হযরত ঈসা আ.এর জন্মের প্রায় ১০৫ বছর পর চীন দেশে সভ্যতার মূল উপকরণ কাগজের প্রচলন ঘটে। প্রাচীন মিশরীয়রা প্যাপিরাস গাছের কাণ্ডকে পাতলা করে চিরে তাতে লেখার কাজ করত। প্রাচীন ভারতে প্রায় সমসাময়িক কালেই ভূর্জপত্র অথবা তালপাতায় লেখার বিষয়টি শুরু হয়ে যায়। তবে যে কোনভাবেই ৭৫১ খ্রিস্টাব্দে চীনাদের কাছ থেকে কাগজ বানানোর কায়দাটা ক্রমে আরবে, মিশরে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। চা-পান এবং কাগজ বানানো এ দু’টি বিষয়ের জন্য চীনাদের কাছে বর্তমান সভ্যতা অধমর্ণ, ঋণী। ভারতে কাগজ শিল্পের প্রচলন ঘটে অন্তত ১২০০-১৩০০ বছর আগে। আর প্রায় দু’শ বছর আগে বাংলা হরফে ছাপার কাজ শুরু হয়। অবশ্য তখনই ছোটদের জন্য কোন বই বা পাঠ্য ছাপা হয়নি। কারণ ছোটদের জন্য বইয়ের প্রয়োজনীয়তা তখনো অনুভূত হয়নি। উপযুক্ত ভাষাও গড়ে ওঠেনি।
ছোটদের জন্য প্রথম বাংলা বই ছাপা হয় ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে। যতদূর জানা যায়, তার আগে ছোটদের খেলার বই বা পড়ার বই কোনটাই ছিল না। তবে মুখে মুখে ছেলে ভোলানো ছড়া-কবিতার প্রচলন এর অনেক আগে শুরু হয়ে যায়। লেখাপড়ার বিষয়টিই সীমিত ছিল ‘পণ্ডিত’ নামে খ্যাত কিছু রসবোধহীন ব্যক্তির মাঝে। পাঠশালায় পণ্ডিতরা রক্ত চক্ষু বেত্রাঘাতের মাধ্যমে শিশুদের জীবন চলার উপায় হিসেবে লিখতে পড়তে অঙ্ক কষতে, ব্যাকরণ মুখস্থ করাতে থাকতেন ব্যস্ত। এ ছাড়া শিশুদের জন্য আলাদা বই এবং শিক্ষা পদ্ধতি থাকা উচিত তা মোটেই উপলব্ধ ছিল না তখন। ছোটদের বইয়ের ইতিহাসটা এরকম : সমসাময়িক কালে ‘শ্রীরামপুরের ইংরেজ মিশনারিরা তাদের নিজেদের ছাপাখানায় কিশোর পাঠ্য প্রথম বাংলা পত্রিকা প্রকাশ করলেন।’’ তার নাম ছিল ‘দিগদর্শন’। উদ্দেশ্য ছিল ছোটদের শিক্ষাদান। শিশু মনে রস বিতরণের কথা ভাবা হয়নি। রচনা প্রায় সবই ছিল ইংরেজি থেকে অনুবাদ। তবে কিছু মৌলিক লেখাও স্থান পেতো। কিন্তু তার ভাষা এতো রসহীন ‘সাধু’ ছিল যা আয়ত্ত করা বহু শিশুর পক্ষে সম্ভব না হওয়ায় তাও সীমিত ছিল নির্দিষ্ট গণ্ডিতে।
শিক্ষাদানই যখন প্রধান উদ্দেশ্য, তখন নীতিকথা, ‘হিতোপদেশ’ ‘ইতিহাস’ ইত্যাদি গ্রন্থই প্রকাশের তালিকায় থাকবে তা স্বাভাবিক। শ্রীরামপুর মিশন প্রেস প্রথম এ জাতীয় বই ছাপাতে থাকে। তারপর কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটি ১৮১৮-১৯ সালে আরো কিছু বই প্রকাশ করে। এগুলোই বাংলা ভাষায় লিখন ছোটদের বইয়ের আদি নির্দশন। তবে এসব বই এতোই নিরেট রসহীন এবং জ্ঞান ও নীতিকথায় ভরপুর ছিল এগুলোকে শিশু সাহিত্যের পাল্লায় মাপা হয় না।
১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম। ১৮৪৭ এ তাঁর লিখিত ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ নামে তিনিই প্রথম শিশুদের জন্য উপযোগী করে সহজ ও বিশুদ্ধ বাংলায় বই রচনা করেন। এরপর তিনি ‘কথামালা’, ‘চরিতাবলী’ এবং গল্পগ্রন্থ ‘আখ্যান সঞ্জরী’ রচনা করেন। এগুলো যদিও পাঠ্যপুস্তক জাতীয় গ্রন্থ তবু শিশুদের জন্য যে আলাদা ভাষা এবং বিষয়নির্ভর বই রচনা প্রয়োজন তা ‘বিদ্যাসাগর’ই যাত্রা শুরু করেন। শিশুরা অতিবাস্তব ও কাল্পনিক বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। গল্প তাদের ভাল লাগা বিষয় এবং গল্প মানেই এমন অদ্ভুত অদ্ভুত কাণ্ড থাকবে যা বাস্তব জীবনে কখনোই ঘটতে দেখা যাবে না। আর এ বিষয়টি যখন লেখকদের কাছে পরিষ্কার ধরা দেয়, শুরু হয়ে যায় বিদ্যাসাগরীয় উপদেশ, আদেশ, ইতিহাস ইত্যাদির পরিবর্তে উদ্ভট কাল্পনিক গল্প আর জন্তু-জানোয়ারদের নিয়ে নানা কাহিনী।
১৮২২ খ্রিস্টাব্দে স্কুল বুক সোসাইটি প্রকাশিত ‘পশ্বাবলি’তে জন্তু জানোয়ারের সচিত্র কাহিনী ছোটদের মুগ্ধ করে। এভাবে ছোটদের জ্ঞান দানের পাশাপাশি রস দান বিষয়টি বিদ্যাসাগরীয় যুগের পরবর্তীতে বেশ আমল পেতে থাকে। খগেন্দ্রনাথ মিত্র তাঁর ‘শতাব্দীর শিশু সাহিত্য’ গ্রন্থে বিদ্যাসাগরীয় যুগের কাল নির্দেশ করেছেন ১৮৪৭ থেকে ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তারপরই রবীন্দ্রনাথ যুগের শুরু। বলা যায় ছোটদের সাহিত্যের এক নতুন যুগ। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকৃত অর্থে শিশু সাহিত্যের সূচনা ঘটেনি বরং ছাপার অক্ষরে শিশুদের জন্য কিছু জ্ঞান বিতরণের গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছিল মাত্র। আগেই বলেছি দাদি-নানীর মুখে মুখে কড়াকথা, রূপকথা, বীরের গল্প, ভূত-প্রেতের গা ছম ছম করা গল্প বহু প্রাচীনকাল থেকে বলে আসছিল। বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত আধুনিক বাংলা ভাষার চাইতে তার ইতিহাস অনেক বেশি আদি ও বলিষ্ঠ। সে ইতিহাস কোনো ভাষার বাধা মানেনি। এর মধ্যে বাঙালি জীবনের অন্তরঙ্গ ধারাটি প্রবাহিত হয়ে এসেছে। ঊনিশ শতকের শেষ পাদে আর বিশ শতকের গোড়ার দিকে দু’জন সৎসাহসী সম্পাদক ও লেখক। যথা রেভারবেন্ড লালবিহারী দে আর দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার পণ্ডিতদের এই অমূল্য সম্পদের অনেকখানি গ্রন্থভুক্ত করেন যা আজো ছোটদের প্রিয় পাঠ্য হিসেবে গৃহীত।আমরা যারা ছোটদের কথা ভাবি, তাদের জন্য লিখি, গ্রন্থ প্রকাশ করে থাকি তারা নিশ্চয়ই এ কথা উপলব্ধি করেন ছোটদের একটা আলাদা জগৎ আছে। ঐ একটি গ্রহের মধ্যে আরেকটি গ্রহ। সেই গ্রহটি এই গ্রহের চেয়ে অনেক বড় ও বিশাল। এতো বিস্তৃত যা কল্পনাকে হার মানায়। কাজেই কল্পনার অতীত সেই জগতের বাসিন্দাদের জন্য কিছু লেখা কি সহজ কাজ? যুগে যুগে শত শত নয়, হাজার হাজার শিশুর জন্য যারা গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন তাদের অধিকাংশই ততো সফল হতে পারেননি। কাউকে কাউকে ছোটরা আপন করে নিয়েছে, কাউকে নিতে পারেনি। এই যে এক কঠিন পথ- সেই পথের বাসিন্দাদের ব্যাপারে আরেকটু বলছি।
একটা বিষয় কিন্তু পূর্বাহ্নে বলেছি, ছোটদের ‘মানুষ’ হতে হবে। মানুষ হিসেবে মানস গঠন করতে হবে এমন কল্যাণ চিন্তা থেকেই ছোটদের জন্য গ্রন্থ প্রণয়নের কাজটি শুরু হয। যখন থেকে বিদ্যা দান এবং রস দান দুটো বিষয় আলাদা হয়ে কিংবা সম্মিলিতভাবে ছোটদের জন্য বই লেখা ও প্রকাশের যাত্রা শুরু হয়। তখনো ছোটদের কল্যাণ চিন্তাটাই মুখ্য হয়ে রয়েছে। কল্পকথা, রূপকথা, জন্তু জানোয়ার, দৈত্য-দানোর আজগুবি গল্পগুলোর মধ্যেও সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ্ব, সত্যের বিজয় এ ধরনের আদর্শবোধ ফুটে উঠতো।
ছোটদের জন্য বই বললেই এক শ্রেণীতে ফেলা যাবে না। ছোট বললেই ৫-১৬ বছর অবধি এক ক্যাটাগরিতে ফেলে একই ধাঁচের শিশু-সাহিত্য রচনা করা হয় তা হলেও সেটা ঠিক হবে না। সে বিষয়টা শিশু সাহিত্যিকদের মাথায় থাকতে হবে। আমি কাদের জন্য রচনা করছি। তাদের বয়স কত। যেমন ৮ বছর পর্যন্ত একটা শিশুর হাতে বই তুলে দিতে হলে এ কথা মনে রাখতে হবে তার মানস জগতটি কি রকম হতে পারে। কি ধরনের বিষয় তার চিত্তকে আন্দোলিত করবে। কি রকম ভাষা তার জন্য প্রযোজ্য। তেমনি ৯-১০ বছর বয়সী শিশুরা বলা যায় কিশোর কাল অতিক্রম করে- এ সময়ে তাদের মানসিক অবস্থার দ্রুত মোড় নিতে থাকে। মানস জগতটা একটু বড় হয়ে যায়। বড় বড় চিন্তা করতে ভালবাসে। তেমনিভাবে ১০-১৬ বছর বয়সী শিশুদের জগৎ আরো ভিন্ন। আরো জটিল এবং অনেক কিছু জানার কৌতূহলে সদা ব্যস্ত মন। এসব তাত্ত্বিক বিষয় বুঝে শিশুদের জন্য কিছু লেখা, বই প্রকাশ করা কিংবা পত্রিকা সম্পাদনা করা এসব কাজ অত্যন্ত যত্ন করে বাংলা সাহিত্যে যে দু’জন শুরু করেছিলেন তাদের নাম এখানে উচ্চারণ করতেই হয়। তাঁরা হলেন : উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী এবং যোগীন্দ্রনাথ সরকার। এখানে একটু বলা উচিত উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর ছেলে সর্বকালের সেরা শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায় এবং তৎসুযোগ্য ছেলে বাংলা কথাচিত্র ও শিশু সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল সত্যজিৎ রায় বাঙালি সমাজকে চিরঋণী করে গেছেন। এই রায় পরিবারটির প্রতি বাঙালি সমাজ কৃতজ্ঞ না হয়ে পারে না।
উপেন্দ্র কিশোরের পর রবীন্দ্রনাথ এলেন শিশুদের মন জয় করতে। ‘শিশু ভোলানাথ’ কবিতা গ্রন্থ নিয়েই কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যাদের জন্য লিখলেন অর্থাৎ ৬-৭ বছর বয়সী বালকদের জন্য, তাদের উপযোগী কবিতা তিনি লিখতে পারলেন না। কারণ কবিতার বিষয় যেমন ভারী, ভাষা ও ছন্দও তেমন জটিল। এদিক দিয়ে আরও পরে কাজী নজরুল ইসলাম সার্থক হিসেবে প্রমাণ করলেন। বলা যায় নজরুলের শিশুতোষ ছড়া-কবিতাগুলো শুধুমাত্র শিশু মনকে নাড়া দিতেই সক্ষম হয়নি। বরং শিশুদের সহজাত ডানপিটে স্বভাব, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মধ্যে আনন্দ পাওয়া, অজেয়কে জয় অসাধ্যকে সাধন করার আকাক্সক্ষা এসব মানস খোরাক নজরুলের শিশুতোষ রচনাতে পরিপূর্ণভাবেই উপস্থিত।
আবার একটু পেছনের দিকে ফিরে দেখতে চাই। ইতিহাসটা জানা দরকার। আমরা যারা এখন শিশুদের জন্য কিছু করতে চাই বা করছি, আমাদের পথচলায় খানিকটা প্রেরণা হতে পারেন হয়তোবা।
যোগীন্দ্রনাথ সরকার এবং উপেন্দ্র কিশোর দু’জনের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে- উপেন্দ্র জমিদার পরিবারের সন্তান ছিলেন। আর্থিক জীবনে তাঁর ছিল না কোন টানাপোড়েন। যোগীন্দ্রনাথ স্বচ্ছল ছিলেন না। কোনক্রমে সিটি বুক সোসাইাটি নামে একটি প্রকাশনা গড়ে তোলেন এবং সারাজীবন এই প্রকাশনা থেকে ‘শিশু পাঠ্য গ্রন্থাবলী’ প্রকাশ করে যেতে থাকেন। সচিত্র ছড়া, গল্প ও সহজ প্রবন্ধ তিনি প্রকাশ করে বাঙালি শিশুদের জ্ঞানসুধা ও রস বিতরণে অকৃপণ অবদান রাখেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এই মজার দিকটি উপলব্ধির বিষয়- কেউ সাহিত্য সেবা করেছেন বিত্ত-ভৈববের মধ্যে বাস করে- আর কেউ করে গেছেন দৈন্য-দুঃখ-ক্লেশের জীবন যাপন করে। যেমন রবীন্দ্রনাথ ছিলেন জমিদার পরিবারের সন্তান, নজরুল ছিলেন হত দরিদ্র পবিারের। বৈষয়িক জীবনের এই বৈসাদৃশ্য বাংলা সাহিত্যেও দুটি ধারা সৃষ্টি করেছে। কারও কলম থেকে বের হয়েছে রাজ-রাজরাদের জীবন কাহিনী কারও সাহিত্যে স্থানে পেয়েছে সাধারণ মানুষের জীবন সংগ্রাম, স্বপ্ন ও শুদ্ধতার প্রতি আকুতি।
যোগীন্দ্রনাথ সরকার তাঁর বুক সোসাইটি থেকে ‘খুকুমণির ছড়া’ (১৮৯৯) নামে একটি সঙ্কলন প্রকাশ করেছিলেন যা পৃথিবীর যে কোনো দেশের ‘নার্সারি রাইমস’ এর পাশে স্থান পাবার যোগ্য। মজার ব্যাপার হচ্ছে গ্রন্থভুক্ত ছড়াগুলোর রচয়িতার নাম পাওয়া যায় না। তখন লেখকরা নাম চাইতেন না, টাকাও চাইতেন না। ছোটদের জন্য লিখতে পেরেছেন এটাই ছিল তাদের আনন্দ। এসব ছড়া-কবিতা পরবর্তীতে অনেক সঙ্কলনে স্থানও পেয়েছে যোগীন্দ্রনাথ সরকারের নামে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে সে সময়টা ছিল আগ্রস্বার্থবাদ দিয়ে শিশুদের জন্য কিছু করার দুর্মর আনন্দ লাভের দিন।
উপেন্দ্র-যোগেন্দ্র বা যে কাজটি শুরু করেছিলেন তার ধারাবাহিকতায় উপেন্দ্র কিশোরের যোগ্য সন্তান সুকুমার রায় ছোটদের সঙ্কলন ‘সন্দেশ’ প্রকাশ করে শিশু সাহিত্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করলেন। সুকুমার রায়ের প্রতিষ্ঠিত ‘সন্দেশ’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে তৎকালে বহু বাঙালি শিশু-সাহিত্যিকের বিকাশ হয়েছে। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে সুকুমার রায়ের মৃত্যু হলে তাঁর সুযোগ্য ছেলে সত্যজিৎ রায় দীর্ঘ ত্রিশ বছর পর ‘সন্দেশ’ প্রকাশ শুরু করেন। [এই যে একটি ইতিহাস এখানে তুলে ধরলাম, এখানে আমাদের বাঙালি মুসলমানদের জন্য কি কিছু লিখনীয় নেই? হিন্দু বাঙালিরা আজ থেকে কয়েকশ’ বছর আগে তাদের শিশুদের জন্য সাহিত্য সৃষ্টির যে কাজটি অত্যন্ত আন্তরিকভাবে শুরু করেছিলেন, যার ফলে শিশুদের মানসগঠনে অজস্র লেখা, গ্রন্থ রেখে গেছেন এবং এখনো অন্যান্যরা অবিরাম করে যাচ্ছেন, সেই তুলনায় আমরা বাঙালি মুসলমানরা কতটুকু করতে পেরেছি? ইতিহাসের কাছে যদি ফিরে যাই, ১৭৫৭ সালের রাজ্য হারা হবার পর এবং পরবর্তী একশ বছর বিপর্যন্ত কাল এবং তৎপরবর্তী আরও একশ বছর সংগ্রাম, উত্থান বোধোদয় এবং বিজয় অর্থাৎ ১৯৪৭ পর্যন্ত সময়কাল বাদ দিয়েও গোটা ঊনিশ ও বিশ শতকের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বাঙালি মুসলমানদের যে ইতিহাস আমরা জানতে পারবো, তা মোটেও খুব উৎসাহব্যঞ্জক নয়। নজরুল যে ব্যাপারে আক্ষেপ করে বলেছিলেন- “কোন মুসলমান যদি তার সভ্যতা ইতিহাস ধর্মশাস্ত্র কোন কিছু জানতে চায় তা হলে তাকে আরবি-ফার্সি বা উর্দুর দেয়াল টপকাবার জন্য আগে ভালো করে কসরা শিখতে হবে। ইংরেজি ভাষায় ইসলামের ফিরিঙ্গি রূপ দেখতে হবে। কিন্তু সাধারণ মুসলমান বাংলাও ভাল করে শেখে না, তার আবার আরবি- ফার্সি।’’
এ ছিল পরাধীন সময়ের অবস্থা। কিন্তু ১৯৪৭-১৯৭১ এবং তৎপরবর্তী কাল থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ ৬৯ বছরের আমাদের বাঙালি মুসলমানদের অগ্রগতির ইতিহাসটা কতটুকু উজ্জ্বল? প্রশ্ন যখন করতেই হল জবাবটা সংক্ষেপে দিতে চাই। প্রকৃত অর্থে বাঙালি মুসলমান শিশুদের জন্য কিছু লেখক-কবি তাঁদের নিজস্ব রচনা দিয়ে শূন্যতা পূরণের জন্য চেষ্টা করেছেন মাত্র। বাঙালি মুসলমানদের শিশুরা যাতে তাদের নিজস্ব জগতে বেড়ে উঠতে পারে, তাদের মানস যাতে জীবন বিশ্বাসের অনুকূলে গড়ে ওঠে- তার জন্য আমাদের প্রচেষ্টা খুব সামান্যই এবং মুষ্টিমেয়। এক্ষণে কয়েকজনের নাম অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করতে চাই, তারা : কাজী নজরুল ইসলাম, গোলাম মোস্তফা, কায়কোবাদ, বন্দে আলী মিয়া, প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ, ফররুখ আহমদ, শাহেদ আলী, মোহাম্মদ নাসীর আলী প্রমুখ। নামের তালিকা আরো দীর্ঘ হতে পারতো। কিন্তু ব্যক্তি নাম উচ্চারণ এখানে উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য এ কথাটি জোর দিয়ে বলা : ছোটদের জন্য আমরা বাঙালি মুসলমানরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এখনো তেমন কিছু করতে পারিনি। আর এখনো তেমন উদযোগ চোখে পড়ার মতো নয়- বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা আগামী দিনগুলোর জন্য যদি প্রস্তুতি নিতে পারি সে আকাক্সক্ষা থেকেই লেখকের এই বিক্ষিপ্ত প্রয়াস। আমার দাবি : ছোটদের জন্য বই চাই। আরো আরো। চাই ছোটদের নিয়ে যারা ভাবেন, লিখেন তাদের সত্যিকার অর্থে পৃষ্ঠপোষকতা দান। আমার জানা মতে বহু লেখা, পাণ্ডুলিপি অনেক লেখক- কবিদের ঘরে বাক্সবন্দী হয়ে আছে যা পরবর্তীতে উইয়ের খোরাক হবে হয়তোবা। তাই বলছি- বাঙালি মুসলমানদের শিশুরা হা-পিত্যেশ করে বিদেশী ভাষা ও সাহিত্যের দিকে আর কত দিন হাত বাড়াবে?