মুঘল সম্রাট শাহজাহানের ভালোবাসার প্রতীক হয়ে ৪০০ বছর ধরে ভারতের আগ্রায় দাঁড়িয়ে আছে তাজমহল। এটি সম্রাট শাহজাহানের এক অমর সৃষ্টি। পৃথিবী জুড়ে তাজমহল ভালোবাসার একটি অপরূপ নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত। আরজুমান্দ বানু বেগম মমতাজ ছিলেন শাহজাহানের তৃতীয় স্ত্রী। ১৬৩১ সালে ৩৯ বছর বয়সে ১৪ তম সন্তান জন্মের সময় মমতাজের মৃত্যু হয়। প্রিয় পত্নীর স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার উদ্দেশ্যে তার সমাধিকে ঘিরে সম্রাট শাহজাহান তাজমহল নির্মাণ করেন। ২২ বছর ধরে ২০ হাজার শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরি হয় ঐতিহাসিক এই সমাধিস্তম্ভ। তাজমহল ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ও বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একটি।
ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও তাজমহলের অনেক তথ্য মানুষের আজও অজানা। একনজরে জেনে নিন সেগুলো। প্রতিষ্ঠার পর আজ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে এক রহস্যের বেড়াজালে নিজেকে আবৃত করে রেখেছে এই ঐতিহাসিক স্থাপনা। চলুন জেনে নেওয়া যাক অসাধারণ এই স্থাপত্য এবং রহস্যময়ী তাজমহল এর অজানা ইতিহাস সম্পর্কে। যা আপনাকে অবাক করে দেবে।
১. মুঘল সম্রাট শাহজাহানের তৃতীয় স্ত্রী ছিলেন মুমতাজ মহল। বিয়ের আগে তার নাম ছিল আর্জুমান্দ বানো বেগম।
২. শাহজাহানের ১৪তম সন্তান জন্মদানের সময় ইন্তেকাল করেন মুমতাজ মহল।
৩. মমতাজের মৃত্যুর পরপরই তাজমহলের নির্মাণ কাজে হাত দেয়া হয় নাই। মৃত্যুর পর তাঁর দেহ আগ্রার একটা জায়গায় রাখা হয়। সেখানে সযত্নে বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে দীর্ঘ ৯ মাস রাখবার পর এখন যেখানে তাজমহল নির্মাণ করা হয়েছে, সেখানে আনা হয়।
৪. তাজমহলের ভেতর ও বাহিরের ক্যালিগ্রাফির চমৎকার কাজ আছে। মমতাজ মহলের সমাধি ক্ষেত্রেও তাঁর পরিচিতি ও প্রশংসার শিলালিপি দেখা যায়। সমাধিক্ষেত্রের একপাশে আল্লাহর ৯৯টি নাম ক্যালিগ্রাফিক শিলালিপিতে অঙ্কিত আছে।
৫. তাজমহল নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করতে কাজে লাগানো হয় প্রায় একহাজার হাতি।
৬. তাজমহল নির্মাণের উপকরণ আনা হয়েছিল ভারতের পাঞ্জাব, রাজস্থান, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, চীন, তিব্বত ও আরব দেশ থেকে।
৭. তাজমহলের গায়ে রয়েছে ২৮ ধরনের মূল্যবান রত্নের সমাবেশ।
৮. দিনের বিভিন্ন সময় এবং পূর্ণিমা রাতে তাজমহল নানান রঙ ধারণ করে। ভোরের আলোয় এক হালকা গোলাপীর মূর্ছনায় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে তাজমহল। সন্ধ্যার এটি দুধভরা সাদা দেখায়। চাঁদনি রাতে একটি হালকা নীল রঙের আভায় এক মনোমুগ্ধকর রূপ নেয়। এই পরিবর্তনগুলো তাজমহলকে দিয়েছে অনন্য এক বৈচিত্র্য।
৯. তাজমহল কমপ্লেক্সে ঘোরাঘুরির সময় দেয়ালের পুরোটা জুড়ে কোরআনের বিভিন্ন আয়াত চোখে পড়বে।
১০. জনশ্রুতি রয়েছে, তাজমহল নির্মাণের পর যাতে এর মতো আর কোনো সুন্দর স্থাপনা নির্মাণ করতে না পারে, সে কারণে সব শ্রমিকের হাত কেটে ফেলার নির্দেশ দেন সম্রাট। এছাড়া তাজমহলের মতোই আরেকটি সমাধি এর বিপরীত পাশে নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন সম্রাট শাহজাহান কালো মার্বেল দিয়ে। কিন্তু ক্ষমতাচুত্য হওয়ায় সেটি আর সম্ভব হয়নি। কিন্তু এ বিষয়ে দু’টির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
১১. কথিত আছে, পত্নীর বিয়োগে শোকার্ত সম্রাট টানা দু’বছর রাজদরবারে শোক পালন করেছিলেন। শাহজাহান শোকে এমন মুহ্যমান হয়ে গিয়েছিলেন যে, কয়েক মাসের মধ্যে তাঁর দাড়ি ও চুল ধবধবে সাদা হয়ে যায়। কারণ, ১৯ বছরকাল সুখে-দুঃখে স্বামী সম্রাট শাহজাহানের ঘর সংসার করেছেন মমতাজ।
১২. তাজমহলের নক্শা প্রথমে কাঠের ছাঁচে তৈরি করা হয়েছিল। ভারতবর্ষের বাইরে থেকেও ভাষ্কর্য্য শিল্পে দক্ষ একাধিক গুণি ব্যক্তিদের তাজমহলের নির্মাণ কাজে নিযুক্ত করা হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায় সর্বমোট ১৫জন নির্মাণবিদ তাজমহল তৈরিতে সক্রিয়ভাবে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন।
১৩. তাজমহলের প্রধান নকশাকার ছিলেন ওস্তাদ আহমেদ লাহুরি, আবদুল করিম মামুর খান এবং মাকরামাত খান যারা সে সময়ের সবচেয়ে নিখুঁত, পারদর্শী, উচ্চ পর্যায়ের প্রকৌশলী ও নকশাকার ছিলেন। এছাড়া তাজমহলের বিখ্যাত ক্যালিওগ্রাফিগুলো করেছিলেন তৎকালের ক্যালিওগ্রাফার আবদুল হক, যার প্রশংসনীয় ক্যলিওগ্রাফি দেখে মুগ্ধ হয়ে সম্রাট নিজেই তাকে ‘আমানত খান’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
১৪. স্থাপত্য কীর্তি পৃথিবীতে বহু আছে কিন্তু পৃথিবীর অন্য কোন স্থাপত্য তাজমহলের অনূরূপ খ্যাতি লাভ করতে পারে নাই। এর জন্য সম্রাট শাহজাহানকে অনেক বিনিদ্র রজনী যাপন করতে হয়েছে। সমগ্র পৃথিবী তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফিরেছেন সম্রাটের লোকজন সর্বোৎকৃষ্ট মহার্ঘ্য পাথরের সন্ধানে।
১৫. প্রচুর সাদা মার্বেল পাথর নিয়ে আসা হয়েছিল জয়পুরের মাকরানা আর রাইওয়ালা থেকে। লাল বেলে পাথর আনা হয়েছিল ফতেপুর সিক্রি থেকে। এছাড়া বাগদাদ, ইয়ামেন, গ্রান্ড তিব্বত, সিংহল, কানাডা, দক্ষিণ ভারত, মিশরের নীল নদ, গঙ্গা, গোয়ালিয়র, পারস্য, কুমায়ুন, মহারাষ্ট্র, জেহেরী, মাকরাণ, খামাচ, বিন্ধ্যাচল পর্বত, জব্বলপুর, রাজস্থান, হিমাচল থেকে সমতল, বাংলার সন্দীপ, মহেশখালী দ্বীপ- তাঁর দৃষ্টি থেকে কিছুই বাদ পড়েনি। সর্বসাকুল্যে ১৭হাজার মন পাথর সংগৃহীত হয়েছিল।
১৬. তাজমহলে মহামূল্যবান চুনি ছিল- ৬০ মন, পান্না- ১০০ মন, নীলকান্ত মণি- ১৬০ মন, নানান রঙের সংমিশ্রনে তৈরি উজ্জ্বল মণি- ১৮০মন, ফিরোজা রঙের মণি- ৯০ মন, গোয়ালিওর স্টোন- ৯৯০ মন, উজ্জ্বল দূ্যতিময় পাথর- ৮০ মন, চুম্বক লোহার আকর – ৮০ মন এছাড়া আরও ২৩০ মন মহামূল্যবান মণি এবং খাঁদ বিহীন স্বর্ণের বার ছিল আনুমানিক ২০০ মন। আজ থেকে সাড়ে ৩শত বছর আগে সম্রাট শাহজাহান মন মন স্বর্ণ, হীরা, চূনি, পান্না, মণি-মানিক্য সংগ্রহ করে সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্য তাজমহলে লাগিয়ে ছিলেন।
১৭. পুরো তাজমহল ১৮০ ফুট উঁচু যার প্রধান গম্বুজটি ২১৩ ফুট উঁচু এবং ৬০ ফুট চওড়া এবং এর চারপাশে চারটি মিনার আছে যার প্রতিটির উচ্চতা ১৬২.৫ ফুট। পুরো কমপ্লেক্সটির আকার ১৯০২ বাই ১০০২ ফুট। শুধু তাজমহলটি ১৮৬ বাই ১৮৬ ফুট মার্বেল পাথরের ওপর নির্মিত। এর প্রধান প্রবেশদ্বার ১৫১ বাই ১১৭ ফুট চওড়া এবং ১০০ ফুট উঁচু।
১৮. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমারু বিমানের হাত থেকে রক্ষা করতে তাজমহলের উপরে বাঁশের খাঁচা দেয়া হয়েছিল। ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ও নাইন ইলেভেনের পর বিমান হামলার হাত থেকে তাজমহল রক্ষায় সবুজ আচ্ছাদন ব্যবহার করা হয়।
১৯. এটি নির্মাণ করতে সুদক্ষ ২০ হাজার শ্রমিকের ২২ বছর সময় লেগেছিল। তাজমহল নির্মাণের জন্য সম্রাট ২২ হাজার মানুষ নিযুক্ত করেন, যারা ছিলেন শ্রমিক, স্টোনকাটার, চিত্রশিল্পী, সূচিকর্মশিল্পী ও ক্যালিগ্রাফার। নির্মাণ সামগ্রী বহনের জন্য ১০০০ হাতি ব্যবহার করা হয়েছিলো।
২০. বর্তমানে তাজমহল বাগান, গেস্টহাউজ ও মসজিদ দিয়ে ঘেরা ১৭ হেক্টর জায়গা নিয়ে গঠিত। সম্রাট শাহজাহান যমুনা নদীতে বসে তাঁর এই স্বপ্নের সমাধীটিকে দেখতেন। বর্তমানে নদীটি শুষ্ক হয়ে গেছে।
২১. তাজমহলে একটি সুড়ঙ্গ রয়েছে যা যমুনা নদীর ধার থেকে শুরু হয়ে তাজমহল গিয়ে শেষ হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই সুড়ঙ্গটি সম্রাট শাহজাহান যমুনা নদীর ধার থেকে তাজমহলে আসার জন্যে ব্যবহার করতেন।
২২. তাজমহলের প্রবেশ পথটি লাল বেলে পাথরে তৈরি। এটি প্রায় ১০০ ফুট উঁচু। তোরণে আরবি হরফে উৎকীর্ণ রয়েছে কোরআনের বাণী। ১৮৭ ফুট উঁচু মূল মিনারটি রয়েছে ৬০ ফুট ব্যাসের জায়গা জুড়ে। মূল মিনারের চারপাশে রয়েছে ছোট ছোট মিনার। এগুলোর উচ্চতা ১০৮ ফুট।
২৩. তাজমহলের নির্মাণ শৈলীতে আরেকটি রহস্যময় দিক হলো- যখন আপনি তার দিকে এগুবেন, মনে হবে সেটি আকারে ছোট হচ্ছে। আর যখন দূরে সরে আসবেন, মনে হবে বড় হচ্ছে। তাই গাইডরা বলেন, এতে তাজমহলকে নিজের মনে করার অনুভূতি জাগে।
২৪. মোঘলদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে তাজমহলের প্রতি নেমে আসে দুর্যোগ। আসল মনিমুক্তা, স্বর্ণ তাজমহলের গাত্রে এখন আর নেই। একদিকে বাগান ধ্বংস করা হয়, অন্যদিকে পানি প্রবাহের স্থাপনাগুলো নষ্ট করা হয়। আরেক দিকে চলে অবাধ লুন্ঠন।
২৫. স্থাপত্যের জনক হিসেবে খ্যাত সম্রাট শাহজাহান জগত বিখ্যাত আগ্রার তাজমহল ছাড়াও আরও যেসব শিল্পকর্ম তৈরি করে ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মতি মসজিদ, দিল্লির জুমা মসজিদ, ময়ূর সিংহাসন, আগ্রার খাসমহল, শীশ মহল, দিলি্লর দিওয়ান-ই-আম, দিওয়ান-ই-খাস এবং দিলি্লর উপকন্ঠে শাহজাহানাবাদ নগরী প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য কীর্তি। ১৬২৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ছিল সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকাল।
২৬. কথিত আছে, সম্রাট শাহজাহানের শেষ জীবনে তার ছেলে আওরঙ্গজেব তাকে আগ্রার দুর্গে বন্দী করে রেখেছেন। দুর্গের জানালা দিয়ে দূর থেকে তাজমহল দেখতে দেখতে সেখানেই মারা যান শাহজাহান। ১৬৬৬ সালে মৃত্যুর পর শাহজাহানকেও স্ত্রী মমতাজের পাশে সমাহিত করা হয়।
২৭. ১৯৮৪ সালের পর থেকে মূল সমাধিতে আর কাউকেই ঢুকতে দেয়া হয়না। এই সমাধির ওপর তলায় বানানো হয়েছে ঠিক একই রকমের আরেকটি নকল সমাধি। পর্যটকরা এই নকল সমাধি দেখার সুযোগ পান।
২৮. তাজমহলেরও প্রতিলিপি আছে! এগুলো হলো মহারাষ্ট্রের আওরঙ্গবাদে গড়ে তোলা ‘বিবি কা মাকবারা’ ও বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত ‘তাজমহল’। তবে আগ্রার তাজমহলের মতো চোখধাঁধানো নয় একটিও।
আরও পড়ুন
দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ছে মাঙ্কিপক্স; প্রয়োজন সতর্কতা
দেহকে সুস্থ রাখবে অ্যালোভেরা
বসন্তের বাতাসে অ্যালার্জির প্রবণতা, একটু গাফিলতি হলেই মারাত্মক বিপদ
রাসূল সা: প্রবর্তিত খাদ্যবিজ্ঞান । ডা: মো: তৌহিদ হোসাইন
তরমুজের উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ
যে খাবারে শিশুর উচ্চতা বাড়ে
ইন্ডাস্ট্রির সকলের স্বার্থে কপিরাইটের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিঃ ফাহিম ফয়সাল
অতিরিক্ত আবেগ মনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে
আক্ষেপ প্রকাশ করলেন ‘ছুটির ঘণ্টা’র নির্মাতার মেয়ে বিন্দি
ওজন কমাতে সাহায্য করে যে সকল খাবার