পৃথিবীতে অনেক মানুষের মৃত্যুদণ্ড হয়। কেউ অপরাধ করলে তার শাস্তি হওয়া স্বাভাবিক। তবে সত্যিকার অপরাধী না হয়েও অনেকের মৃত্যুদণ্ড হয়। তাও হয় সেটা বিচার নামক প্রহসনের মাধ্যমে। এমন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটছে পৃথিবীতে প্রায়শই। তবে এ রকম অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটছে বেশি রাজনৈতিক কারণে। যে প্রতিদ্বন্দ্বীকে অপ্রতিরোধ্য মনে করা হয় তাকে ফাঁসিয়ে দেয়া ক্ষমতাধরদের জন্য যেন ফরজ বা অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। অন্যথায় ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা অসাধ্য হয়ে পড়ে।
সুদানের খার্তুম সেন্ট্রাল জেল। এখানেই কর্মস্থল জবানবন্দি প্রদানকারী কারারক্ষীর। তিনি নিজ জবানবন্দিতে বলছেন: একদিন খাবার দিতে গিয়ে দেখি, তিনি সেলের এক কোণে জায়নামাযে বসে আছেন। আমার পায়ের আওয়াজ শুনে চোখ তুলে তাকালেন।
দু’চোখ ভেজা। শান্ত স্বভাব। খুব ধীরস্থির। মনে হলো, ধ্যানমগ্ন ছিলেন তিনি।
হ্যাঁ, মৃত্যদণ্ড প্রাপ্ত আসামীদের এ সেলেই নিয়ে আসা হয়। আর আমার মতো যাদের হৃদয় পাথরের মতো শক্ত, তাদেরই এ সেলে পাহারায় নিযুক্ত করা হয়ে থাকে।
আসামি আবদুল বাতিনের বিরুদ্ধে মামলা খুবই শক্ত। খুনের আসামি তিনি। নিম্ন আদালতে মৃত্যদ-ের আদেশ হয়েছে। এখন উচ্চ আদালতে রায় বহাল থাকলেই তাঁর ফাঁসি কার্যকর করা হবে।
কারারক্ষী আরও বলেন: আসামির প্রতি আমার আচরণ যত কঠোর। তাঁর আচরণ ঠিক ততোই কোমল। আমার সুদীর্ঘ তিন দশকের কারারক্ষী জীবনে অনেক খুনিকে দেখেছি। খুনির চোখ দেখে চেনা যায়। কিন্তু তাঁর চোখ দুটো বড়ই নিষ্পাপ।
তিনি আমাকে সালাম দেন। সজল চোখেও একটু স্মিথ হাসেন। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এমন নরম স্বভাবের একজন মানুষ এ রকম ভয়ঙ্কর খুনি হতে পারেন।
আমি সরাসরি জিজ্ঞাসা করি: খুনটা আপনি কেন করলেন?
তিনি কুরআন শরীফ থেকে সুরা মায়েদার একটা আয়াত আরবিতে পাঠ করে বলেন, নিরপরাধ কোনও ব্যক্তিকে কেউ হত্যা করলো, মানে সে যেন দুনিয়ার সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে হত্যা করলো; আর কেউ কারও প্রাণরক্ষা করলো মানে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানবগোষ্ঠীর প্রাণরক্ষা করলো। এরপর তিনি বলেন, তিরমিজিতে একটা হাদিস আছে, ‘দুনিয়া ধ্বংস করে দেয়ার চেয়েও আল্লাহর কাছে ঘৃণিত কাজ হলো মানুষ হত্যা করা।’
তাই মানুষ খুনের মতো এমন নৃশংস, জঘন্য অপরাধ আমি কেমন করে করতে পারি! তাঁর কণ্ঠ ভারাক্রান্ত হয়।
জীবনের বায়ান্ন বছর বয়সে এ প্রথম বুঝতে পারি আমার মতো পাথরহৃদয়ের মানুষের মনও নরম হয়।
আচ্ছা তাহলে এ খুনের মামলায় প্রধান আসামি হিসাবে আপনি জড়িয়ে পড়লেন কেমন করে?
ঘটনা সত্য। একজন প্রভাবশালী মানুষ খুন হয়েছে এবং কাকতালীয়ভাবে এ খুনের ঘটনা থেকে আমি মাত্র কয়েক কদম দূরে ছিলাম। যারা খুন করেছে তারা আরও প্রভাবশালী। আর আমার মতো এক দুর্বল মানুষকে ফাঁসিয়ে দিয়ে ওরা বেঁচে গেছে আর নিয়তি আমাকে এ নির্জন সেলে নিয়ে এসেছে।
আপনার আত্মীয়-স্বজনরা কোনও চেষ্টা করেনি? উকিলরা আপনার পক্ষে দাঁড়ায়নি?
ওরা যে যেভাবে পারে চেষ্টা করছে। আমাকে বাঁচাতে একটুকরো ভিটে ছিল, সেটা বিক্রি হয়েছে। বউ ছোট দুই সন্তান নিয়ে গৃহহীন হয়েছে। বৃদ্ধা মা আগে থেকেও কম দেখতেন। আমার জন্য কাঁদতে কাঁদতে বৃদ্ধ মায়ের চোখ দুটো এখন আর আলো দেখে না। কিন্তু বিচার, কোর্ট, আদালত, সমাজ, সংবাদ এসবতো আমার মতো দুর্বলের পক্ষে নয়। তাই, আমার যত দ্রুত ফাঁসি হবে, ওরা সবাই তত দ্রুত বেঁচে যাবে। কিন্তু আমি জানি আমি নির্দোষ। তাই উচ্চ আদালতে আমি পিটিশন দায়ের করেছি। আমার উচ্চ আদালত হলো মহান আল্লাহ। তিনি সবচেয়ে উত্তম পরিকল্পনাকারী। আমার নিয়তিতে যদি ফাঁসি লেখা থাকে সেটা হবে। আর যদি আমার মুক্তি লেখা থাকে তবে সেটাও হবে। আমার জীবন এবং মৃত্যুর মালিক একমাত্র আল্লাহ। সবকিছুই আমি আমার রবের ওপর ছেড়ে দিয়েছি।
পরদিন তাঁর স্ত্রী দুই পুত্রসহ তাঁর মাকে নিয়ে দেখা করতে আসেন। সবাই একনাগাড়ে কাঁদছেন। বৃদ্ধা মায়ের হাত দুটো ছেলের মুখের ওপর হাতড়ে বেড়াচ্ছে। মা ছেলের মুখে, ঠোঁটে, গালে, মাথায় চুমু খাচ্ছেন। পিতা চুমু দিচ্ছেন তাঁর নিষ্পাপ দুটো সন্তানের মুখে। সুদীর্ঘ সময়ের কারারক্ষী জীবনে এ প্রথম আমার চোখ দিয়ে পানি পড়লো। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো।
তিনি মাকে বলেন, মা পিটিশনতো দিয়ে রেখেছি। উচ্চ আদালতে। আল্লাহর আরশে। এ যে আমার মুখের সঙ্গে তোমার লেগে থাকা হাত দুটো যত কাছে। তিনি তার চেয়েও কাছে মা। তিনি খুব কাছে। তিনি সব দেখছেন মা। কোনও কিছুই তাঁর পরিকল্পনার বাইরে নয়। আমি আমার দুটো অবুঝ সন্তানের মতো নির্দোষ আর নিষ্পাপ মা।
আল্লাহর ওপর বিশ্বাস কী তা আমি অনেক পড়েছি। অনেক গল্প শুনেছি। কিন্তু এমন দৃঢ় বিশ্বাস জীবনে এ প্রথম দেখলাম।
কয়েকদিন কেটে গেল। যখনই খাবার দিতে যাই। দেখি তিনি জায়নামাযে আছেন। অথবা সিজদায় পড়ে রয়েছেন। হাইকোর্টে চূড়ান্ত রায় নিষ্পত্তির আগে এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে।
যেলোক এ নিরপরাধ মানুষটিকে খুনের মামলায় জড়িয়েছিল, তার গাড়ি এক মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়ে। ঘটনাস্থলেই স্ত্রী, পুত্র মারা যায়। অজ্ঞান অবস্থায় দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। কয়েক ঘণ্টাপর তার জ্ঞান ফিরে আসলে সে জানতে পারে, দুর্ঘটনায় তার স্ত্রী-পুত্র মারা গেছে। এটা শোনার পর তার অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। সে বুঝতে পারে জীবনের সবকিছু দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। ধন, দৌলত, ঘরবাড়ি, ক্ষমতা কোনওকিছুই তার আর কাজে লাগবে না। যেকোনও সময় সে মারা যাবে। তাই নিজে খুন করে আরেকজনকে খুনের মামলায় ফাঁসিয়ে সে আল্লাহর কাছে এতো বড় পাপ নিয়ে যাবে কেমন করে? সেখানেতো আর কোনও কোর্ট, হাইকোর্ট নেই। হয়তোবা জীবনে সে এমন কোনও কল্যাণ করেছে যার জন্য আল্লাহ তাকে একটা শেষ সুযোগ করে দিয়েছেন। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে সে চিৎকার করে বলতে থাকে, সবমিথ্যা, সবমিথ্যা। সত্য হলো, আব্দুল বাতিন নির্দোষ। আর আমিই সেই খুনি।
লোকটির স্বীকারোক্তি কোর্টে পৌঁছানো হলে কোর্ট আব্দুল বাতিনকে বেকসুর খালাস দেয়। কারারক্ষী আরও বলেন, কোর্টে দাঁড়িয়ে বুঝলাম, যারা নির্দোষ আর যারা গভীরভাবে আল্লাহকে বিশ্বাস করে আল্লাহ তাঁদের এভাবেই রক্ষা করেন। তাঁকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে আমি বলি, কারারক্ষী হিসাবে আমার চাকরিরও শেষদিন ঘনিয়ে আসছে। আমাকে আপনি এমন কিছু বলুন যা আমি সারাজীবন মনে রাখতে পারি।
তাঁর কথাগুলো হুবুহু নীচে তুলে ধরা হলো:
আল্লাহর চেয়ে আপনজন আর কেউ নেই। জীবনের কঠোর সংকটময় দুঃসময়ে শুধু নয়, যেকোনও সময় তাঁর কাছে চান এবং হৃদয় দিয়ে বিশ্বাস করুন তিনি আপনার ডাক শুনছেন।
আল্লাহ শুধু একটা নাম বা ইমাজিনারি সত্তা নন। তিনি এক জীবন্ত বাস্তবতা। ঘাড়ের শিরার চেয়ে তিনি মানুষের সন্নিকটে। আর আল্লাহ এমনভাবে মানুষকে সাহায্য করেন, পৃথিবীর কোনও উইসডম দিয়ে তার ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।
আব্দুল বাতিন দু’হাতে তাঁর দু’সন্তানকে ধরে হাঁটছেন। পেছনে স্ত্রী আর মা। কারারক্ষী বলেন, “আমি বিস্ময়ভরা চোখে যেন আল্লাহর এক অলৌকিক নিদর্শন দেখলাম। খার্তুমের কোর্টে সেদিন আমি শুধু আব্দুল বাতিনের ঈমান দেখিনি। আমি শুধু তাঁর দু’আর শক্তি দেখিনি। একজন নিরপরাধ মানুষের অলৌকিক মুক্তি দেখিনি। এ দিন আমি নতুন করে মুসলিম হয়েছি। ঈমান এনেছি। এ দিন আমি আমার আল্লাহকে নতুন করে খুঁজে পেয়েছি।”