রিদওয়ান আক্রাম
প্রথম মোগল সম্রাট বাবর এবং তার ছেলে হুমায়ুন সেভাবে ঈদ উদযাপন করতে না পারলেও সম্রাট আকবরের থেকে ঈদ উৎসব হিসেবে পালনটা একটা রেওয়াজে দাঁড়িয়ে যায়৷ সেই ধারাবাহিকতা মোগল সাম্রাজ্যের শেষদিন পর্যন্ত আমরা দেখতে পাই৷

মোগলদের সময় ঈদ উদযাপনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ঈদ মিছিল৷ রাজধানীতে ঈদের দিন মোগল সম্রাটরা নামাজ পড়তে যেতেন মিছিল করে৷ মোগলাই জৌলুস প্রকাশিত হতো সেই ঈদ মিছিলে৷ সেই ধারাবাহিকতায় বলা যেতে পারে, মোগলরা আসার আগে এই অঞ্চলে, মানে পূর্ববঙ্গে ঈদ ‘উৎসব’ হয়ে ওঠেনি৷ মোগল রাজধানী আগ্রা থেকে এত দূরে উৎসব করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে চাইতেন না মোগলরা৷ ১৬১০ সালের পর থেকে আগ্রার অনুকরণে এখানকার ঈদ উদযাপনটা হয়ে ওঠে জাঁকজমকপূর্ণ৷
মোগলদের ঈদ উদযাপন হতো দু-তিনদিন ধরে৷ চলত সংগীত ও নৃত্য পরিবেশন৷ আত্নীয়-স্বজন, পরিবার-পরিজন নিয়ে একরকম মেলাই বসে যেতো৷ তখনকার ঈদ উদযাপনের চিত্র পাওয়া যায় সেই সময়কার সুবাদার ইসলাম খাঁ চিশতির সেনাপতি মির্জা নাথানের বর্ণনা থেকে৷ সন্ধ্যায় যখন মোমবাতির আলোয় আলোকিত হতো মোগল আমলের ঢাকা শহর, তখনও শেষ রোজার সন্ধ্যাকাশে উঠতো ঈদের চাঁদ৷ শিবিরে বেজে উঠতো শাহী তূর্য (রণশিঙ্গা) এবং গোলন্দাজ বাহিনী গুলির মতো একের পর এক ছুঁড়তে থাকতো আতশবাজি৷ সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলতো এই আতশবাজির খেলা৷ শেষরাতের দিকে বড় কামান দাগা হতো৷
মির্জা নাথানের স্মৃতিকথায় মোগলদের ঈদ উদযাপনের বর্ণনা থাকলেও ঈদ মিছিলের কোনো কথা আমরা পাই না৷ কিন্তু এটা মাথায় রাখতে হবে, ঢাকার তৎকালীন সুবাদার ইসলাম খাঁ নিজের রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে সেই সময়কার ক্ষমতাসীন মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরকে অনুসরণ করতেন, যদিও সেটা সম্রাট পছন্দ করতেন না৷ কিন্তু সম্রাট এবং সুবাদারের শৈশবটা একসঙ্গে কাটার সুযোগটা ইসলাম খাঁ ভালোভাবেই নিতেন৷ আর সেই ধারাবাহিকতায় ধরে নেওয়াটা একেবারে অযৌক্তিক হবে না যে, ঢাকার ঈদ মিছিলের শুরুটা তিনি করলেও করতে পারেন৷ তবে সেটা বেশি দিন চলেনি৷ ১৬১৩ সালে তাঁর অকাল মৃত্যুর পর ঢাকায় ঈদ মিছিলের চলটা বোধহয় সেভাবে টিকেনি৷
দুইজন মোগল যুবরাজ আজম শাহ (১৬৭৮-১৬৭৯) ও আজিম-উদ-দীন (১৬৯৮-১৭১২) সুবাদার হিসেবে ঢাকায় বাস করলেও তাঁদের সময়েও ঈদ মিছিল হতো কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েই যায়৷ কেননা তাঁদের সময়কার মোগল সম্রাট ছিলেন আওরঙ্গজেব৷ তিনি সম্রাট থাকাকালীন (১৬৫৮-১৭০৭) মোগলদের ঈদুল ফিতর পালনের পদ্ধতিতে মৌলিক পরিবর্তন আসে৷ তিনি পূর্ব পুরুষদের ঈদ উদযাপনের রীতি থেকে বের হয়ে আসেন৷ তাঁর কঠোর অনুশাসনের বাইরে গিয়ে কারো কিছু করার সাহস ছিল না৷ আর তাই ধরে নিতে পারি, সেই সময়ে ঢাকাতেও ঈদ মিছিল হতো না৷ তবে তাঁর মৃত্যুর পর সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছিল৷
সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর (১৭০৭) পর মোগল সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে৷ তা সত্ত্বেও ঈদ মোটামুটি বেশ ঘটা করেই আয়োজিত হতো৷ সেই সময় ঢাকার শাসক নায়েব নাযিমদের (তৎকালীন বাংলার নবাবদের শাসন প্রতিনিধি) পৃষ্টপোষকতায় ‘ঈদ’ তখনো উৎসবের আমেজটি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল৷ এক কথায় বলা যায় যে, মোগল ঢাকার উজ্জ্বল সময়ের কথা মনে করিয়ে দিতে পারতো এই ঈদ উৎসব৷ এভাবে চলতে থাকলেও ঢাকার উপর মূল ধাক্কা এসে লাগে ১৭৬৫ সালে৷ সে বছর মোগল সম্রাটের কাছ থেকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজস্ব সংগ্রহের ভার পায় ইংরেজরা৷ ঢাকার নায়েব-নাযিমরা পরিণত হন ক্ষমতাহীন শাসকে৷ পড়তি ঢাকার জৌলুস ধরার চেষ্টা করা হতো ঈদ ও মহরমের মিছিলের মাধ্যমে৷ এই মিছিলগুলোর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ঢাকার নায়েব-নাযিমরা৷ শিয়া মতাবলম্বী হওয়ায় নায়েব-নাযিমরা ঈদের পাশাপাশি মহরমেরও মিছিল বের করতেন৷ ধারণা করা হয়, নিজেদের শৌর্য দেখানোর জন্য উনিশ শতকের প্রথম দিকে এ মিছিলগুলোর ছবি আঁকার ব্যবস্থা করেছিলেন ঢাকার জনপ্রিয় নায়েব-নাযিম নুসরত জঙ্গ (১৭৮৫-১৮২২)৷ আর ছবিগুলো এঁকেছিলেন আলম মুসাওয়ার নামের এক শিল্পী৷ মোট ৩৯টি ছবি আঁকেন তিনি৷

হাতে তৈরি বড় আকারের কাগজে (২২ ইঞ্চি থেকে ২৮ ইঞ্চি) ছবিগুলো এঁকেছেন আলম মুসাওয়ার, যা অন্যান্য মোগল মিনিয়েচারের তুলনায় কিছুটা বড়৷ তাঁর অঙ্কনশৈলী হচ্ছে মোগল ও কোম্পানি আর্টের মিশেল৷ দেশীয় রঙের ব্যবহার করলেও ইউরোপীয় চিত্রকলার কিছু বৈশিষ্ট্য তাঁর কাজে লক্ষ্য করা যায়৷ জলরঙে আঁকা এই মূল্যবান চিত্রকর্মগুলো বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে, যা ঢাকার ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক অমূল্য অংশ৷
চিত্রগুলোতে দেখা যায়, ঈদের মিছিলগুলো নায়েব-নাযিমদের নিমতলী প্রাসাদ (বর্তমানে নিমতলী এলাকা), চকবাজার, হোসনি দালান প্রভৃতি স্থাপনার সামনে দিয়ে যাচ্ছে৷ মিছিলে থাকতো সজ্জিত হাতি, ঘোড়া, পালকি, অস্ত্র হাতে সৈন্যদল৷
মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের কারো কারো হাতে থাকতো রং-বেরংয়ের ছাতা অথবা বাদ্যযন্ত্র৷ নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য হাতির পিঠে সওয়ার হয়ে নায়েব-নাযিমরা থাকতেন একেবারে সামনের দিকে৷ সাধারণ দর্শকের পাশাপাশি ঢাকার অভিজাত শ্রেণির লোকজনসহ থাকতেন ঢাকায় অবস্থানকারী ইউরোপীয়রাও৷
হাকিম হাবিবুর রহমান, প্রখ্যাত নাট্যকার সাঈদ আহমেদ, আশরাফ-উজ-জামানদের স্মৃতিকথায় গত শতকের বিশ-ত্রিশ দশকেও ঢাকায় যে ঈদের মিছিল বের হতো তার বিবরণ পাওয়া যায়৷ গত শতাব্দীতেই চল্লিশ দশকের দাঙ্গায় এবং অন্যান্য কারণে ঈদের মিছিল বন্ধ হয়ে যেতে দেখি আমরা৷ তবে পাকিস্তান আমলে ১৯৫২-৫৩ সালে আবার ঈদ মিছিল হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়৷ ১৯৫৪ সালে আবার ঈদ মিছিল বন্ধ হয়ে যায়৷
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৯১ সালে নতুন করে ঢাকার ঈদ মিছিল শুরু হয় ‘ঢাকাবাসী’ নামের একটি সংগঠনের উদ্যোগে৷ এরপর থেকে প্রতি বছর বিছিন্নভাবে বিভিন্ন সংগঠন নিজেদের মতো করে ঈদ মিছিলের আয়োজন করে থাকে৷ তবে প্রায় ২০০ বছর পর এবারের ঈদে আবারও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় হতে যাচ্ছে ঢাকার ঈদ মিছিল৷
বুধবার (২৬ মার্চ) রাত সাড়ে ১১টায় এক ফেসবুক পোস্টে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন অন্তর্বতী সরকারের স্থানীয় সরকার এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া৷ তিনি জানান, স্থানীয় সরকার বিভাগ, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন পুরোদমে এই ঈদ মিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছে৷
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)-র আয়োজনে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের পাশের মাঠে (বাণিজ্য মেলার পুরাতন মাঠ) অনুষ্ঠিত হবে ঈদ জামাত৷ ঈদের নামাজ শেষে মোগল আমলের রীতি অনুযায়ী থাকবে ঈদের আনন্দ মিছিল৷ মিছিলটি জামাতের স্থান থেকে শুরু হয়ে শেষ হবে সংসদ ভবনের সামনে এসে৷