একুশ শতকে চিন্তার পরিসরে ত্বহা আবদুর রহমান এমন এক নাম, যাকে মৌলিকত্ব ও প্রভাবক ক্ষমতার কারণে অগ্রগণ্য অবস্থান দিতে হয়। মরক্কোর এ দার্শনিক যুক্তিবিদ্যা, ভাষাদর্শন, নীতিদর্শন ও ন্যায়তত্ত্বে সমকালীন দুনিয়ার পণ্ডিতি দৃষ্টি ও আগ্রহকে নিজের দিকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। ইসলামের নৈতিক বুনিয়াদি শিক্ষা ও মূল্যবোধের প্রদীপায়নের মাধ্যমে একটি আধুনিক, নৈতিক মানবতাবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার পথ নির্মাণে তিনি সক্রিয়। আরবরা তাকে ফকিহুল ফালসাফা বা দর্শনের আইনজ্ঞ হিসেবে উপস্থাপন করেন।
১৯৪৪ সালের ২৮ মে তার জন্ম হয় মরক্কোর আল জাদিদা শহরে। সেখানেই প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে কাসাব্লাঙ্কায় মাধ্যমিক পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। রাবাতে পঞ্চম মুহাম্মদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে ডিগ্রি নিয়ে ফ্রান্সের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং দর্শনে আরেকটি ডিগ্রি লাভ করেন। পিএইচডি সম্পন্ন করেন ১৯৭২ সালে।
তার থিসিসের শিরোনাম ছিল Language and philosophy: a study of the linguistic structures of ontology| ১৯৮৫ সালে সম্পন্ন করেন আরেকটি ডক্টরেট। এর বিষয় ছিল study of argumentation and its methods।
রাবাতের পঞ্চম মুহাম্মদ বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্তিবিদ্যা ও ভাষাদর্শনের শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত হন ১৯৭০ সালে। ২০০৫ সালে সেখান থেকে গ্রহণ করেন অবসর। তিনি মরক্কোর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর এবং বিখ্যাত থিংট্যাংক সার্কেল ফর থিংকার্স অ্যান্ড রিসার্চার্স-এর সভাপতি। ইসলামী দর্শনে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ÔISESCO পুরস্কারে সম্মানিত হন ২০০৬ সালে।
ত্বোহা আবদুর রহমানের দার্শনিক প্রকল্পকে তিনটি স্রোতে ভাগ করা যেতে পারে। এ বিভাজন কালগত নয়, যুক্তিগত। প্রথমত তিনি সাধারণ দর্শন, আধুনিকতাবাদ ও পশ্চিমা চিন্তার মধ্যকার পরিচয় ও সম্পর্ক উন্মোচন করেন। তিনি প্রতিটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতির জন্য নিজস্ব দর্শনের পক্ষে ওকালতি করেন, নিজস্ব আধুনিকতার পথের প্রস্তাব করেন। এটি কিভাবে সম্ভব হবে, তার বয়ান খোলাসা করেন।
দ্বিতীয়ত, একটি জীবন্ত অভিজ্ঞতা হিসেবে নৈতিকতাকে আধুনিকতার সাথে সংযুক্ত করেন। তাত্ত্বিক চিন্তা হিসেবে এবং নৈতিক জীবন যাপনের অভিজ্ঞতা হিসেবে একে দেন প্রতিষ্ঠা। উভয়েই সমান মাত্রায় মুখর হয়ে ওঠে ত্বোহার জবানীতে।
তৃতীয়ত, নৈতিক অভিজ্ঞতার ধারণা এবং ইসলাম ধর্মের মৌলিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের সহাবস্থানের বয়ান। পবিত্র কুরআন উপলব্ধির একটি বিশেষ প্রক্রিয়া ও বিবেচনাকে অবলম্বন করে যা অগ্রসর হয়। আল কুরআনে নিহিত মানবতাবাদ একটি বিশিষ্ট ও ঐতিহ্যলগ্ন ভঙ্গিমায় উপস্থাপিত হয় ত্বোহার ভাষ্যে।
আবদুর রহমানের দার্শনিকতার প্রথম ধাপ দ্বিতীয় ধাপকে যৌক্তিকভাবে আহ্বান করে। কেননা তাত্ত্বিক চিন্তাকে বাস্তব নৈতিক কার্যকলাপ থেকে আলাদা করা অযৌক্তিক। দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় স্থানান্তরটি আদর্শিক, যা একটি বিশ্বাসের প্রতি অঙ্গীকার। ইসলামী নৈতিক ব্যবস্থার প্রতি তার অগ্রসর হবার কারণ এ ব্যবস্থার সম্পূর্ণতা। জীবনকে সে সামগ্রিকভাবে দেখে ও দেখায়। জীবন সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি নৈতিক ও মানবিক অভিজ্ঞতার যে সামগ্রিকতা গড়ে দেয়, সেটা ত্বোহার বয়ানে বিশেষ মাত্রা লাভ করে।
অন্য দিক থেকে আধুনিকতাবাদী পশ্চিমা চিন্তাধারার সমালোচনা করেন ত্বোহা। সমালোচনা করেন তার সত্য ও নৈতিক ভিত্তির অভাবের কারণে, তার নৈতিক নীতির পর্যাপ্ত তত্ত্বে অনুপস্থিতির কারণে। ফলে প্রাচীন ও আধুনিক ইসলামী চিন্তাধারার সমন্বয়ে একটি আধুনিকতাবাদী নৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রকল্প গ্রহণ করেন ত্বোহা। যা আধুনিক দুনিয়ার নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ঘাটতি পূরণের দায়িত্ব গ্রহণ করে।
ত্বোহা আবদুর রহমানের চিন্তার বিশেষ দিক হলো ‘মাল্টিপল মডার্নিটিস’। পশ্চিমের বাইরের দুনিয়াকে তিনি পরামর্শ দেন যেন তারা পশ্চিমা আধুনিকতার নিছক ভার বহনকারী না হয়। পশ্চিমা উপযোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিকতাকে যেভাবে রফতানি করেছে দুনিয়াজুড়ে, সেই রফতানি কি জাতিসমূহের স্বাতন্ত্র্য বা সৌন্দর্যের প্রতিনিধিত্ব করে? জাতিসমূহের নিজেদের জিনিসকে উদযাপন করা কি গুরুত্বপূর্ণ নয়? বাস্তবতা ও আত্মার মধ্যে কি দেয়াল তোলা উচিত? আত্মা আসলে কী, সে কোন নীতি, মূল্যবোধ ও বাস্তবতা কামনা করে? ত্বোহা এসব প্রশ্ন জোরালোভাবে তোলেন ও এর মীমাংসার দিশা হাজির করেন। এসব জায়গায় বহু সঙ্কট এমন, যার স্রষ্টা হচ্ছে আধুনিকতা।
তার মতে, আধুনিকতা কোনো বাস্তবতা নয়, এ হচ্ছে এক মূল্যবোধ। যদিও আধুনিক বাস্তবতা বিদ্যমান, যার সংস্পর্শে আমরা আছি বা থাকি, যার প্রতিলিপি আমরা তৈরি করি, তবুও সে এমন কোনো বাস্তবতা নয়, যা অবধারিত। কারণ বিদ্যমান বাস্তবতা এমন নয়, যার ফলে আধুনিকতাবাদে আমাদেরকে দীক্ষিত হতে হবে। বরং আমাদের যা উচিত, তা হলো নিজস্ব নীতি ও মূল্যবোধের সন্ধান করা এবং তাকে বাস্তবতায় পরিণত করা।
কিন্তু এ জন্য দরকার পশ্চিমা আধুনিক সভ্যতার ওপর তদন্ত চালানো, তার যুক্তিসম্পদের দুর্বলতা ও সত্যনির্দেশে তার দিশেহীনতার উন্মোচন। পশ্চিমা সভ্যতা ও যুক্তিধারা নৈতিক নীতিমালার প্রশ্নে দরিদ্র। যার ফলে অবধারিত হয় তিনটি ক্ষতি, যা মানুষের নৈতিক সত্তাকে করে রুগ্ণ, আহত। প্রথমটি হচ্ছে : the harm of siege, যা মানুষের নৈতিক আইনকে সীমিত ও সঙ্কীর্ণ করে দিয়েছে। দ্বিতীয়টি হলো the harm of freeze, যা নৈতিক বোধকে অনেকটা হিমায়িত করে দিয়েছে, জীবনের মূল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একে করেছে বিচ্ছিন্ন। তৃতীয়টি হলো the harm of reduction, যা নৈতিক আইনকে নানা দিক থেকে করেছে প্রত্যাখ্যান।
এই যে তিন ধারা, তা যুক্তিবাদী সভ্যতার কাছ থেকে শক্তি লাভ করেছে। ফলে যে নৈতিকতা ছাড়া মানুষের সারাংশকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না, তাকে করা হয়েছে সীমাবদ্ধ, বিচ্ছিন্ন ও প্রত্যাখ্যাত। এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয় মানুষের প্রশ্নে পশ্চিমা যুক্তিবাদের গুরুতর অন্যায় অবস্থান। কিন্তু এ অন্যায়কে মানুষের কাঁধে, মনে ও মাথায় চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে মানুষের উচিত নিজেদের উপরে চাপিয়ে দেয়া এই অন্যায় প্রত্যাখ্যান করা এবং নিজেদের প্রকৃত পরিচয় পুনরুদ্ধার করা।
কিন্তু এ পথে সমসাময়িক ইসলামী চিন্তাধারায় তত্ত্বের অভাব একটি সাধারণ সঙ্কটে পরিণত হয়েছে। ধর্মীয় পুনরুত্থানের যে দশকসমূহে মুসলিম দুনিয়া প্রবেশ করে, তা জন্ম দিয়েছে নানা অস্থিরতা। এ পুনরুত্থানের প্রবক্তা ও বিরোধীদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া। এসব পুনরুত্থান চেষ্টার আবেদন রয়েছে অনেক, জনগণের মধ্যে এর প্রতি সাড়াও কম নয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় তাত্ত্বিক ভিত্তির প্রশ্নে এসব প্রয়াস নিতান্তই পক্ষাঘাতগ্রস্ত। এর তাত্ত্বিকদের মধ্যে যেভাবে পাওয়া যায় না সম্পূর্ণ পদ্ধতিগত কোনো কাঠামো, তেমনি এতে অনুপস্থিত থেকে যায় উৎপাদনশীল বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বা প্রতিষ্ঠিত দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি।
এ প্রেক্ষাপটে ত্বোহা আবদুর রহমান নতুন প্রবর্তিত তত্ত্বগুলোর সূচনাবিন্দু খুঁজে পান। পশ্চিমা অর্থে যুক্তির সীমাবদ্ধতাকে সামনে আনেন এবং সীমার পেছনে অনুসন্ধানের মাধ্যমে দেখান এ থেকে বের হওয়ার উপায়। তার দার্শনিক প্রকৃতি তাকে সত্যের সন্ধান করতে বাধ্য করে। যদিও সেই সত্য প্রচলিত যুক্তির সীমার বাইরে অবস্থান করে।
অনুসন্ধানকে তাই প্রসারিত করার প্রস্তাব দেন ত্বোহা। তিনি তালাশ করেন লজিকের সীমাবদ্ধতার পেছনে কী আছে? একে বের করার জন্য তিনি অবলম্বন করেন বিকল্প পথ। ভাষাদর্শনের ওপর আপন অধিকার দিয়ে তিনি প্রমাণ করেন আমরা যাকে যে ভাষায় প্রকাশ করি, সে হলো লিমিট বা সীমিতর ভাষা। যুক্তির ভাষাও এটাই। ফলে তার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রমের জন্য প্রয়োজন চিহ্নের ভাষা, প্রামাণিক ইশারা ও অনেক বলতে পারা রূপক, যা যুক্তির সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে পারে।
ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং নীতিশাস্ত্রকেও তিনি যুক্তির সীমাবদ্ধতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন। মানবতাবাদী জীবনাদর্শ হিসেবে ইসলামের কাছেও যুক্তি আপন সীমাবদ্ধতাসহ স্বীকৃত হয়। এখানে তার সীমাবদ্ধতার পূর্ণ রূপ ধরা পড়ে। ফলে সীমাবদ্ধ পশ্চিমা যুক্তির হাতে নিজেদের সঁপে না দিয়ে প্রয়োজন এক নৈতিক ইসলামী তত্ত¡ নির্মাণ, যা পশ্চিমা সভ্যতার অ-নৈতিক অবস্থানের মোকাবেলা করতে সক্ষম। অন্যান্য অ-ধর্মীয় ও অ-ইসলামী তত্ত্বের ব্যর্থতার সমাধিভূমি অতিক্রম করে যার বাস্তবতা প্রতিষ্ঠিত হবে।
সিদ্ধান্তের এ জায়গায় আসার জন্য ত্বোহা মূলত আনুষ্ঠানিক যুক্তির ওপর নির্ভর করেন। পদ্ধতিগত কারণেই তিনি সমকালীন আরব চিন্তায় শ্রেষ্ঠতম যুক্তিবিদ। প্রথমে দার্শনিক পরিভাষা ও জটিলতার মোকাবেলা করেন তিনি, তারপর আলোচ্য বিষয়ের যৌক্তিক বিভাজন করেন, তারপর বিবেচনাধীন বিষয়গুলো প্রমাণ করার জন্য উপস্থাপন করেন যৌক্তিক অনুমান। অন্যান্য বিবেচনাসমূহের ন্যায্য সমালোচনা ও কর্তনের কাজ করেই উপসংহারে উপনীত হন তিনি।
আপন আলোচনায় তিনি সচেতন থাকেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত চিন্তা ও বিবেচনাসমূহের প্রতি। এর পাশাপাশি যুক্তিবিদ্যা, গণিত এবং বিজ্ঞানের দর্শনের সীমার সাপেক্ষে সমসাময়িক দার্শনিক চিন্তা কোথায় পৌঁছেছে, সে সম্পর্কে থাকেন সচেতন। বিষয়বস্তুর বিভাজনে আনুষ্ঠানিক যুক্তিবিদ্যার কেন্দ্রীয় ও স্বতঃসিদ্ধ নিয়মের দৃঢ় অনুবর্তিতা রক্ষা করেন। তার পদ্ধতি তাই প্রধান তিনটি স্তরের মধ্য দিয়ে বিকশিত। তিনি প্রথমত মুখোমুখি হন পরিভাষা-প্রশ্নের, দ্বিতীয়ত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞানের সীমার প্রশ্নের, তৃতীয়ত বিষয়বস্তুর বিভাজন প্রশ্নের। জ্ঞানপ্রাজ্ঞ ও যৌক্তিক অবতারণার মধ্য দিয়ে তিনি ধাপগুলো উৎরান।
পরিভাষা প্রশ্নে ত্বোহা ইসলামী ঐতিহ্যের প্রতি বরাবরই বিনীত। কোনো পরিভাষা যেন উদ্দেশ্যমূলক বিকৃতি বা স্থানচ্যুতির শিকার না হয়, ত্বোহা এ ব্যাপারে দায়িত্ববান। ধ্রুপদী ইসলামিক বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের শর্তাবলীর প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল থেকেছেন এবং এর বাস্তবায়নের জন্য দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করেছেন।
সমসাময়িক ইসলামিক চিন্তাধারায় আক্ষরিকতা স্থবিরতাকে স্থায়ী রূপ দিতে চেষ্টা করছে। ফলে সালাফিয়তকে তিনি তিরস্কার করেছেন। আক্ষরিকতার ফলে চিন্তকরা দর্শনে সৃজনশীলতা রোজগারের অনুশীলন থেকে বিরত থাকছেন। সমসাময়িক মুসলিম চিন্তাধারার আরেকটি ধারা পশ্চিমা আধুনিকতাকে অনুলিপি করছে নিজেকে প্রকাশ করার জন্য। বস্তুত এর মধ্য দিয়ে সে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না। যা প্রকাশ করে, সেখানে নিজের কিছু থাকে না। ত্বোহার মতে, মুসলিম চিন্তকদের উচিত মুসলমানী এক আধুনিকতা খুঁজে নেওয়া। মুসলিমদের নিজস্ব জীবনধারার ওপর ভিত্তি করে শিল্প, প্রযুক্তি, দর্শন ও বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে এটা হতে পারে।
নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে উদ্ভূত শর্তাবলির ওপর নির্ভর করা যেমন জরুরি, তেমনি এর সাপেক্ষে নতুন শর্তাদি তৈরি করাও আবশ্যক। ত্বোহা এই জরুরতকে কবুল করেন এবং তার সমগ্র দার্শনিক রচনাজুড়ে ‘সৃজনশীল’ চিন্তাধারার চাহিদা পূরণের জন্য নতুন টার্ম তিনি প্রবর্তন করেন ও তা ব্যবহার করেন। এমনতরো কাজের নমুনা হতে পারে তার কারণতত্ত্ব। কারণের সীমার ধারণাকে তিনি নবায়ন করেন। ‘কারণ’ ধারণাটিকে তিনি প্রসারিত করেন সাধারণ অর্থে বিমূর্ত কারণকে অতিক্রম করার জন্য। এর বদলে দেখান, যৌক্তিকতার তিনটি স্তর রয়েছে; তাত্ত্বিক চিন্তাধারায় যৌক্তিকতা (বিমূর্ত কারণ), কর্মের যৌক্তিকতা (নির্দেশিত কারণ) এবং মৌলিক বিশ্বাস (সমর্থিত কারণ) অর্জনে যৌক্তিকতা।
বিষয়বস্তু বিভাজনের ধারায় তিনি যুক্তিবাদ ও নীতিশাস্ত্রকে সমন্বিত করে পথ নির্মাণ করেন। ফলে তার প্রকাশপ্রকরণে থাকে বহুমাত্রা ও বহুরৈখিকতার বস্তুনিষ্ঠ সমন্বয়ের শৃঙ্খলা। ধর্মের ভাষ্যসমূহ এবং নৈতিক মূল্যবোধকে বিচ্ছিন্ন হিসেবে দেখার চেষ্টাকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। প্রতিটি বিভাজনের ক্ষেত্রে তিনি সতর্ক। এতদিন যেসব বিভাজন মেনে নেওয়া হতো, আজ তা সন্দেহজনক হয়ে উঠছে।
the Question of Ethics গ্রন্থে ত্বোহা দেখান আধুনিক পশ্চিমা জ্ঞানবিত্ত্বিক কাঠামো সপ্তদশ শতাব্দীতে শুরু হওয়ার পর থেকে দুটি মৌলিক ধারণার উপর নির্ভর করে। একটি হলো বিজ্ঞানে কোনো নীতিশাস্ত্র নেই। আরেকটি হলো ‘মনের পিছনে কোনো জ্ঞান নেই’। এই যে ভাগ করা, সেটা অসম্পূর্ণ বিভাজন পদ্ধতি ব্যবহারের খেসারত। এর ফলে তিনি দেখেন অন্য একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রবর্তনের সম্ভাবনা।
বৈজ্ঞানিক যৌক্তিকতার সাথে তিনি পশ্চিমা আধুনিকতার সমালোচনা করেছেন এবং ‘প্রকৃতির উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ’ এর ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছেন। একে তিনি দায়ী করেন নীতিশাস্ত্রের ক্ষতির জন্য। ধর্মীয় নৈতিকতাকে সে প্রকৃতিবাদী বিকল্প দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে চায়। ধর্মীয় নীতিশাস্ত্রকে নির্বাসিত করার ফলে যে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হয়, তা মানবতাকে শিগগিরই বা একটু পরে দুর্ভাগ্যের শেষ সীমায় টেনে নেবে। বস্তুত প্রকৃতির ওপর নিয়ন্ত্রণের নামে প্রকৃতির বিনাশই ত্বরান্বিত হচ্ছে এবং এ গ্রহকে করে তোলা হচ্ছে জীবনযাপনের জন্য বিপজ্জনক। যা সবার সামনে পরিষ্কার।
কিন্তু সমস্যা এটাই নয়। মূল সমস্যা হলো, মানুষ নৈতিক ভিত্তিভূমি হারিয়ে ক্রমেই হয়ে উঠছে না-মানুষ। চিন্তাবিদ ও দার্শনিকদের তাই এই ভুলের সংশোধন করতে হবে। কিন্তু কী দিয়ে হবে সেই সংশোধন? ত্বোহা আবদুর রহমান বলেন, পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান বিকারের প্রতিষেধক হলো ‘প্রভুর আনুগত্যের’ নৈতিক ধারণায় আত্মসমর্পণ। যেহেতু এই তত্ত্ব প্রকৃতির প্রকৃত মালিকের আনুগত্যের ধারণার পক্ষে এবং প্রকৃতিকে বশীভূত করার ধারণার বিপক্ষে, তাই আমরা একে আনুগত্যতত্ত্ব বলতে পারি।
ত্বোহা দেখান, বৈজ্ঞানিক বা প্রযুক্তিগত ব্যবস্থার মোকাবেলায় বাস্তবায়নযোগ্য যে তত্ত্বটির দিকে তিনি আহ্বান করছেন, সেটা বৈজ্ঞানিক সিস্টেমের ক্রমাগত বিবর্তনে এই সিস্টেমের নেতিবাচক প্রভাবগুলোকে বিলুপ্ত করতে সক্ষম। একে বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে তার দার্শনিক প্রকল্প পৃথিবীর জন্য একটি ব্যবহারিক নৈতিক বিকল্প সড়ক রচনা করে সমকালীন প্রজ্ঞার মাতৃভাষায়!
লেখক : কবি, গবেষক
71.alhafij@gmail.com