায়বদ্ধতা আছে। জগদ্দল পাথরের মতো স্বৈরাচারকে সরানোর ব্যাপারে আপনার ভূমিকা পালন করেছেন। একইভাবে বাংলাদেশ পুনর্গঠনে এবং বিচার প্রক্রিয়াকে সঠিক রাস্তায় এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে সমর্থন অব্যাহত রাখতে হবে। দেশে-বিদেশে অপপ্রচারের জবাব প্রদানের মাধ্যমেও বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারবেন। আমরা এই প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে দুনিয়াব্যাপী প্রবাসীদের কাছে সহায়তা কামনা করছি। ।