সাঈদ চৌধুরী
সিনিয়র সাংবাদিক, ছড়াকার ও গীতিকার অজয় পাল চলে গেছেন না ফেরার দেশে। শনিবার (৭ জানুয়ারি ২০২৩) সন্ধ্যারাতে রয়েল লন্ডন হাসপাতালে তিনি ইহত্যাগ করেন। গত বুধবার ‘ব্রেইন স্ট্রোক’ হলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার মৃত্যুতে পরিচিত মহলে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
লন্ডনের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক সুরমার সাবেক ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক অজয় পাল বিভিন্ন সময়ে যুগভেরী, বাংলার বানী, সংবাদ এবং বাংলা বাজার পত্রিকায় যুক্ত ছিলেন। এছাড়া দেশ-বিদেশের অনেক কাগজে তিনি লিখতেন।
অজয় পাল ছিলেন সিলেটে আধুনিক সাংবাদিকতার অন্যতম পুরোধা। সেই তরুণ বয়সে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ঝুঁকিপূর্ণ সাংবাদিকতার মাধ্যমে তিনি অকুতোভয় ও আপোষহীন কলমযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত হন।
সংবাদ সংগ্রহ ও প্রতিবেদন তৈরীতে অজয় পাল বিশেষ কৌশলি ছিলেন। রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি, অর্থনৈতিক অনিয়ম কিংবা দুর্নীতির তদন্ত প্রতিবেদন তৈরীতে অগ্রগণ্য ছিলেন। অপরাধমূলক গোপন ক্রিয়াকলাপের তথ্য প্রকাশ করা, রিপোর্টিং থেকে শুরু করে মতামত বিশ্লেষণ, মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও চিন্তা ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে সংবাদের বিষয়বস্তু নির্ধারণ, সংবাদের শিরোনাম ও কনটেন্টের বৈচিত্র্য সৃষ্টি ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরিশ্রম, নিষ্ঠা ও বুদ্ধিদীপ্ততায় নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।
সিলেটে জাতীয় দৈনিকের প্রতিনিধিদের মধ্যে বাংলা বাজার পত্রিকায় অজয় পাল ও ইনকিলাবে হেলাল উদ্দীন রানা আমার সিনিয়র হলেও যথেষ্ট ঘনিষ্ট ছিলেন। সিলেটে আমাদের অফিস ছিল। নব্বই দশকে সিলেটের সাংবাদিকতায় আমরা একঝাক প্রশিক্ষিত উদ্যমী সংবাদকর্মী ছিলাম। ১৯৯৩-৯৪ সালে সিলেট প্রেস ক্লাবের নির্বাহী পরিষদে অজয়দা ও রানা ভাই সহ আমরা ছিলাম একসাথে।
জাতীয় দৈনিকে প্রতিদিন খবর প্রদানে আমাদের এক ধরণের প্রতিযোগিতা ছিল। আমরা একই সাথে স্থানীয় কাগজেও কাজ করেছি। তখন সিলেটের সংবাদপত্রেও ঘটে যায় নীরব বিপ্লব।
১৯৯৬ সালে সিলেট-১ আসনের প্রার্থী হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর সাক্ষৎকার নিয়েছিলাম এক সাথে। অজয় দা বাংলাবাজার পত্রিকায় আর আমি দৈনিক সংগ্রামে পাঠাই। আমারটা আগে ছাপা হওয়ায় তাঁর একটু মন খারাপ হয়েছিল। পরে অবশ্য আমাদের সম্পর্ক আন্তরিকতাপূর্ণ হয়েছে। সেবার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী এমপি হয়ে জাতীয় সংসদের স্পিকার হয়েছিলেন।
২০০১ সালে অজয় পাল কিউবার হাভানায় অনুষ্ঠিত ১০৫তম ইন্টার পার্লামেন্টারি কনভেনশনে জাতীয় সংসদের একটি প্রতিনিধি দলের সাথে যুক্ত ছিলেন । ইউএনডিপির মাধ্যমে হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী সে ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। আমি তখন লন্ডন চলে এসেছি।
এর কিছুদিন পরে অজয় পাল লন্ডনে চলে আসেন। এখানে আমরা আরো ঘনিষ্ট হই। আমার সংবাদ সংস্থা ‘মিডিয়া মহলে’ প্রায়ই আসতেন তিনি। বহুদিন একসাথে মধ্যান্ন ভোজন করেছি। আমার সময়, বাংলা ডাইরেক্টরি, রেষ্টুরেন্ট ডাইরেক্টরি ইত্যাদিতে তার সহায়তা ও অনুপ্রেরণায় আমি বার বার মুগ্ধ হয়েছি।
সর্বশেষ ২০২২ সালের ২ এপ্রিল তিনি আমার গল্পগ্রন্থ ‘আলোক ঝরনাধারা’ নিয়ে অসাধারণ একটি লেখা উপহার দিয়ে আমাকে কৃতজ্ঞতা পানে আবদ্ধ করেছেন। https://www.facebook.com/sayed.chowdhury.77/posts/10209007019048917
অজয়দার একটি উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য হল, তিনি শুধু বড় মাপের সংবাদিক নন, একজন সাদা মনের মানুষ ছিলেন। সাংবাদিকতায় কখনো হীনমন্য ছিলেন না। খবরের তথ্য শেয়ার করতে সংকুচিত হতেন না। তিনি রপ্ত করেছিলেন চমৎকার ভাষাবৈভব। তার প্রতিবেদনে নান্দনিক ও বৈচিত্রময় উপমার ব্যবহার ছিল লক্ষণীয়।
মাঠ পর্যায় থেকে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশ সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। সাংবাদিকতা পেশায় সত্য প্রকাশ তাকে বারবার বিপদে ফেলেছে। যে কোন ঝুঁকিপুর্ণ পরিস্থিতিতেও তিনি সাহসী এবং আধুনিক ধারার সাংবাদিক হিসেবে আলাদা জায়গা করে নিয়েছেন।