চৌধুরী মুঈনুদ্দিনের ‘পৃথিবীর গোলাবের পথে ’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন

ইউরোপ প্রবন্ধ-কলাম বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

খ্যাতিমান চিন্তক ও সংগঠক, ষাটের দশকের সাহসী সাংবাদিক, সাড়া জাগানো লেখক চৌধুরী মুঈনুদ্দিনের ‘পৃথিবীর গোলাবের পথে’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেছেন, আত্মজীবনীমূলক এই গ্রন্থটি  ইতিহাস ও সাহিত্যের মেল বন্ধনে এক অনন্য সৃষ্টি।

গ্রন্থটি এবারের একুশে বই মেলায় প্রকাশিত হয়েছে। লেখক বিশ শতকের বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে সাবলিল ও সুখপাঠ্য ভাষায় তুলে ধরেছেন তাঁর শৈশব, রাজনীতি, সাংবাদিকতা ও নির্বাসনের অভিজ্ঞতা।  প্রকাশকের ভাষায়, এই চিরায়ত সত্য পাঠকের চৈতন্যে আরও একবার প্রকটিত করে তুলবে ‘পৃথিবীর গোলাবের বুকে’ চৌধুরী মুঈন উদ্দিনের আত্মজৈবনিক রচনার প্রথম খণ্ড। প্রায় আট দশকের বর্ণিল-বর্ণাঢ্য জীবন তাঁর।

প্রথম খণ্ডের সরস, রোমাঞ্চকর ও সুখপাঠ্য উপস্থাপনায় বিবৃত হয়েছে শৈশবের দুরন্তপনা, বয়ঃসন্ধি ও তারুণ্যের মধুর স্মৃতি, শিক্ষাজীবনের নানা পর্বে ঈর্ষণীয় প্রতিভা ও সাফল্যের গল্প, রাজনীতি-ভাবনা ও জীবনদর্শনের নানামুখী বিবর্তন, পেশাগত জীবনের নাটকীয় দাস্তান, উত্তাল সময়ের সাক্ষী হয়ে মনোজগতে যাপিত টানাপোড়নের ইতিকথা।

আটপৌরে স্মৃতিচারণই শুধু নয়, এ রচনায় দেখা মিলবে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বিলোকিত গ্রামবাংলার অপরূপা দৃশ্য। সাতচল্লিশ ও একাত্তরের মধ্যবর্তী ঘটনাবহুল দিনগুলোর সংক্ষিপ্ত অথচ সর্বাঙ্গীন স্কেচ তো বটেই, তৎকালীন পূর্ব বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসকেও দেখার সুযোগ করে দেবে নানা আঙ্গিক থেকে। সরেজমিন অভিজ্ঞতা আর সুদীর্ঘ অধ্যয়ন-গবেষণার সুষম সমাবেশ কখনও বা প্রণোদনা যোগাবে প্রচলিত বয়ানকে ভিন্ন আলোয় দেখার, কখনও প্রশ্নের মুখোমুখি করবে বহুলশ্রুত অনেক গল্প-কেই।

লন্ডনে  (২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) সৃজনশীল ও নান্দনিকতার  ছোঁয়ায় মোড়ক উন্মোচন  অনুষ্ঠান ছিল বেশ উৎসবমুখর। অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, গবেষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, আইনজীবী-সহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ।

অনুষ্ঠানে আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ রচনার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে লেখকের প্রতিক্রিয়া মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। আলোচনা পর্বে একঝাঁক নবীন ও প্রবীণের প্রাণখোলা কথামালায় উজ্জীবিত হয়েছেন লেখক এবং উপস্থিত গ্রন্থ-প্রেমী জনতা। বক্তারা বইটির ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন এবং একে ‘কবিতার ছন্দে লেখা গদ্য’ বলে অভিহিত করেন। ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য এটি একটি অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ বলেও আলোচকেরা অভিমত ব্যক্ত করেন।

‘পৃথিবীর গোলাবের পথে’ গ্রন্থের রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব তুলে ধরে ভূয়সী প্রশংসা করেন গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র লেকচারার ড. ফয়সাল তারিক, দৈনিক সময় ও মানব টিভির সম্পাদক সাঈদ চৌধুরী, লেখক ও গবেষক ড. কামরুল হাসান, ব্যারিস্টার ও সলিসিটর আসাদুজ্জামান, সাংবাদিক ও কমিউনিটি একটিভিস্ট মোজাম্মেল হোসেন, লেখক ও চ্যারিটি কর্মকর্তা এডিএম ইউনুস,  সাংবাদিক ও সংগঠক আব্দুল মুনিম জাহেদী, কমিউনিটি নেতা শাব্বীর আহমদ কাওসার, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ গবেষক নাজিব আব্দুল্লাহ প্রমুখ।

বক্তারা বলেন, এটি শুধুমাত্র একজন মানুষের আত্মজীবনী নয়, বরং ইতিহাসের এক প্রামাণ্য দলিল, যেখানে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক, নৃতাত্ত্বিক, ভাষাগত ও ধর্মীয় বৈচিত্র্যকে উপস্থাপন করা হয়েছে বেশ নৈপুণ্যের সাথে। তারা বইটির ভাষাশৈলীর প্রশংসা করে বলেন, বইটি কেবল তথ্যসমৃদ্ধ নয়, বরং অত্যন্ত শিল্পসম্মতভাবে রচিত ইতিহাস ও সাহিত্যের এক দুর্লভ সংমিশ্রণ।

‘পৃথিবীর গোলাবের পথে’ বইটিতে লেখক তার শৈশব থেকে কর্মজীবন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘটনাবলি বিশদভাবে তুলে ধরেছেন। চৌধুরী মুঈনুদ্দিন ১৯৪৫ সালে কলকাতার খিদিরপুরে জন্ম গ্রহন করেন। সেখানে তার বাবা ব্রিটিশ প্রশাসনের রাজস্ব বিভাগে চাকরি করতেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তাদের পরিবার নোয়াখালীর ফেনীতে চলে আসেন।

লেখক শৈশবের স্মৃতিচারণ করে লেখেন, ‘এই একটি সকাল, এই একটি দিনের সৌন্দর্য মুদ্রিত হয়ে থাকুক আমার হৃদয় ফলকে চিরকাল। ধন্য আমি জন্মেছি এই দেশে।’

গ্রামীণ প্রকৃতির অনন্য পরিবেশ ও পারিবারিক ঐতিহ্যের ছায়ায় বেড়ে ওঠা তার জন্য এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা তৈরি করেছিল। কৈশোরে এসে তার রাজনীতি ও ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। বাবার কাছ থেকেই তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, মুসলিম লীগের উত্থান এবং ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির জটিল ইতিহাস সম্পর্কে জানার সুযোগ পেয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ’গল্প-উপন্যাসের পাগল ছিলাম আমি। কিন্তু হৃদয় দিয়ে লেখা ভ্রমণ-কাহিনীর আকর্ষণ ছিল আরো তীব্র, আরো দুর্বার। হয়তোবা ভবিষ্যৎ অশ্রান্ত যাযাবর জীবনের প্রথম প্রতিশ্রুতি।’

কৈশোর থেকেই লেখালেখির প্রতি তার ঝোঁক তৈরি হয়, যা পরবর্তীতে তাকে সাংবাদিকতার পথে নিয়ে যায়। ১৯৬০-এর দশকে তিনি সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং সেখান থেকেই তিনি দেশের রাজনৈতিক পটভূমি কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান। পাকিস্তান সরকারের বৈষম্যমূলক নীতির বাস্তব অভিজ্ঞতা তার দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও শাণিত করে। তিনি লিখেছেন, ‘পশ্চিমারা পূর্ব পাকিস্তানকে কখনোই সমান চোখে দেখেনি। শাসকগোষ্ঠীর মানসিকতা ছিল উপনিবেশবাদী, তারা চেয়েছিল শোষণকে স্থায়ী করতে।’

এই সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের উত্থান, ছয় দফা আন্দোলন, ছাত্র গণজাগরণ এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ঘটনাবলির সরাসরি সাক্ষী হন চৌধুরী মুঈনুদ্দিন। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের ঐতিহাসিক সন্ধ্যায় চৌধুরী মুঈনুদ্দিন সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্বে শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির বাসায় উপস্থিত ছিলেন।

শেখ মুজিব তখনো বাড়িতেই ছিলেন, যদিও তার সেদিন প্রেসিডেন্ট হাউসে যাওয়ার কথা ছিল। চৌধুরী মুঈনুদ্দিনকে তিনি বলেন, ‘আলোচনা প্রায় ভেঙে গেছে, আমরা তাদের সর্বশেষ প্রস্তাবও নাকচ করে দিয়েছি। আজকের বৈঠক শুধু এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়ার জন্যই।’

কথোপকথনের এক পর্যায়ে চৌধুরী মুঈনুদ্দিন শেখ মুজিবের গাড়িতে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা লাগানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আর বলো না, ছেলেরা জোর করে লাগিয়ে দিয়েছে।’

চৌধুরী মুঈনুদ্দিন তখন প্রশ্ন করেন, ‘ছেলেরা নেতা, না আপনি নেতা? তারা জোর করে লাগিয়ে দিল আর আপনি সেটা উড়িয়ে প্রেসিডেন্ট হাউসে যাচ্ছেন, ইয়াহিয়া কি তাহলে বিশ্বাস করবে যে আপনি পাকিস্তান ভাঙতে চান না?’ শেখ মুজিব কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকেন, তারপর অভিমানের সুরে বলেন, ‘পশ্চিমারা বাঙালির অধিকার দেবে না। তাই আমি কী করব?’

বইটিতে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী আওয়ামী লীগের শাসনব্যবস্থার দিকটিও বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। লেখক দেখিয়েছেন, কিভাবে ১৯৭২-৭৫ সালের মধ্যে দলটি একদলীয় শাসনের দিকে অগ্রসর হয় এবং বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কার্যত ফ্যাসিবাদী রূপ ধারণ করে। তিনি লিখেছেন, ‘যে দল একসময় গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছিল, সেই দলই ক্ষমতায় আসার পর ভিন্নমত সহ্য করতে পারছিল না। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে দমন করার জন্য রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করা হতে লাগল।’

১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব বাকশাল গঠনের মাধ্যমে দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন, যেখানে বিরোধী দল নিষিদ্ধ হয়ে যায় এবং মাত্র চারটি সংবাদপত্র চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে চৌধুরী মুঈনুদ্দিন লিখেছেন, ‘বাকশাল কায়েমের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ কার্যত ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দল হয়ে উঠেছিল। বিরোধী দল, মুক্ত মতামত ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা একেবারে নিষিদ্ধ হয়ে গেল।’

অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে চৌধুরী মুঈনুদ্দিন বলেন, শেখ মুজিব যেদিন গ্রেফতার হন সেদিন তিনি আট ঘন্টা তার সাথে ছিলেন। তার জ্বালাময়ী বক্তব্য মানুষকে উদ্বেলিত করতো। তবে তিনি খুব সাহসী ছিলেন বলে মনে হয়নি। তার চরিত্রের মধ্যে নানারকম দ্বৈততা ছিল এবং তিনি পাকিস্তান ভাঙ্গতে চাননি।

অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে উপস্থিত অনেকেই গ্রন্থ সম্পর্কে লেখকের প্রতিক্রিয়া এবং বিশেষ ঘটনা প্রবাহের প্রেক্ষাপট জানতে চান। লেখকের সঙ্গে তারা বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় করেন। সাংবাদিক কামাল শিকদারের প্রাণবন্ত সঞ্চালনায় গোলাবের বৈচিত্র্যময় স্বাদ পেয়েছেন উপস্থিত সকলেই।  উপস্থিত সবাইকে  অংশগ্রহন এবং অভিমত প্রকাশের জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন লেখকের ছেলে সাকিব মুঈন।

চৌধুরী মুঈনুদ্দিন অধ্যয়ন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। ছিলেন তুখোড় ছাত্রনেতাও; অংশ নিয়েছেন সমকালীন সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে। কর্মজীবনে ছিলেন পূর্ব-পাকিস্তানের প্রথমসারির দৈনিক পূর্বদেশের স্টাফ রিপোর্টার। সত্তরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় তাঁর কলমের তুলিতে সর্বতোভাবে চিত্রায়িত হয়ে এসেছে দেশবাসীর সামনে।

সাহসী ও সংবেদনশীল সাংবাদিকতা তাঁকে এনে দিয়েছে দেশজোড়া খ্যাতি। উপজাত বস্তু হিসেবে এনেছে পেশাগত ঈর্ষাও। মিথ্যা ও অমূলক অভিযোগ মাথায় নিয়ে ছাড়তে হয়েছে প্রিয় মাতৃভূমি। সম্প্রতি ব্রিটিশ সুপ্রিমকোর্ট প্রকাশিত এক রায়ে সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের অসারতা এবং বাংলাদেশের বিতর্কিত আইসিটি থেকে জারিকৃত মৃত্যুদণ্ডের ভিত্তিহীনতা। পাঁচ দশকের প্রবাসজীবনও অক্লান্ত কর্মমুখর। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অসংখ্য সামাজিক, ধর্মীয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান-সংগঠনের গোড়াপত্তন-বিকাশ তাঁর হাত ধরে। অবদান রেখেছেন কূটনৈতিক অঙ্গনেও। অধুনা অবসরজীবনে নিয়মিত লিখছেন একাধিক জার্নালে।

চৌধুরী মুঈনুদ্দিন ইন্টারন্যাশনাল স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মুসলিম এইড-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠা, যুক্তরাজ্য ইসলামিক মিশনের প্রাণপুরুষ, দাওয়াতুল ইসলাম ইউকে এন্ড আয়ারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ইউরোপের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান লন্ডন মুসলিম সেন্টার ও ইসলামী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান মার্কফিল্ড ইনস্টিটিউট-সহ বহু প্রতিষ্ঠানের সফলতা ও বিকাশের ক্ষেত্রে তিনি নেতৃপুরুষ হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *