ফয়সাল আমিন কাজি (ফাহিম ফয়সাল): মানুষ এখন যথেষ্ট রকমের ভ্রমণ পিপাসু। একটু ছুটির অবকাশ মিললেই ভিড় করছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিকে। কেউ ছুটছেন সমুদ্রের দিকে, কেউবা পাহাড়ে আবার কেউবা হাওরে।
নদী বা হাওরের সৌন্দর্যও টানছে মানুষকে। ছুটে যাচ্ছেন হাওরে রাত কাটাতে। হাওরের বুকে প্রকৃতির নিস্তব্ধতা আর পাখির কলকাকলিতে মন ভাসিয়ে নিচ্ছেন ভ্রমণপিপাসুরা।
নান্দনিক সৌন্দর্যের আধার সিলেটের সুনামগঞ্জে ভ্রমণের জন্য ছুটছেন মানুষ। সেখানে রয়েছে টাঙ্গুয়ার হাওর। সুনামগঞ্জ জেলার ধরমপাশা ও তাহিরপুর উপজেলান অংশবিশেষ নিয়েই এ হাওরের অবস্থান। হাওর অঞ্চলের গ্রামগুলো যেন এক একটি দ্বীপ। হাওরের চারপাশে রয়েছে ৮৮টি গ্রাম। ‘ছয় কুড়ি বিল আর নয় কুড়ি কান্দার’ সমন্বয়ে পরিচিত দৃষ্টিনন্দন এ বিলটি। যার দৈর্ঘ্য ১১ এবং প্রস্থ ৭ কিলোমিটার।
বিশ্বের সর্বাধিক বৃষ্টিবহুল অঞ্চল চেরাপুঞ্জির কাছেই অবস্থিত রামসার সাইট টাঙ্গুয়ার হাওর। সরকার ১৯৯৯ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরের ৯ হাজার ৭২৭ হেক্টর এলাকাকে ‘পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণা করে। হাওরটি দেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট এবং পৃথিবীর ১০৩১তম রামসার সাইটের মর্যাদা পায় ২০০০ সালে।সুনামগঞ্জ জেলার প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত মিঠাপানির জলাভূমি এই টাঙ্গুয়ার হাওর। জলাবন, নীল আকাশ, পাহাড় ও চোখ জুড়ানো সবুজ এই হাওরকে অপরূপ সাজে সাজিয়েছে। টাঙ্গুয়ার হাওরের মোট আয়তন ৬৯১২ একর। তবে বর্ষাকালে এই হাওরের আয়তন বেড়ে প্রায় ২০,০০০ একর পর্যন্ত হয়ে যায়।
টাঙ্গুয়ার হাওরে ৫২টি বিল রয়েছে। এর মধ্যে ১৬টিতে সারা বছরই পানি থাকে। এই হাওরের প্রায় ৬০ হাজার মানুষের বসবাস। কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কারণে হাওরটি পর্যটকদের কাছে বিশেষভাবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। জলাভূমি, বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, প্রায় পাঁচশ প্রজাতির পাখি, উদ্ভিদের আবাসস্থল স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ, উভচর প্রাণী এবং মা মাছের উত্তম প্রজননস্থল এই হাওর।
টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রায় ১৪০ প্রজাতির মাছ, ১২ প্রজাতির ব্যাঙ এবং ১৫০ প্রজাতির বেশি সরীসৃপের সন্ধান পাওয়া যায়। শীতকালে এই হাওরে প্রায় ২৫০ প্রজাতির অতিথি পাখির বিচরণ ঘটে।
টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করতে এখানে একটি সমাজভিত্তিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলেছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়।টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়গুলো দেখা যায়। মেঘালয় থেকে ছোট-বড় ঝরনা হাওরে এসে মিশেছে। এই হাওরে একটি ওয়াচ টাওয়ার আছে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে টাঙ্গুয়ার হাওরের গ্রামগুলো ভাসমান দ্বীপের মতো দেখায়।
যারা টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণে যেতে চান, তাদের জন্য একটি গাইডলাইন থাকছে এই আয়োজনে।
টাঙ্গুয়ার হাওর যেতে প্রথমেই আপনাকে সুনামগঞ্জের উদ্দেশে রওনা করুন। ঢাকা থেকে সড়কপথে সুনামগঞ্জের দূরত্ব প্রায় ২৬৬ কিলোমিটার। ঢাকার সায়েদাবাদ এবং মহাখালী বাস-টার্মিনাল থেকে হানিফ, এনা, শ্যামলীসহ বেশ কিছু এসি ও ননএসি বাস সরাসরি সুনামগঞ্জ পৌঁছে দেবে। ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জের ভাড়া ৫০০-৮০০ টাকা।
সুনামগঞ্জ বাস-টার্মিনাল নেমে রিকশায় করে সাহেববাজার ঘাট পর্যন্ত যেতে হবে। সাহেববাজার ঘাট থেকে স্পিডবোট পাওয়া যাবে। যার খরচ নিবে ৭৫০০-৮০০০ টাকা। ইঞ্জিন বোটে খরচ আরও কম হবে। কোনো একটি ভাড়া করে গন্তব্যে রওনা দিন। পৌঁছাতে সময় লাগবে প্রায় ৫ ঘণ্টা।
টাঙ্গুয়ার হাওরে থাকার জন্য দুই ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। আপনি যদি অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন তবে আপনার জন্য রয়েছে নৌকায় থাকার ব্যবস্থা। অন্যদিকে পরিবার নিয়ে গেলে আপনি থাকতে পারেন হাওর বিলাস নামের কাঠের বাড়িতে, যা হাওরসংলগ্ন টেকেরহাটে অবস্থিত। এখানে আপনি স্বল্প ভাড়ায় পেয়ে যাবেন রুম। তবে পর্যটন সিজনে গেলে রুম পাওয়া কিছুটা কষ্টকর।
বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় আর কোনো থাকার ব্যবস্থা নেই এখানে। তবে সুনামগঞ্জে ফিরে এলে সেখানে আপনি ৫০০ থেকে ২০০০ টাকার মধ্যে একাধিক রেস্টহাউস পেয়ে যাবেন।
👉আপনার ব্যবসা বা কোম্পানি প্রোফাইল ওয়েবসাইট তৈরির জন্য আপনার পাশে সবসময় আছে ‘ভার্সডসফট’।
ঢাকা ফেরার পথেও একইভাবে ফিরতে পারেন। তবে পরামর্শ হলো, এক-দুইজন না গিয়ে দল বেঁধে ঘুরে আসুন। নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত হবে। খরচও কমবে।
টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রমণের ক্ষেত্রে পর্যটক ও পর্যটকবাহী নৌযান চলাচলে ১০টি নির্দেশনা জারি রয়েছে। হাওরের পরিবেশ রক্ষা, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ, নৌ দুর্ঘটনা ও গণ-উপদ্রব রোধ এবং সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে এ নির্দেশনা জারি করা হয়।
টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রমণে যা যা সঙ্গে নেবেনঃ
-
- ফোন/ক্যামেরা রাখার জন্য ওয়াটারপ্রুফ প্লাস্টিক ব্যাগ/জিপলক ব্যাগ
- পর্যাপ্ত খাবার পানি
- পাওয়ার ব্যাংক
- সাঁতার কাটার জন্য অতিরিক্ত কাপড়
- লাইফ ভেস্ট/জ্যাকেট
- টর্চলাইট ও ম্যাচ
- রেইনকোট/ছাতা
- প্লাস্টিক/রাবারের স্যান্ডেল
টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণে কিছু পরামর্শঃ
-
- খাবারের অংশ বা উচ্ছিষ্ট, প্যাকেট, খোসা বা পাত্র হাওরের পানিতে ফেলবেন না।
- মাইক ব্যবহার করে বা অন্য কোনো প্রকার শব্দ করা যাবে না।
- নৌকায় ময়লা আবর্জনা জমিয়ে রাখার জন্য নির্দিষ্ট ঝুড়ি রাখতে হবে।
- রাতের বেলা অবস্থান করলে অস্বাভাবিক উজ্জ্বল আলো তৈরি করা যাবে না।
- পাখি বা বন্য প্রাণী লক্ষ্য করে ঢিল ছোড়া যাবে না। বন্য প্রাণীদের নিরাপদ অবস্থান ও চলাফেরায় বিঘ্ন সৃষ্টি করা যাবে না।
- টাংগুয়ার মাছ, বন্য প্রাণী বা পাখি ধরা যাবে না। এদের জীবন হুমকির মধ্যে পড়ে এমন কোনো কাজ করা যাবে না।
- হাওরে কোনো গাছপালা, বন জঙ্গল বা লতা পাতার ক্ষতিসাধন করা যাবে না।
- শামুক, ঝিনুক বা অন্য কোন প্রকার জলজ বা স্থলজ প্রাণী/কীটপতঙ্গের ক্ষতিসাধন করা যাবে না।
- ভ্রমণকালে হাতে চালিত নৌকার ব্যবহার বাঞ্ছনীয়।