চতুর বন্ধুরা “শুদ্ধিঅভিযান” চালাচ্ছেন । ইসমাঈল হোসেন দিনাজী

সময় চিন্তা
শেয়ার করুন
বাংলাদেশসহ এ উপমহাদেশের মানুষের মধ্যে অসংখ্য-অগণিত আরবি তথা পবিত্র কুরআনের শব্দ প্রচলিত আছে। এছাড়া উর্দু, ফার্সি, হিন্দি, পশতু, পাঞ্জাবি ভাষারও অনেক শব্দ বাংলাভাষার সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছে। আরবিসহ হিন্দি, ফার্সি, উর্দু ভাষার সঙ্গে ভারত ও পাকিস্তানের অনেকেরই গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। ভারতের বিরাট অংশজুড়ে যেমন হিন্দি ও উর্দুর রাজত্ব রয়েছে, তেমন পাকিস্তানে উর্দুর সাম্রাজ্য বিদ্যমান। ভারত ও পাকিস্তানে হিন্দি এবং উর্দুর সঙ্গে আরও বহু ভাষা বেশ দাপটেই চালু আছে। বাংলাদেশে উর্দু কিংবা হিন্দির প্রচলন না থাকলেও অনেকে হিন্দি ও উর্দু কিছুটা বোঝেন। এছাড়া আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে হিন্দি-উর্দুর প্রভাব তরুণদের মাঝে বেশ লক্ষ্য করবার মতো। বলা যায়, বাংলাদেশের তরুণসমাজে উর্দু বিশেষত হিন্দির আগ্রাসনই চলছে। তবে এনিয়ে আমাদের চেতনাজীবীদের তেমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নেই। তাঁরা চিন্তিত বাংলাভাষার সঙ্গে যুগযুগান্তর ধরে কেবল কুরআন তথা আরবি ভাষার কিছু শব্দ মিশে থাকা নিয়ে। তাঁরা তাই কুরআনের ভাষাকে বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করতে জানফানা করে দিতে প্রস্তুত।
বাংলাভাষায় অগণিত আরবি শব্দ ঢুকেছে। মিশে গেছে বাঙালির অস্থি-মজ্জায়। শুধু তাই নয়, বাংলাসহ আশপাশের আরও অনেক দেশের ভাষায় আরবি শব্দ ঢুকে একাত্ম হয়ে গেছে। বিশেষত বাংলাভাষীরা বুঝতেও পারে না যে, এগুলো আরবি বা বিদেশি শব্দ। যেমন: আল্লাহ, রসুল, কিতাব, কুরআন, সালাম, কালাম, রহমত, নিয়ামত, কুদরত, খিয়ানত, আইন, আদালত, দলিল, দহলিজ, ফজিলত, মসজিদ, মাদরাসা, ইমাম, ঈমান, কিয়ামত, ইকামত,, বরকত এরকম আরও অসংখ্য আরবি শব্দ সরাসরি বাংলাভাষায় একাত্ম হয়ে রয়েছে যেগুলোকে এদেশের মানুষ কখনই বিদেশি মনে করেন না। বরং এগুলোকে বাংলায় অনুবাদ করে চালু করতে চাইলে তা অনেকের কাছেই বিদেশি বা অচেনা ভাষায় পরিণত হবে।
আমাদের দেশের প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ নাগরিক মুসলিম। এ বিপুল সংখ্যক মানুষ জন্মগতভাবে বাঙালি হলেও বিশ্বাসবোধ তথা ঈমান-আকিদার দিক থেকে স্বতন্ত্র আদর্শের ধারক। এক আল্লাহ এদের রব বা ইলা। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) এদের পথপ্রদর্শক। এরা মুসলিম বা আল্লাহর কাছে আত্মসর্পনকারী। প্রকৃত মুসলিমরা আল্লাহকে রব হিসেবে বিশ্বাস করেন। হযরত মুহাম্মদ (স)কে নবী হিসেবে মানেন। এর বাইরে যাবার তাদের কোনও উপায় নেই। মুসলিমরা দিনে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করেন। রমযানের সিয়াম পালন করেন। সামর্থবানরা কা’বা শরিফ গিয়ে হজ সম্পন্ন এবং নিসাব পরিমাণ অর্থ জমা থাকলে বছরে একবার জাকাত প্রদান করেন। এগুলো মুসলিমদের অবশ্য করণীয়। এসবের অন্যথা করলে কেউ মুসলিম বলে নিজেকে দাবি করতে পারেন না। অবশ্য সালাত নেই, সিয়াম নেই, জাকাত দেবার মতো অর্থ থাকলেও তা আদায় করেন না এমন নামকাওয়াস্তে মুসলিমের অভাব নেই এদেশে। ঠিক তেমনই সারা রমযানে সিয়াম পালন করেন না একদিনও অথচ ঈদের কেনাকাটার ধূম পড়ে যায়। ভিড়ের চোটে সিয়ামপালনকারীরা বাজারে ঢুকতে পারেন না।
বলছিলাম, মুসলিমদের ভাষা হবে প্রধানত তাঁদের ঈমান, আকিদা মাফিক। একজন মুসলিম কখনও তাঁর বিশ্বাসবোধের বাইরে গিয়ে কোনও ভাষা অপ্রয়োজনে প্রয়োগ করেন না। যেমন: আল্লাহর কোনও প্রতিশব্দ নেই। হয় না। কোনও মুসলিম যদি আল্লাহর পরিবর্তে ভগবান, ঈশ্বর, খোদা, প্রভু, সৃষ্টিকর্তা ইত্যাদি শব্দ প্রয়োগ করে বোঝাতে চান তাহলে কি হবে? হবে না। এমনটি করলে তা হবে আত্মঘাতী। এতে বিভ্রান্তি সৃষ্টিসহ নানা সামাজিক সমস্যার সূচনা হতে পারে। তেমনই ঈমান, সালাত, সিয়াম, হজ, তাহরাত ইত্যাদি শব্দমালা দ্বারা যা বোঝেন তা অন্য শব্দমালা যেমন; বিশ্বাস, উপাসনা, উপবাস ইত্যাদি শব্দ দিয়ে সেগুলো বোঝানো মুশকিল। এছাড়া এমন শব্দান্তরে অর্থবিভ্রাট এবং ভুল বোঝারও অবকাশ থেকে যাবে। তাই বলে মুসলিমরা অন্য ভাষাচর্চা করতে পারবেন না এমন নয়। অন্যদের মতো তাঁরাও প্রয়োজনে যেকোনও ভাষাচর্চা করতে পারেন।
বাংলাদেশসহ আশপাশের প্রায় সবদেশের নিরক্ষর লোকও ঈমান, আমান, ইবাদত, সালাত, হজ, জাকাত, কিতাব, মসজিদ, মাদরাসা, মকতব, মজুদ, ইত্যাদি আরবি শব্দ বোঝেন। এমনকি অমুসলিমদেরও এসব আরবি শব্দ বুঝতে অসুবিধে হয় না সাধারণত।
উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, অনেক বুদ্ধিজীবী, গায়ক-গায়িকা, লেখক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক আল্লাহ শব্দ উচ্চারণ করতে চান না যদিও তাঁরা নামে মুসলিম। আল্লাহ নামের মধ্যে তাঁরা যেন সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা খুঁজে পান। তাই তাঁরা “আল্লাহ” বলেন না। বলতে দ্বিধা করেন। বলেন সৃষ্টিকর্তা, স্রষ্টা, প্রভু। এইতো সেদিনও এক চিত্রনায়ক এবং এক গায়িকা টিভিতে আল্লাহর স্থলে বললেন সৃষ্টিকর্তা। এমনটা শুধু একজন গায়িকা বা নায়িকা নন; প্রায়ই সবার মধ্যেই এ আত্মঘাতী প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। মানে আল্লাহ এ মহানাম যাতে ধীরে ধীরে এদেশের মানুষ ভুলে যায় তেমন উদ্যোগই নেয়া হয়েছে। আর এটা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ।
দাদা-বাবারা মুসলিম। মা-দাদিরাও মুসলিম। আল্লাহ শব্দটা মুসলিমশিশুরা বংশানুক্রমে শেখে। প্রতিদিন মসজিদে সালাতের জন্য আযান হয়। সেখান থেকেও আল্লাহ শব্দ শুনে শুনে শেখে। কিন্তু সেসব শিশুই বড় হয়ে আল্লাহর স্থলে শেখে সৃষ্টিকর্তা, প্রভু। এর মানে হচ্ছে আল্লাহ তথা মুসলিমদের ব্যবহৃত শব্দগুলো ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা চালানো হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক এবং পরিকল্পিভাবে। এছাড়া পাঠ্যপুস্তকেও যুগযুগ ধরে মুসলিমদের ব্যবহৃত শব্দগুলো বাদ দিয়ে অমুসলিমদের ব্যবহৃত শব্দসমূহ ঢোকানো হচ্ছে। এনিয়ে কথা হচ্ছে বটে। কিন্তু কেউ কান দিচ্ছেন না।
পাঠ্যবই, গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, সিনেমা, ওডিও, ভিডিও, ফেসবুকসহ সবকিছু ব্যবহার করছেন মুসলিমবিদ্বেষী সেকুলার সংস্কৃতির সেবাদাসরা খুব সতর্কতার সঙ্গে। তাঁরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ কালচারাল ইন্সটিটিউটগুলো প্রায় দখল করে নিয়েছেন। তাঁরা এখান থেকে বেতনভাতা নেন আবার দেশের বাইরে থেকেও তাঁদের কাজের জন্য মোটা অংকের নিয়মিত মাসোহারা পেয়ে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এজন্য তাঁরা বাপ-দাদার বুলি বাদ দিয়ে প্রভুদের শেখানো বুলি অনায়াসে আত্মস্থ করে নিয়েছেন। আল্লাহ ছেড়ে সৃষ্টিকর্তা, প্রভু ভগবান, ঈশ্বর ইত্যাদি বলবার এ হচ্ছে রহস্য। উল্লেখ্য, ‘খোদা’ শব্দটিও আরবি বা কুরআনের ভাষা নয়। অথচ এটিকে আমরা সিংহভাগ লোক মহান আল্লাহর প্রতিশব্দ বলে মনে করি।
পৃথিবীতে লাখ লাখ জনগোষ্ঠী ও জনপদ বা তাদের নিজস্ব এলাকা আছে। তাদের স্বতন্ত্র ভাষাও আছে। প্রত্যেক ভাষায় যদি আল্লাহর মানে “আল্লাহ” শব্দের অনুবাদ হয় তাহলে অবস্থা কী হবে বুঝতে পারছেন? স্রষ্টা, ক্রিয়েটর, গড, ঈশ্বর, প্রভু, ভগবান, পালনকর্তা, মারণকর্তা, ত্রাতা, রক্ষক, দয়াময়, করুণাময় এমন অসংখ্য অগণিত নামশব্দ পাওয়া যাবে। অথচ এগুলোর কোনও একটি শব্দ দিয়ে সঠিকভাবে “আল্লাহ” বোঝানো কঠিন হয়ে যাবে। এছাড়া আল্লাহর অনেক সিফাতি বা গুণবাচক নাম রয়েছে। আল্লাহ হচ্ছে তাঁর জাত বা এবস্যুলিউট নাম। এ নামের ক্ষয় নেই। ভঙ্গুরতা নেই। আল্লাহর আর যতো নামই দেয়া হোক না কেন, কোনওটাই নিরঙ্কুশ বা নিত্যসত্তাবিশিষ্ট নয়। তাহলে কেন আল্লাহনাম বাদ দেবার মতো ধৃষ্টতা দেখাবো আমরা?
আসলে আল্লাহ ও রসুল (স) এর পথ বা আদর্শ থেকে সরিয়ে নেবার জন্য নানারকম আগ্রাসন চালানো হচ্ছে। ফন্দিফিকির চলছে। বলা হচ্ছে, আরবিভাষা বিদেশি। তাই বেছে বেছে কুরআন তথা ইসলামী পরিভাষার শব্দগুলো বাদ দেয়া হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে সেগুলো বিকৃত করে উপস্থাপন করা হচ্ছে। আর এ মহান (!) কাজে অবদান রাখছেন জন্মসূত্রে মুসলিমরাই। রেডিও-টিভির খবর পাঠেও চালানো হচ্ছে একই ‘শুদ্ধি অভিযান’। পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন অবশ্য অন্যরা। আমরা টের পাচ্ছি না। আমাদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। আমরা যেন ঔদার্যের ডালি মেলে ধরে আছি। মহানুভবতা দেখাচ্ছি। ভাড়ার খালি হয়ে যাচ্ছে। শূন্যতার ব্যাস কেবলই বৃদ্ধি পাচ্ছে। চতুর বন্ধুরা খুব সন্তর্পণে “শুদ্ধিঅভিযান” পরিচালনা করছেন। আমরা ঘুমোচ্ছি।
ইনসেট
পাঠ্যবইয়ে ‘আল্লাহ’ শব্দ বাদ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে ‘সৃষ্টিকর্তা’, ‘প্রভু’। নাটকে, সিনেমায়ও তাই। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার খবরপাঠেও একই “শুদ্ধিঅভিযান” চালানো হচ্ছে। আমরা যেন ঔদার্যের ডালি মেলে ধরে আছি। মহানুভবতা দেখাচ্ছি। ভাড়ার খালি হয়ে যাচ্ছে। শূন্যতার ব্যাস কেবলই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা ঘুমোচ্ছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *