নির্বাচনকে ফোকাসে রাখলেই হতে পারে জাতীয় ঐক্য

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

হারুন উর রশীদ স্বপন ডিডাব্লিউ, ঢাকা

জাতীয় ঐকমত্য গঠন করতে হলে নির্বাচনকেই ফোকাস করতে হবে৷ অন্য কোনো ইস্যুকে সামনে এনে নির্বাচনে বিলম্ব করলে বিভেদ আরো বাড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা৷ তারা বলছেন দ্রুত নির্বাচনের জন্য যে সংস্কার প্রয়োজন আপাতত তাই করা উচিত সরকারের৷

শনিবার বিকলে (১৫ ফেব্রুয়ারি) অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের’ সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলো বৈঠকে বসে৷ কমিশন অন্যান্য স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গেও বৈঠক করবে৷ মূলত ছয়টি কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবকেই সামনে রেখে এই বৈঠক৷ তবে রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত নির্বাচনকে প্রাধান্য দিচ্ছে৷

বৈঠক শেষে সন্ধ্যায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘‘আমরা স্থানীয় সরকারের আগে জাতীয় নির্বাচন চাই৷ সরকার যত দ্রুত নির্বাচনের পথে হাঁটবে তত দ্রুত জাতীয় ঐকমত্য হবে৷ নির্বাচনের জন্য দ্রুত ন্যূনতম সংস্কার করে নিবাচন চাই আমরা৷”

কয়েকটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে৷ আর কোনো কোনো রাজনৈতিক দল আগে সংস্কার, পরে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে৷

প্রধান উপদেষ্টা যা বললেন

প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের শুরুতে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসের প্রথম ইনিংস বা প্রথম অধ্যায় শেষ হয়েছে৷ আজ রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হলো৷ প্রথম অধ্যায় পেরিয়ে দ্বিতীয় অধ্যায়ে সরকারের পদার্পণ হবে আগামীর জন্য নির্দেশনা৷ যেখানে নির্বাচন অয়োজনে থাকবে না কোনো প্রশ্ন৷”

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক বিশ্বের বিশ্বের সমর্থন কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের কাছে গিয়েও কোনো ফায়দা নিতে পারেনি ফ্যাসিস্টরা৷”

‘‘প্রতিজ্ঞা করি আমরা যেন গণঅভ্যুত্থানের যোদ্ধাদের আত্মত্যাগের প্রতি অসম্মান না জানাই৷ যে কারণে তারা আত্মত্যাগ করেছিল সেটা যেন পরবর্তী সব প্রজন্ম মনে রাখে, তাদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে, তাদের আত্মত্যাগকে সার্থক করার জন্য আমরা সবাই মিলে সবরকম চেষ্টা করব, যেন তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারি,” বলেন প্রফেসর ইউনূস৷

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘‘তারা এ ত্যাগ না করলে অনেকের মনে প্রশ্ন থাকলেও জবাব খোঁজার কোনো সুযোগ থাকতো না৷ প্রশ্ন আমাদের মনে যতটুকু ছিল, বহু বছর ধরে ছিল, কিন্তু প্রশ্ন করার সুযোগ পাইনি৷ অসংখ্য ছাত্র-জনতা আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা সেই সুযোগ পেয়েছি৷”

তিনি আরো বলেন, সম্প্রতি জাতিসংঘের প্রতিবেদন এবং বাংলাদেশের প্রতি অ্যামেরিকাসহ সারা বিশ্বের সমর্থনের পর রাষ্ট্র গড়তে না পারা হবে ব্যর্থতা৷

সংলাপ সফল হবে কীভাবে

বিএনপি ও জামায়াতসহ ২৬টি রাজনৈতিক দলের ১০০ জন প্রতিনিধি এই বৈঠকে অংশ নিয়েছেন৷ নানা ইস্যু থাকলেও সবচেয়ে আলোচনায় ছিল জুলাই চার্টার, সংস্কার, গণহত্যার বিচার ও জাতীয় নির্বাচন৷

কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, নির্বাচনকে ফোকাসে রেখে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করতে হলে ঠিক যতটুকু সংস্কার করা প্রয়োজন ততটুকু করলেই জাতীয় ঐক্য হবে৷ আর এই নির্বাচন করতে রাজনৈতিক দলগুলো ঠিক যতটুকু সংস্কার চায় ততটুকু করা দরকার৷ বাকি সংস্কার নির্বাচিত সরকারের হাতে ছেড়ে দিতে হবে৷

রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জাহেদ উর রহমান বলেন, ‘‘গণঅভ্যুত্থানের সুফল নানা কারণে আমরা পাওয়ার জায়গা থেকে সড়ে গেছি৷ পরস্পরের মধ্যে একটা অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে৷ তাই ঐকমত্যের সহজ পথ হলে, সরকার, রাজনৈতিক দল, ছাত্র সবার জায়গা থেকে যদি প্রত্যাশার মাত্রা কমিয়ে আনা যায়৷ এখনও যদি অনেক বড় বড় বিষয় বা ইস্যু নিয়ে আমরা ঐকমত্যের চেষ্টা করি, সেটা বিভেদকে আরো বাড়িয়ে দেবে৷ তারপরে যদি আস্থার সৃষ্টি হয়, ঐকমত্য হয় তাহলে ধীরে ধীরে আরো বড় বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাবে৷”

‘‘আমার মনে হয় এই সময়ে নির্বাচনকে ফোকাসে রাখা উচিত৷ রাষ্ট্রের দীর্ঘ মেয়াদি সংস্কারের যে বিষয়গুলো আছে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে না৷ এই সংস্কার না হলে নির্বাচন করা যাবে না সেটা ভুল৷ একটি ভালো নির্বাচনের জন্য জন্য যা যা করা দরকার তা করলেই হলো৷ সংস্কারের চেয়ে বেশি প্রয়োজন নির্বাচনের সময় পুলিশ বাহিনীর যাতে কনফিডেন্স থাকে তার ব্যবস্থা করা৷”, বলেন তিনি৷

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘বড় বড় সংস্কার করে নির্বাচন করতে হবে এই দাবিগুলো ভেগ৷ গণহত্যার বিচার করে নির্বাচন করতে হবে৷ এখন বিচার কতদিনে করা যাবে, কার বিচার? কতজনের বিচার? এগুলোর জন্য তো বছরের পর বছর লেগে যাবে৷ নানান জন নানা কথা বলছেন৷ প্রত্যেকে তার পলিটিক্যল ইন্টারেস্টের জায়গা থেকে কথা বলছেন৷ যে যার সুবিধা চাইবে, সেটা খারাপ কিছু না৷ কিন্তু নির্বাচন টার্গেট হলে সবার কথায় তো হবে না৷ একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মিনিমাম যেটুক সংস্কার না করলেই নয়, সেটুকু সংস্কার করে নির্বাচন দেয়া দরকার৷ এই বিষয়ে ঐকমত্য হবে বলে আশা করি৷”

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল মনে করেন, ‘‘ঐকমত্যের ফোকাস কী হবে তার চেয়ে আমাদের ভাবা উচিত ঐকমত্য কিসে বাধাগ্রস্ত হবে, তা জানা৷ সেই বিষয়গুলো নিয়ে অযথা আলোচনা না করা৷ এই সরকার নির্বাচিত সরকার না৷ তারা তো চলে যাবে৷ কত সময় থাকবে জানি না৷ তবে নির্বাচিত সরকারের কাছে দ্রুত ক্ষমতা দিয়ে চলে যাওয়াই ভালো৷”

‘‘আসলে এখন মানুষের ভাবনায় জাতীয় নির্বাচন৷ যদি এখন স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে ইস্যু তৈরি করা হয় তাহলে অযথাই সময় নষ্ট হবে৷ নানা সংস্কারের বিষয় আছে৷ কোনোটি দীর্ঘ মেয়াদি, কোনোটি স্বল্প মেয়াদি৷ সংস্কার প্রয়োজন, তবে নির্বাচন প্রয়োজন সবার আগে৷ আর তা করার জন্য যদি আলোচনা হয় তাহলে সেই বিষয়ে ঐকমত্য দ্রুত হবে,” বলেন তিনি৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘‘আসলে নির্বাচন ব্যবস্থাটা নিয়ে ঐকমত্য সবার আগে দরকার৷ সবার একমত হতে হবে, রেজিস্টার্ড দলগুলো কেউ নির্বাচন বর্জন করবে না৷ নির্বাচনে অংশ নেবে৷ সেটা টার্গেট করে আলাপ আলোচনা করলে দ্রুত সমাধানে পৌঁছা যাবে৷ এই সরকারের সামনে অনেক ইস্যু আছে৷ সংস্কারের ইস্যু আছে কিন্তু মূল বিষয় হলে নির্বাচন এবং সেটাকে কেন্দ্র করেই সব কিছু হলে ঐকমত্য হবে৷”

তিনি আরো বলেন, ‘‘তবে এখানে একটি বড় ইস্যু আছে আওয়ামী লীগকে নিয়ে৷ আওয়ামী লীগ কি নির্বাচন করতে পারবে, না পরবে না? তাদের কি নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে দেয়া হবে? এই বিষয়টি নির্বাচনের আগেই সমাধান হওয়া প্রয়োজন৷ এই সিদ্ধান্ত যত দ্রুত নেয়া হবে নির্বাচনও তত দ্রুত করা যাবে৷ আর নির্বাচন সুষ্ঠু করতে কিছু আইন ও বিধি সংস্কার করতে হবে৷ তাতেও বেশি সময় লাগবে না৷ সরকার এই পথে হাঁটলে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন সম্ভব৷ আর দরকার হলে এই সময়ের মধ্যে কিছু সংস্কারও করা যাবে৷”

এদিকে, সংলাপ শুরুর আগে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘‘জুলাই চার্টারের ওপর নির্ভর করবে আমাদের নির্বাচনটা কবে হবে৷” তিনি বলেন, ‘‘এরই মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে৷ সেক্ষেত্রে আমরা হয়তো কিছু সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারব৷ আর পরে যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে, তারা বাকিগুলো বাস্তবায়ন করবে৷”

গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি করে সাত সদস্যের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার৷ সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজকে এই কমিশনের সহ সভাপতি করা হয়েছে৷ অন্যান্য কমিশনের প্রধানরা এই কমিশনের সদস্য৷

বৈঠকে কমিশন আগামী নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনগুলোর সুপারিশগুলো আলেচনায় রেখেছে৷ কমিশন জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য রাজনৈতিক দলো ও শক্তিগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *