ইসরায়েলের তেল আবিব, জেরুজালেম ও হাইফা শহরে হাজার হাজার লোকের বিক্ষোভ হয়েছে। গত শনিবার দেশটিতে এ ধরনের বিক্ষোভ নজিরবিহীন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলে এত বিপুল জনতার রাস্তায় নামার দৃশ্য সম্প্রতি দেখা যায়নি।
এই বিক্ষোভের কারণ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার ইসরায়েলের বিচার বিভাগ সংক্রান্ত আইনগুলোতে বড় রকমের পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে। এসব পরিবর্তনের ঘোষণা ইসরায়েলে এবং অধিকৃত এলাকাগুলোতে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের মধ্যেও সৃষ্টি করেছে তীব্র উদ্বেগ ও ক্ষোভ।
উগ্র ডানপন্থীদের সমর্থন নিয়ে ষষ্ঠবারের মতো ইসরায়েলের নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রী হওয়া নেতানিয়াহু বিচার বিভাগের এমন কিছু সংস্কার করার পরিকল্পনা করেছেন যা তার বিরোধীরা বলছেন, এতে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট দুর্বল হয়ে পড়বে।
সমালোচকরা এ পরিবর্তনের উদ্যোগকে “অভ্যুত্থান”, “ক্ষমতার পটপরিবর্তন” ইত্যাদি নানা শব্দে আখ্যায়িত করছেন। অনেকে বলছেন, নেতানিয়াহু নিজেই ইসরায়েলের “গণতন্ত্রের জন্য এক মূর্তিমান বিপদ।”
কেন এই বিক্ষোভ হচ্ছে
নেতানিয়াহু এর আগে ২০২১ সাল পর্যন্ত টানা ১২ বছর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তবে এবার তিনি যে সরকার গড়েছেন, তাকে বলা হচ্ছে ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে উগ্র ডানপন্থী সরকার। তার কোয়ালিশনে অংশীদার দলগুলোর মধ্যে আছে অতি উগ্র ডানপন্থী, কট্টর জাতীয়তাবাদী এবং অত্যন্ত গোঁড়া ইহুদি রাজনৈতিক দলগুলো।
ক্ষমতায় এসেই এ সরকার ঘোষণা করে যে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি নির্মাণ সম্প্রসারণ হচ্ছে তাদের এক নম্বর অগ্রাধিকার। ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর লাখ লাখ ফিলিস্তিনি পরিবার ভিটেমাটি ছাড়া হয়েছিলেন। আর ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল জর্ডন নদীর পশ্চিম তীর, গাজা এবং পূর্ব জেরুসালেম দখল করে নেয়।
আন্তর্জাতিক আইনে এখানে ইহুদি বসতি নির্মাণ অবৈধ হলেও ইসরায়েল এ পর্যন্ত ৫ লাখ ইহুদির জন্য বসতি নির্মাণ করেছে। শুধু তাই নয়, আল-জাজিরার এক রিপোর্টে বলা হচ্ছে যে নেতানিয়াহু কোয়ালিশন গঠনের জন্য একটি কট্টরপন্থী দলকে এমন অঙ্গীকারও করেছেন যে তিনি অধিকৃত পশ্চিম তীরকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলের অংশে পরিণত করবেন। অধিকৃত পশ্চিম তীরে বাস করেন প্রায় আড়াই লক্ষ ফিলিস্তিনি।
নেতানিয়াহুর পরিকল্পনায় কী আছে?
নেতানিয়াহু সরকারের আনা পরিকল্পনাটিতে ইসরায়েলের বর্তমান বিচার বিভাগে ব্যাপক কিছু পরিবর্তন আনার কথা বলা হচ্ছে । এতে ইসরায়েলের হাইকোর্টের ক্ষমতা কমানো হবে এবং পার্লামেন্টের সদস্যরা এমন সব আইন পাস করতে পারবেন- যা আদালত এর আগে খারিজ করে দিয়েছে বা কার্যত অসাংবিধানিক বলে মত দিয়েছে।
দেশটির বিচারমন্ত্রী ইয়ারিভ লেভিন বলেন, নতুন পরিকল্পনায় ইসরায়েলের ১২০ আসনের পার্লামেন্ট বা কনেসেটের ক্ষমতা এমনভাবে বাড়বে যে তারা সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্থাৎ ৬১ জন এমপির সমর্থন পেলেই সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত উল্টে দিতে পারবেন।
পরিকল্পনায় আরও বলা হয়, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ করা হবে। মন্ত্রীরা তাদের নিজস্ব আইনী উপদেষ্টা নিয়োগ করতে পারবেন।
নেতানিয়াহুর মিত্র উগ্র-জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় গোঁড়াপন্থীরা বলছেন, তারা আশা করছেন যে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি ব্যক্তিমালিকানাধীন ভূমিতে ইসরায়েলি বসতি বা “আউটপোস্ট” নির্মাণকে অবৈধ ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট যেসব রুলিং দিয়েছে- সেগুলো তারা খারিজ করতে পারবেন।
এ ছাড়াও আরও অনেকগুলো পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে এ পরিকল্পনায়। লেভিন বিচারপতিদের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, এমন কিছু লোক এখন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যাদেরকে জনগণ ভোট দেয়নি। তিনি যুক্তি দেন যে প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলোর ফলে ইসরায়েলি বিচার ব্যবস্থা শক্তিশালী হবে এবং এর ওপর জনগণের আস্থা ফিরে আসবে।
নেতানিয়াহুর যখন বিচার চলছে, তখনই পরিবর্তনের উদ্যোগ
যে সময়টায় এই উগ্র-ডানপন্থী সরকার এ পরিকল্পনা উত্থাপন করলো– তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে এমন এক সময় – যখন নেতানিয়াহু নিজেই ঘুষ, জালিয়াতি ও প্রতারণার মামলায় বিচারাধীন। তবে এসব অভিযোগ তিনি জোর দিয়ে অস্বীকার করেছেন।
বিবিসির বিশ্লেষক রাফি বার্গ বলছেন, এই নতুন সরকার বিচার বিভাগে পরিবর্তন আনার পর নেতানিয়াহুর বিচার বাতিল করার জন্য একে ব্যবহার করতে পারে বলে সমালোচকরা আশংকা করছেন। যদিও নতুন সরকার এখনও বলেনি যে তারা এমন কিছু করবে।
এ ছাড়া যেদিন এ পরিকল্পনা ঘোষণা করা হলো, তার একদিন পরেই সুপ্রিম কোর্টে নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভার একটি নিয়োগের বিরুদ্ধে একটি আইনী চ্যালেঞ্জের শুনানী হয়। এই ভাবী মন্ত্রীটি হচ্ছেন অতি-গোঁড়া শাস পার্টির নেতা আরিয়েহ ডেরি- তার ওপর ট্যাক্স ফাঁকির জন্য একটি মামলায় স্থগিত দন্ডাদেশ রয়েছে।
আল-জাজিরার এক রিপোর্টে বলা হয়, আদালতে দোষী সাব্যস্ত এবং দণ্ডিত এই ব্যক্তিকে মন্ত্রী নিয়োগের জন্য ইসরায়েলি পার্লামেন্ট একটি আইন সংশোধন করেছিল।
বিবিসির বিশ্লেষক বলছেন, এর বিরুদ্ধে করা আপিল যদি গ্রাহ্য হয়, তাহলে তা আদালত ও সরকারের মধ্যে একটি ‘শোডাউনে’ পরিণত হতে পারে।
অন্যদিকে এ পরিকল্পনা যদি আইনে পরিণত হয় তাহলে, সরকারের জন্য অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি নির্মাণের পক্ষে আইন করা সহজ হয়ে যেতে পারে। কারণ তাহলে সরকারকে আর সুপ্রিম কোর্টে এর বিরুদ্ধে আইনী চ্যালেঞ্জ নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হবে না।
মনে রাখতে হবে অধিকৃত পশ্চিম তীরে অতীতে বহু মামলা ধরে চলার কারণে ইহুদি বসতি নির্মাণ বা ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের প্রয়াস বছরের পর বছর আটকে ছিল।
এর একটি উদাহরণ – শেখ জারাহ-র ফিলিস্তিনি পরিবার নিয়ে আইনী লড়াইয়ের ঘটনা। নেতানিয়াহুর সরকার বিচারব্যবস্থায় যেসব পরিবর্তনের কথা বলছে – তাতে এমনটা আর হতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে।
অনেকদিন ধরেই ‘পরিবর্তনের’ কথা বলছিল লিকুদ পার্টি
এ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হচ্ছে তা পাত্তা দিতে চাইছেন না নেতানিয়াহু। তিনি বলছেন, তার বিরোধী বামপন্থীরা গত নভেম্বর মাসের সির্বাচনের ফলাফল মানতে চাইছে না।
তিনি এও বলেন যে তার এ পরিবর্তনের প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। প্রকৃতপক্ষে লিকুদ রাজনীতিবিদরা অনেকদিন ধরেই ইসরায়েলের উচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করে আসছে।
তারা বলছে, যে সুপ্রিম কোর্টে বামপন্থী বিচারপতিদের প্রাধান্য আছে এবং তারা রাজনৈতিক কারণে তাদের “বিচারবিভাগীয় ক্ষমতার সীমার বাইরের বিভিন্ন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছেন।”
“তারা ইসরায়েলি গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে চায়”
অন্যদিকে এ পরিকল্পনার বিরোধীরা বলছেন, এর ফলে ইসরায়েলে যে গণতান্ত্রিক ‘চেক এ্যান্ড ব্যালান্স’ বা ক্ষমতার ভারসাম্য আছে তা হুমকির মুখে পড়বে। তারা বলছেন, বিচারবিভাগীয় নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরো জোরালো হবে, এবং ইসরায়েলি পার্লামেন্ট বা কনেসেটে পাস করা আইনকে খারিজ করে দেবার যে ক্ষমতা বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আছে – তা সীমিত করবে।
তাদের আরও আশংকা- এর ফলে বিচারকদের স্বাধীনতা খর্ব হবে, সরকার ও পার্লামেন্টের কাজের ওপর নজরদারি দুর্বল করে ফেলবে, সংখ্যালঘু ও সমকামীদের অধিকার খর্ব হবে, এবং আরো বেশি দুর্নীতির বিস্তার ঘটবে।
এইসব কারণে নাগরিকদের এ প্রতিবাদে যোগ দিয়েছেন নেতানিয়াহু-বিরোধী রাজনীতিবিদরাও। বিরোধী দলের নেতা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইয়াইর লাপিদ বলছেন “এই প্রতিবাদ হচ্ছে দেশকে রক্ষার জন্য। আমি এ বিক্ষোভে এসেছি গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য।”
ইসরায়েলি বার সমিতির প্রধান আভি চিমি সংবাদদামধ্যমকে বলেছেন, নেতানিয়াহু ও তার জোট ইসরায়েলকে একটি একনায়কতন্ত্রী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায় গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে চায়।
“তারা চাইছে বিচার বিভাগের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতাকে ধ্বংস করতে কিন্তু বিচারবিভাগের কর্তৃত্ব ছাড়া কোন গণতান্ত্রিক দেশ সম্ভব নয়।”
উচ্চতম আদালতের ক্ষমতার সমর্থকরা বলছেন, ইসরায়েলের মত একটি দেশে যেখানে আনুষ্ঠানিক কোন সংবিধান নেই সেখানে সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য আদালতের ভুমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জনসমর্থন কোন দিকে?
রয়টার্সের এক রিপোর্টে বলা হচ্ছে, সম্প্রতি ইসরায়েল ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউট নামে একটি প্রতিষ্ঠান একটি জরিপের ফল প্রকাশ করেছে । এতে দেখা যায়, বামপন্থী ইসরায়েলিদের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের ওপর আস্থা ডানপন্থীদের তুলনায় বেশি, কিন্তু সার্বিকভাবে আদালতের ক্ষমতা কমানোর পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসমর্থন নেই।
নেতানিয়াহুর পরিকল্পনার তীব্র সমালোচনা করেছেন ইসরায়েলের আইনজীবী ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের নেতারাও। ইসরায়েলের সমাজে ডানপন্থীদের প্রভাব বাড়ছে – এমন কথা বেশ কিছুকাল থেকেই বলে আসছিলেন বিশ্লেষকরা।
সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলো থেকেও এটা স্পষ্ট হচ্ছিল যে ইসরালি সমাজে রাজনৈতিক বিভক্তি বাড়ছে।
বিচারবিভাগ সংক্রান্ত আইন সংস্কারের জন্য যে পরিকল্পনা তুলে ধরেছে ইসরায়েলের উগ্র ডানপন্থী-প্রধান সরকার তাতে এ বিভক্তি আরো প্রকট হবে এটাই মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।