জোর করে পদত্যাগপত্রে সই নেয়া হয় ইসলামী ব্যাংকের এমডি’র

অর্থনীতি বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

ডিজিএফআই দিয়ে তুলে নিয়ে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই নেয়া হয় ইসলামী ব্যাংকের এমডির। একইভাবে নিজ নিজ বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয় ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানকে। তারপর ‘ভয়ংকর ব্যাক ডাকাত’ এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটি দখল করে নেয়। আর এসব ঘটেছে সরকারের প্রভাবশালীদের সহায়তায়। চলেছে কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি। এসব খেলাপি ঋণের ছোবলে বহু ব্যাংক আক্রান্ত হয়ে বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে।

ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের আয়োজনে ব্যাংকিং খাতে দখলদারিত্ব উচ্ছেদ শীর্ষক ওয়েবিনারে এমন অরাজকতার চিত্র ফুটে উঠেছে। শুক্রবার (৩০ আগস্ট ২০২৪) অনুষ্ঠিত এই ওয়েবিনার সঞ্চালনা করেন সাংবাদিক মনির হায়দার। অনুষ্ঠানে ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) খ্যাতিমান ব্যাংকার ও গবেষক আবদুল মান্নান সেসব ভয়াবহ চিত্র বর্ণনা করেছেন।

আলোচনায় অংশ নেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, ফিন্যান্সিয়াল এক্সিলেন্সের চেয়ারম্যান মামুন রশীদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অ্যাডজ্যাংক্ট প্রফেসর মো. মিজানুর রহমান।

২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি ভোরে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) কয়েকজন কর্মকর্তা ইসলামী ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল মান্নানকে তাঁর বাসা থেকে কচুক্ষেতে ডিজিএফআই কার্যালয়ে নিয়ে যান। একইভাবে নিজ নিজ বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয় ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানকে। এরপর তাঁদের জোরপূর্বক পদত্যাগপত্রে সই করিয়ে ব্যাংকটি দখলে নেয় মোহাম্মদ সাইফুল আলমের মালিকানাধীন এস আলম গ্রুপ।

ওই দিন ইসলামী ব্যাংকের একটি অব্যবহৃত প্যাডে লেখা পদত্যাগপত্রে জোর করে সই নেওয়া হয় বলে দাবি করেছেন ব্যাংকটির সাবেক এমডি আবদুল মান্নান। তিনি বলেন, আমাকে যে কাগজে সই করানো হয়, সেটি ইসলামী ব্যাংকের একটি প্যাড। কিন্তু সেই প্যাড ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে চলতি ২০২৪ সাল পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংক কখনই ব্যবহার করেনি। সে ধরনের একটি প্যাডে আমার পদত্যাগপত্র নেওয়া হয়েছে।

ইসলামী ব্যাংকিং জগতে খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব আবদুল মান্নান বলেন, ওই দিন (৫ জানুয়ারি ২০১৭) অনেক রাত পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে অফিস চলেছে। তাঁরা ওই দিনই ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনের কাজটি দ্রুত সম্পন্ন করতে কাজ করেছেন। এগুলো কীভাবে হতে পারে একটি দেশের ব্যাংক খাতে। যে ব্যাংক খাত একটি দেশের অর্থনীতির প্রাণ। তিনি আরও বলেন, পরের কয়েক বছর এস আলম গ্রুপের টেলিফোনে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের অনেক সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে। এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, যাতে ভবিষ্যতে এমনটা ঘটানোর কেউ সাহস না পায়।

দীর্ঘ সাড়ে সাত বছর পর দেশে ফিরেছেন জানিয়ে আবদুল মান্নান বলেন, বিদেশে থাকার সময় দেশ থেকে সাংবাদিকদের কেউ কেউ যোগাযোগ করলেও আমি কথা বলিনি। কারণ, আমি নিরাপদ বোধ করিনি। আতঙ্কের মধ্যে থেকেছি। আবার বাংলাদেশে এসে নিশ্বাস নিতে পারব বলে মনে করিনি। তিনি আরও বলেন, আমি এখন মনে করি, কথা বলার স্বাধীনতা পেয়েছি। তবে সেই ভয় কাটতে বোধ হয় সময় লাগবে। মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিতে বোধ হয় আমার আরও সময় লাগবে।

ব্যাংক ও আর্থিক খাতে প্রতারণা ও দুর্বৃত্তায়নের মূল কারণ হিসেবে নষ্ট ও পচা রাজনীতিকে দায়ী বলে মন্তব্য করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, জনকল্যাণের পরিবর্তে গোষ্ঠীর কল্যাণে রাজনীতি কাজ করছে। ইসলামী ব্যাংক দখলের পেছনে রাজনৈতিক কারণ ও রাজনীতিকদের নির্দেশ ছিল। সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে এস আলম গ্রুপকে ইসলামী ব্যাংক দখল করতে সরাসরি নির্দেশনা দেয়। আসলে রাজনীতি জনকল্যাণমূলক না হলে কোনো কিছুই ঠিক হবে না।

ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ২০১৪ সালে লোকদেখানো নির্বাচন করে বিদায়ী সরকার। আর সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার কারণেই তারা পরবর্তী সময়ে দখলদারিতে গেছে উল্লেখ করেন বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, বিদায়ী সরকার ক্রোনি গোষ্ঠী (স্বজনতোষী পুঁজিপতি) সৃষ্টি করে। তারাই আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করেছে। তিনি আরও বলেন, রাজনীতি ঠিক না করে ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সঠিক নেতৃত্ব না আনা গেলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। সমস্যার সাময়িক সমাধান হলেও তা টেকসই হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *