জসওয়ান্ত সিং এর গ্রন্থ ব্যবচ্ছেদ – ২য় পর্ব
জসওয়ান্তের গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর ভারত জুড়ে হৈ চৈ শুরু হয়েছিল। রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ছিল ভয়াবহ, বিশেষ করে তিনি নিজের দল, উগ্র হিন্দু দল বিজেপি’র মূল বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত হয়েছেন অভিযোগে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। শুধু বিজেপি নয়, কংগ্রেসসহ অন্যান্য দলকেও অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হয়, কারণ জসওয়ান্ত সিং ভারতের দুই স্বর্গীয় নেতা জওহরলাল নেহরু ও সরদার প্যাটেলকে দেশ বিভাগের প্রকৃত খলনায়ক ও দায়ী ব্যক্তিতে পরিণত করেছেন।
ভারতের শিক্ষাবিদরা দালীলিক প্রমাণ সমৃদ্ধ এমন গ্রন্থ গ্রহণ করার পাশাপাশি এটিকে প্ররোচনামূলক বলে প্রত্যাখ্যান করলেও সুশীল সমাজ ও সাংবাদিকদের সিংহভাগ গ্রন্থটিকে গবেষণার চমৎকার এক ফসল এবং ইতিহাসের ছিন্ন সূত্র ধরিয়ে দেওয়ার সাহসী প্রচেষ্টা হিসেবে বর্ণনা করে লেখকের প্রশংসা করেছেন যে, দীর্ঘ সময় পর হলেও তিনি একটি গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন।
ভারতের সাবেক এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী অত্যন্ত ধৈর্য্যরে সঙ্গে বহু তথ্য উদ্ধৃত করে প্রমাণ করেছেন যে, নেহরু এবং প্যাটেল যদি দেশ বিভাগের পক্ষে জোরালো অবস্থান গ্রহণ না করতেন, তাহলে ‘পাকিস্তান’ নামে কোনো রাষ্ট্রের জন্ম হতো না। তাঁর গ্রন্থ ২০০৯ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে উপমহাদেশের দেশগুলোর রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী মহলে তীব্র প্রতিক্রয়ার সুষ্টি হয়েছে। তিনি এই সত্য উচ্চারণ করে ভারতীয়দের ক্ষোভের কারণ হয়েছেন যে, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ হিন্দু-মুসলিম ঐক্য বজায় রাখার লক্ষ্যে কাজ করতে আগ্রহী এক মহান ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু কংগ্রেসের মুসলিম বিদ্বেষী আচরণ জিন্নাহ’র নামকে মুসলমানদের আশা-আকাংখর সমার্থক করে তোলে।
কংগ্রেস ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে মুসলমানদের পৃথক জাতি হিসেবে স্বীকার না করে সবসময় এমন ভাব প্রকাশ করেছে যে, ভারত স্বাধীন হলে মুসলমানরা এমনিতেই উপকৃত হবে। অর্থ্যাৎ কংগ্রেসের দৃষ্টিতে ভারতের স্বাধীনতায় মুসলমানদের যতটা উপকার হবে, তা কংগ্রেসের প্রাপ্ত সুবিধার বাই-প্রেডাক্ট। মুসলমানদের প্রতি কংগ্রেসের এই উদাসীনতা জিন্নাহকে অখন্ড ভারতে মুসলমানদের মধ্যে পৃথক একটি জাতি গঠনের স্বপ্ন জাগ্রত করার আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
জসওয়ান্ত সিং এর গ্রন্থ এ সত্যও তুলে ধরেছে যে, মুসলিম প্রশ্নে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার মধ্যে আদর্শগত তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। এমনকি তিনি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তোলার প্রচেষ্টার কথাও খুব কম উল্লেখ করেছেন। ১৯৪৬-৪৭ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা রোধে অথবা মুসলিম উদ্বাস্তুদের রক্ষা করতে জওহরলাল নেহরুর ভূমিকাও তিনি গৌন করে দেখিয়েছেন বলে সমালোচকরা তাঁকে আক্রমণ করেছে।
জসওয়ান্ত সিং তার গ্রন্থে এটাও স্বীকার করেছেন যে, স্বাধীনতার পর নেহরু দেশভাগের জন্য অনুশোচনা করেছেন এবং আশা করেছেন যে, ঘটনাটিকে আবারও ঘুরিয়ে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু কখনও এটা জানার জন্য উদ্যোগী হননি যে, নতুন পরিস্থিতিতে জিন্নাহকে কি ভাবতে হয়েছিল।
ইংলিশ ইতিহাসবিদ, নাট্যকার ও লেখক অ্যালেক্স ফন টানজেলম্যান তার বিখ্যাত গ্রন্থ “ইন্ডিয়ান সামার: দ্য সিক্রেট হিস্টরি অফ দ্য এন্ড অফ অ্যান এম্পায়ার” এ লিখেছেন, “জিন্নাহ’র ডাক্তারের মতে, তাঁর শেষ সময়ে লিয়াকত আলি খান তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলে তিনি তাঁকে বলেন যে, ‘আমার জীবনে পাকিস্তান ছিল সবচেয়ে বড়ো ভুল। এখন যদি সুযোগ পাই, তাহলে আমি দিল্লি যাব এবং জওহরলালকে বলবো অতীতের ভুলত্রুটি ভুলে গিয়ে আবার বন্ধু হতে।’”
এই বক্তব্যের মধ্যে তাঁর আগের এক মন্তব্যের ছাপ পরিস্ফুট ছিল, যখন পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর পর পাকিস্তান টাইমস পাঞ্জাবের উদ্বাস্তু সংকটের ওপর এক বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশ করে। তিনি সেটি পাঠ করে দুই হাতে মাথা ধরে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘হায় আমার আল্লাহ, এটা আমি কি করেছি?’ টানজেলম্যান আরেকটি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন যে, মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবি যখন তুঙ্গে তখন চার্চিলও ভারত বিভাগের পক্ষে সায় দিয়েছিলেন।
জসওয়ান্ত সিং তাঁর গ্রন্থের সূচনাতে ভারত বিভাজনের জন্য নেহরু ও সরদার প্যাটেলকে দায়ী করেছেন গ্রন্থটি পড়তে সামনের পৃষ্ঠাগুলোতে এগিয়ে যেতেই দেখা যায়, যখন তিনি বলেন যে কংগ্রেসের দুই শীর্ষ নেতা ‘সার্জিক্যাল অপারেশন’ চালিয়ে ভারত ভাগ করেছেন। মাউন্টব্যাটেনও প্রথমে বলেছিলেন যে, দুঃখজনকভাবে নেহরু এবং প্যাটেল ও কংগ্রেস পার্টি এই দেশ ভাগে সম্মতি দিয়েছিল।
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ যে কোনোভাবে এ ধরনের একটি বিকল্প উপায় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। মি. সিং তাঁর গ্রন্থে আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানি ও শিক্ষাবিদ লয়েড আরভিং রুডলফ এবং তাঁর স্ত্রী সুজান রুডলফ এর এক লেকচারের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যেখানে তারা বলেছেন যে, “জিন্নাহ উদারনৈতিক, সারগর্ভশীল এবং একজন আপাদমস্তক ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন, যিনি ভারতের অখণ্ডতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন।”
এমনকি ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগো তাঁকে “কংগ্রেসের চেয়ে বেশি কংগ্রেসী” বিবেচনা করতেন। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও মুসলিম লীগ এবং আরও কিছু মুসলিম সংগঠনকে ভারত ভেঙে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন বলে যে দোষারূপ করা হয়, তা যে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ছিল এ ধরনের উদ্ধৃতিই এটা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট। কংগ্রেস এবং দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা মোহনদাস গান্ধী, গোপাল কৃষ্ণ গোখলে এবং বাল গঙ্গাধর তিলক হিন্দু-মুসলিম সদ্ভাব-সম্প্রীতি বজায় রেখে অখণ্ড শক্তিশালী ভারত গঠনের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। যদিও বাল গঙ্গাধর তিলক হিন্দু ও মুসলমানদের পৃথক জাতিসত্তার কথা বলেছেন। (চলবে)
* আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু উপদেষ্টা সম্পাদক- উইকলি বাংলাদেশ, নিউ ইয়র্ক। সাবেক সম্পাদক- মাসিক নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট