মাক্কাতুল মুকাররামাহ বা পবিত্র কাবা ঘরকে পৃথিবীর হৃৎপিণ্ড বা হৃদয় বলা যায়। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে দুনিয়ার কেন্দ্র বিন্দুতে অবস্থিত। গোল্ডেন রেশিও (Golden ratio) বা গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবা ঘরের অবস্থান। একে কেন্দ্র করে পৃথিবী ঘূর্ণায়মান।
বৈজ্ঞানিক ভাবে আমরা জানি, বছরের একটি বিশেষ মধ্যাহ্নে সূর্য কাবা শরিফের ঠিক ওপরে অবস্থান করে। তখন কাবা ঘরে অন্য কোনো স্থাপনার ছায়া চোখে পড়ে না। পৃথিবীর অন্যত্র এমনটা ঘটে না। এতে প্রমাণিত হয়, পবিত্র কাবা ভূমণ্ডলের ঠিক মধ্যস্থলে অবস্থিত।
চন্দ্র-সূর্য কিংবা তারকারাজি মহাবিশ্বের সব কিছুই মহান আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন। একমাত্র তাঁর নির্দেশেই পরিচালিত হচ্ছে। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় এটাকে মাধ্যাকর্ষণ বলে, আর ইসলামী পরিভাষায় বলা হয় স্রষ্টার প্রতি সৃষ্টির নিঃসঙ্কোচ আনুগত্য ও আত্মসমর্পণ।
১৯৮৫ সালের রামাদ্বান মাসে সৌভাগ্যক্রমে আল্লাহর ঘর পবিত্র মক্কায় গিয়ে হাজির হই। সাথে ছিলেন বড় ভাইজান ডা. শাব্বির আহমদ চৌধুরী ও সেঝো ভাইজান মাওলানা ফায়্যাজ আহমদ চৌধুরী। এরপর বহুবার গিয়েছি। কিন্তু ভালোলাগা ও ভালোবাসায় কোন ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়নি।
সে এক গভীর অনুভূতি। কাবা ঘরের মন মাতানো সুরভি-সৌরভ মন্ডিত। কী ঔজ্জ্বল্য আলোর দীপ্তি! এমন সুন্দরতম ও চিত্তাকর্ষক স্থান পৃথিবীতে আর নেই।
আল্লাহর ঘরের দিকে তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। মহান মাবুদের প্রতি পূর্ণ অনুগত হয়ে বারবার উচ্চারণ করেছি – হে আল্লাহ আমি হাজির। আমাকে দয়া করে তোমার প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করে নাও।
লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা-শারীকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হা’মদা ওয়ান্নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা-শারীকা লাক। আমি হাজির। ও আল্লাহ! আমি হাজির। তোমার কোন শরিক নেই। সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধুই তোমার। সাম্রাজ্য তোমারই। তোমার কোন অংশিদার নেই।
মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও শান-শওকতের সামনে আমি নতজানু। দুনিয়ার জালিম শাসক ও স্বৈরাচারী শক্তি সমূহকে অস্বীকার করছি। অস্বীকার করেছি আল্লাহ ছাড়া সকল প্রভুত্বের দাবিদার তাগুতি শক্তির ঔদ্ধত্যকে।
আমার হৃদয়-ধ্বনি কাবার গিলাফ ছাপিয়ে যেন বাতাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ডানে-বায়ে ও সামনে-পিছনে যারা আছেন, তারা সকলে একই কাপড়ে আবৃত। ধনী-গরিব আর সাদা-কালোর কোন তফাৎ নেই। সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।
আমাদের তালবিয়া উচ্চারণের সাথে সাথে আরো অসংখ্য মানুষের সু-উচ্চকণ্ঠ নিনাদে মহান আল্লাহ তায়ালার একত্ব ও মহত্ত্বের কথা বিঘোষিত হচ্ছে।
কিয়ামতের ময়দানে আল্লাহর সামনে যেভাবে হাজির হব, সেভাবে আমরা হাজির হয়েছি। আল্লাহর প্রতি হৃদয় নিংড়ানো গভীর ভালোবাসার আবেগ কেন্দ্রিক মূহুর্ত। সকলে আল্লাহর ঘর তোয়াফ রত।
কাবার চারদিকে প্রদক্ষিণ করে হাজরে আসওয়াদে চুমু খেয়ে অন্তরাত্মায় জাগরিত হয় বেহেস্তি আবহ অনুভূতি মিশ্রিত প্রশান্তি। পবিত্র কাবা ঘরের দিকে দুই হাত তুলে বার বার প্রাণভরে উচ্চারণ করেছি আকুতি ভরা প্রণতি ‘আল্লাহু আকবর’, আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ।
কাবাঘর কেবল ইবাদত-কেন্দ্র নয়। এটি মানুষের জন্য সুপথ প্রদর্শনের ও বরকত দানের প্রথম ঘর। কুরআনের দৃষ্টিতে এই ঘর মুসলমানদের ঐক্য ও নিরাপত্তার কেন্দ্র।
মুশরিক ও কাফিরদের বাধার কারণে এই মক্কা ছেড়ে মদীনায় যেতে বাধ্য হয়েছিলেন মহানবী মোহাম্মদ (সা.)। পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে বিশ্বনবী একতা ও সংহতির ডাক দিয়ে মক্কায় আসেন।
মিকাতে গোসল সেরে তিনি ইহরামের পোশাক পরলেন। এরপর গভীর প্রেম ও অপূর্ব ভঙ্গিমায় তালবিয়ায় মহান আল্লাহর প্রশংসা ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা উচ্চারণ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন।
পবিত্র কাবাঘরের সামনে এসে দুই হাত উপরে তুলে দোওয়া করলেন- হে আল্লাহ, এই ঘরের মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব ও কল্যাণ বৃদ্ধি করে দিন। আর যারা ওমরা ও হজ করতে আসবে তাদের সম্মান ও কল্যাণ বাড়িয়ে দিন। এরপর তিনি হাজরে আসওয়াদ পাথরে হাত বুলালেন এবং কাবার চারদিকে প্রদক্ষিণ করলেন।
মহানবী (সা.) মদীনা থেকে মক্কায় উটে চড়ে এসেছিলেন। তার উটের চালক আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা কবিতা আবৃত্তি করে বলছিলেন: হে মুশরিক ও কাফিরদের সন্তানেরা, মহনবীর জন্য পথ খুলে দাও। তোমরা জেনে রাখ, তিনি সব কল্যাণের উৎস, তাঁকে মেনে নেয়া ও তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের মধ্যেই কেবল কল্যাণ নিহিত আছে।
হে প্রভু! আমি তাঁর বাণীতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি এবং তাঁর রিসালাতে বিশ্বাস স্থাপন সংক্রান্ত আপনার নির্দেশ সম্পর্কেও আমি জ্ঞাত।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন – ‘সুদূর মক্কা মদিনার পথে আমি রাহি মুসাফির/ বিরাজে রওজা মোবারক যথা মোর প্রিয় নবীজীর/ বাতাসে যেখানে বাজে অবিরাম/ তৌহিদ বাণী খোদার কালাম/ জিয়ারতে যথা আসে ফেরেশতা শত আউলিয়া পীর/ মা ফাতেমা আর হাসান হোসেন খেলেছে পথে যার/ কদমের ধূলি পড়েছে যেথায় হাজার আম্বিয়ার/ সুরমা করিয়া কবে সে ধূলি/ মাখিব নয়নে দুই হাতে তুলি/ কবে এ দুনিয়া হ’তে যাবার আগে রে কাবাতে লুটাব শির।’
(চলবে, ‘ধূসর মরুর বুকে’ ডাইরি ১৯৮৫ থেকে)
লেখক: সময় সম্পাদক, কবি ও কথা সাহিত্যিক।