(গতকালের পর)
১৮. টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা
২০১৫ সালে জাতিসঙ্ঘের ১৯৩টি সদস্য দেশ টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে। ২০৩০ সালের মধ্যে এ লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার অনেকগুলোই কৃষিতে উৎপাদনশীলতা ও খাদ্য উৎপাদনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কিত। নির্ধারিত সময়ে এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে বাংলাদেশে প্রান্তিক চাষিদের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে হবে। চাষিদের শুধু যে অতিরিক্ত ফসল উৎপাদন করতে হবে তা নয় বরং আবহাওয়া পরিবর্তনজনিত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে মোট উৎপাদন বাড়াতে হবে। অধিক খাদ্য উৎপাদনে প্রয়োজন হবে উন্নতমানের বীজ ও অন্যান্য উপকরণের সহজলভ্যতা। একমাত্র বীজ কোম্পানিগুলো এ ব্যাপারে প্রান্তিক চাষিদের সহযোগিতা করে অধিকতর উৎপাদনে অনন্য অবদান রাখতে পারে। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদনে নিয়োজিত চাষিদের ৯৯ শতাংশই প্রান্তিক চাষি, বলা যায় শতভাগ।
১৯. টেকসই কৃষি উৎপাদন
টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সাথে সমন্বয় সাধন করে হাতে হাত মিলিয়ে মুখ্য ভূমিকা পালনে বাংলাদেশের বীজ খাত এখনো সামর্থ্য অর্জন করেনি। অথচ ১৭টি এসডিজির অন্তত আটটির অর্জনে বীজ খাতকে কোনো না কোনোভাবে অবদান রাখতে হবে। দারিদ্র্য থেকে মুক্তি, ক্ষুধাহীনতা, সুস্বাস্থ্য এবং সুস্থতা, গ্রহণযোগ্য কাজ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি; উদ্ভাবন, দায়বদ্ধ ভোগ এবং উৎপাদন; ভালো জীবনযাপন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব প্রতিরোধে কর্মপ্রক্রিয়ায় অংশীদারিত্ব, এসব লক্ষ্য অর্জনে কোনো না কোনোভাবে কৃষিকার্যক্রম, কৃষি উৎপাদনশীলতা ও কৃষি খাতের অবদান জড়িত। যেমন- বলতে গেলে এসডিজি অর্জনের সাথে বীজ খাতের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। আগেই বলা হয়েছে, বীজ খাত হলো কৃষি উৎপাদনশীলতার প্রাথমিক কেন্দ্রবিন্দু।
বিরল লভ্য প্রাকৃতিক সম্পদের কার্যকর ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রান্তিক চাষিরা ক্রমবর্ধিত জনসংখ্যার জন্য ক্রমবর্ধিত হারে খাদ্য (কেবল চাল নয়) উৎপাদন করতে হবে। এটা করতে হবে পরবর্তী প্রজন্মের স্বার্থ রক্ষা করে। সে জন্য দেশের আবহাওয়া উপযোগী। জনসমষ্টির খাদ্যাভ্যাসের সাথে তাল মিলিয়ে প্রয়োজনীয় ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করা একান্ত প্রয়োজন। অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের আজকের কর্মকাণ্ডে যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আমাদের প্রজন্ম, আগের সব প্রজন্মের মতোই, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে দায়বদ্ধ।
২০. টেকসই উৎপাদনে বীজ খাতের ভূমিকা
বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মূল চালক প্রান্তিক চাষিরা। খাদ্যশস্য ও পণ্যের শতভাগই তারা উৎপাদন করেন। তবে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর মুখ্য ভূমিকা পালন করে বীজ খাত। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, বৈরী নীতিমালা ও সুযোগের অভাবে এ ভূমিকা পালনে পিছিয়ে আছে। বীজ খাত একটি অনন্য খাত। এ খাত একদিকে যেমন খাদ্যসঙ্কট মোকাবেলায় প্রাথমিক ভূমিকা পালন করে, তেমনি টেকসই কৃষি উৎপাদন ও গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী। ক্রমবর্ধিত জনসংখ্যার জন্য টেকসইভাবে পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন বর্তমানে বাংলাদেশের মৌলিক উদ্বেগের বিষয়। একমাত্র প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানভিত্তিক উদ্ভাবিত নতুন জাতের ফসল উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। এতে সুসংহত হবে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা। পাশাপাশি ভালো বীজ সরবরাহের মাধ্যমে প্রান্তিক চাষিদের আয় ও জীবনমানের উন্নয়ন করে দ্রুত দারিদ্র্য হ্রাসে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারবে। এক কথায় বলা যায়, কৃষিতে উৎপাদনশীলতা, টেকসই উপায়ে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়ানোর যেকোনো প্রয়াসে বীজ খাত অনন্য প্রাথমিক কেন্দ্রবিন্দু।
মানসম্পন্ন বীজ ছাড়া খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও খাদ্যসঙ্কট মোকাবেলায় প্রাথমিক ভূমিকা রাখতে বীজ খাতকে সুযোগ করে দিতে হবে। ফসলের মানোন্নয়ন ও উৎপাদন বৃদ্ধি ছাড়াও বীজ খাত একই সাথে কৃষি উৎপাদনে সহায়ক অনেকগুলো বিষয়ের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে। যেমন উন্নত প্রলক্ষণ সংযোজন করে মানসম্মত উচ্চফলনশীল ফসলের উদ্ভাবন; মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন; মানসম্মতভাবে বীজের পরিশোধন ও প্রক্রিয়াকরণ; বৈজ্ঞানিক উপায়ে তাপ ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রিত গুদামে বীজ সংরক্ষণ; বিতরণ (বিপণন) এবং সম্প্রসারণ।
২১. খাদ্য উৎপাদনে বেসরকারি খাতের অংশীদারিত্ব
ভবিষ্যতে সমাজ যতই শিক্ষিত হবে ততই ভোক্তারা স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিসম্পন্ন খাদ্যপণ্য দাবি করবে। আরো দাবি করবে, স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য উৎপাদনে পরিবেশের উপর যেন নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে। প্রান্তিক চাষিরাই বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন করে। অতএব গবেষণার মাধ্যমে যাই উদ্ভাবন করা হোক, সেটা একদিকে যেমন উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সহায়ক হতে হবে, অন্যদিকে প্রান্তিক চাষিদের উৎপাদনপ্রক্রিয়া যেন পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তাছাড়া উৎপাদিত খাদ্যপণ্য হতে হবে স্বাস্থ্যসম্মত। অতএব ভবিষ্যতের খাদ্যসঙ্কটের বহুমাত্রিক সমস্যা মোকাবেলা করতে বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রয়োজন- নিয়ন্ত্রক (সরকার), বিজ্ঞানী, প্রজননবিদ, উদ্ভাবক, গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগকারী, মানসম্মত বীজ উৎপাদন, উৎপাদন-উপকরণ সরবরাহকারী, চাষি ও ভোক্তার মাঝে পারস্পরিক সহযোগিতা। অর্থাৎ সব অংশীজনের মাঝে একে অপরের ওপর আস্থা, বিশ্বাস ও সত্যিকারের অংশীদারিত্ব। তাহলে কৃষি খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়বে। কৃষি খাতের উন্নয়ন টেকসই হবে। সেই সাথে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন সম্ভব হবে।
২২. সরকারি খাতের আধিপত্য
কিছুকাল আগ পর্যন্ত সব উন্নয়নশীল দেশের কৃষি সরকারি খাতের প্রভাব বলয়ে সীমাবদ্ধ ছিল। রাষ্ট্রের প্রবল নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণে ছিল এ খাত। গবেষণা, উন্নয়ন, বীজ উৎপাদন, বিতরণ, বিপণন, উপাদান ও উপকরণ সরবরাহ, কৃষকদের ঋণদান, সম্প্রসারণ সেবা এ সবই ছিল সরকারি খাতের নিয়ন্ত্রণে। বিগত দশকগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে এটা সবার কাছে ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে গেছে, সরকার নিয়ন্ত্রিত থাকলে কৃষি খাতের টেকসই উন্নয়ন, উৎপাদনশীলতা, খাদ্যনিরাপত্তা, যথাযথ পুষ্টির জোগান ইত্যাদি, কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আরো স্পষ্ট, যতদিন এটি সরকারি খাতের নিয়ন্ত্রণ থাকবে, ততদিন গবেষণা, উদ্ভাবন ও উন্নয়নে প্রয়োজনমাফিক গতি আসবে না। তবু অব্যবস্থাপনা, গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহে রাজনীতিকরণ, মাথাভারী প্রশাসন, দুর্নীতি ও বাজেট ঘাটতি কৃষি খাতের উদ্ভাবন ক্ষমতা, উৎপাদনশীলতা ও প্রসারে গতিশীলতা না এনে বরং উল্টোপথে নিয়ে যাচ্ছে। বলা যায়, ক্রমবর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্যচাহিদা মেটাতে যে ক্রমবর্ধিত উদ্ভাবনমুখী গবেষণা ও উন্নয়ন প্রয়োজন সেটা রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রিত সরকারি খাত দিয়ে সম্ভব নয়। তা ছাড়া উপাদান-উপকরণের সরবরাহ বেসরকারি খাত নিয়ন্ত্রিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে প্রান্তিক চাষিদের সেবা প্রদানে সমন্বয়হীনতার বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অতএব গবেষণা, উন্নয়ন, উদ্ভাবন ও টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা অতীব জরুরি।
২৩. বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা
বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতাগুলোর অন্যতম- বীজ এবং সম্প্রসারণ সেবার মতো সেবাসমূহের গুণগত মানের অভাব। উদাহরণস্বরূপ, ভারতে একরপ্রতি পেঁয়াজ উৎপাদন হয় ৭.৫ টন, পাকিস্তানে ৬.৫ টন, কিন্তু বাংলাদেশে একর প্রতি ৩.৬৬ টন । পাঁচ লাখ একর জমিতে পেঁয়াজ চাষাবাদ করা হয়। দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ৩০ লাখ টন। যদি একর প্রতি উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে সাত টন করা যায় তাহলে আবাদকৃত জমিতে ৩৫ লাখ টন উৎপাদন করা সম্ভব। অর্থাৎ বর্তমানে আবাদকৃত জমি দেশে পেঁয়াজের চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট হওয়া সত্ত্বে¡ও আমরা আমদানিনির্ভর। এ জন্য প্রয়োজন উচ্চফলনশীল বীজ যা চাষিদের কাছে হবে গ্রহণযোগ্য। ফলন হবে ভোক্তাদের কাছে সমাদৃত।
উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর মাধ্যমে কৃষি খাত আরো গতিশীল করতে হলে গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রচারে বেসরকারি খাতবিমুখ মানসিকতা বদলাতে হবে। খাদ্যপণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধির বাস্তবভিত্তিক সহজ উপায়- সরকারি ও বেসরকারি খাত উভয়েই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সহযোগিতামূলক সেতুবন্ধ তৈরি করা। যার মাধ্যমে কৃষিপণ্য উৎপাদনে দেশ এগিয়ে যাবে। তাহলে ভবিষ্যতে দেশে খাদ্যসঙ্কট এড়ানো সম্ভব হবে। অন্যথায় খাদ্য সরবরাহে অনিশ্চয়তা বাড়বে। দারিদ্র্যের হারও কমবে না। কৃষি-খাদ্য নিয়ে সুযোগসন্ধানীদের অপতৎপরতাও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে না। সাধারণ মানুষ পুষ্টির অপ্রতুলতায় কষ্টভোগ করতেই থাকবে।
২৪. বীজ অধিগত করার ক্ষমতার সূচক
এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রান্তিক চাষির সংখ্যা, কৃষিপণ্য উৎপাদনের সম্ভাবনা ও সমস্যা এবং খাদ্যনিরাপত্তা বর্তমান অবস্থাকে ভিত্তি করে জাতিসঙ্ঘ গোটা বিশ্বকে চারটি অঞ্চলে বিভক্ত করে এবং প্রতিটি অঞ্চলের সরকার ও বেসরকারি খাতের বীজ কোম্পানিগুলোর ওপর একটি জরিপ চালানো হয়। বিল ও মেলিন্ডা গেইটস ফাউন্ডেশন এবং নেদারল্যান্ডস সরকারের যৌথ উদ্যোগে ওয়ার্ল্ড বেঞ্চমার্কিং অ্যালায়েন্স এ জরিপ চালায়। এ জরিপের উদ্দেশ্য- প্রান্তিক চাষিদের চাহিদা পূরণে বীজ কোম্পানিগুলোর বর্তমান অবদানের মাত্রা নির্ণয় করা। জরিপের আরেকটি উদ্দেশ্য- যেসব বীজ কোম্পানি এ ব্যাপারে দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা রাখছে সেই কোম্পানিগুলো একই মাপকাঠির আওতায় এনে অবস্থান বা পদমর্যাদা নির্ণয় করা। সেই সাথে প্রয়োজনমাফিক নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে ভবিষ্যতে প্রান্তিক চাষিদের জন্য উন্নতমানের বীজ উদ্ভাবন ও সরবরাহে উৎসাহিত করা এবং সরকার, গবেষণা ও দাতা প্রতিষ্ঠানসমূহ, যারা বীজ কোম্পানির সাথে সহযোগী ও সহায়ক ভূমিকা রাখে, ওইসব সংস্থাকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করা।
এ জরিপের সময় প্রতিটি দেশের বীজ কোম্পানিগুলোর অবদান ছয় আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করা হয়। সেগুলো হলো- প্রান্তিক চাষিদের ক্রয়ক্ষমতা অনুযায়ী বীজের সরবরাহ, বীজের সহজপ্রাপ্যতা, টেকসই উৎপাদনে কোম্পানি কর্তৃক চাষিদের সহযোগিতা, কোম্পানির সামর্থ্য, লাভজনকতা ও স্বায়ত্তশাসন। এ ছাড়া কোম্পানিগুলোর উদ্ভিদ প্রজননে সক্রিয় ভূমিকা, নতুন জাতের উদ্ভাবনে কর্মপ্রক্রিয়া ও সফলতা, মানসম্মত বীজ উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, পরিশোধন ও সংরক্ষণ, বিপণন এবং কৃষকের কাছে গ্রহণযোগ্যতার মতো বিষয়গুলো একত্রে এনে বিচার, বিবেচনা, পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা হয়। প্রান্তিক কৃষকদের পছন্দকে কোম্পানিগুলো কতটুকু ও কিভাবে অগ্রাধিকার দেয় সেটিও বিশ্লেষণ করা হয়। এ চার অঞ্চলের একটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া।
২৫. দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় লাল তীরের অবস্থান-পদমর্যাদা
২০১৯ সালে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১৭টি দেশে প্রতিষ্ঠিত ও অবস্থিত বীজ কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে পদমর্যাদার যে সূচক প্রকাশিত হয় তার মধ্যে লাল তীর সিড লিমিটেডের পদমর্যাদা ১৩তম। প্রান্তিক কৃষকদের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে অধিকতর উৎপাদনের ক্ষেত্রে নেতৃত্বমূলক ভূমিকা রাখতে লাল তীর এ অগ্রবর্তী অবস্থান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এর ফলে লাল তীরের বিজ্ঞানীরা আরো বেশি উদ্যম ও আগ্রহ নিয়ে বর্তমানে তাদের গবেষণাকার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রজননবিদ ও বিজ্ঞানীদের গবেষণাকার্যক্রম শক্তিশালী ও উত্তরোত্তর গতি বাড়ানোর লক্ষ্যে লাল তীর ইতোমধ্যেই নিজস্ব রসায়নাগার স্থাপন করেছে। উত্তরোত্তর নতুন নতুন উপকরণ ও যন্ত্রপাতি যোগ করছে। একই সাথে বীজের মান পরীক্ষায় আলাদা বীক্ষণাগার স্থাপন করেছে ও পৃথিবী বিখ্যাত বীজের মান যাচাইকরণ সংস্থা আন্তর্জাতিক বীজ যাচাইকরণ সংস্থার সদস্যপদ লাভ করেছেন। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বেসরকারি খাতবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হলে আরো অনেক দেশী-বিদেশী কোম্পানি কৃষি খাতে বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসবে।
২৬. উপাদান-উপকরণ সরবরাহকারীদের সমস্যা
কৃষি উপাদান বিক্রেতাদের প্রধান সমস্যা সঠিক ব্যবসায়িক দক্ষতা, পুঁজি, বীজের মতো জীবতাত্তিক উপাদানের জ্ঞান এবং আধুনিক চাষাবাদের প্রযুক্তি, প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি, জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব। তাই উপাদান সরবরাহকারীদের পেশাদারিত্বের উন্নয়ন আবশ্যক। যেন তারা চাষিদের উন্নত উপাদান-বিষয়ক পরামর্শ ও নতুন নতুন পদ্ধতি-প্রযুক্তি বিষয়ক তথ্য বিনিময় করে সহায়তা করতে পারেন। বর্তমানে নকল বীজ বা ভেজাল উপাদান বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে আইনের ঘাটতি রয়েছে। আইন যতটুকু আছে তার যথাযথ প্রয়োগ হয় না।
পরিশেষে, বিগত দশকে বিভিন্ন কলাকৌশল-প্রক্রিয়ার অণুবৃত্তি উদ্ভিদ প্রজননে অভাবনীয় অগ্রগতি সাধন করেছে। বিশেষত জিনের বিশদিকরণ, চিহ্নিতকরণ ও জিন সম্পাদনার মতো যথাযথ পদ্ধতি, উদ্ভিদ প্রজননে একটি বৈপ্লবিক রূপ নিয়েছে। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি থেকে সর্বাধিক সুফল অর্জন করতে হলে, বেসরকারি বীজ খাতকে সর্বতোভাবে সহায়তা করতে হবে। খাদ্যসঙ্কটের ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারি ও বেসরকারি খাতকে এক সাথে কাজ করতে হবে। সর্বাধুনিক প্রাপ্য সম্পদ ও সরঞ্জামের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। লক্ষ্য অর্জন ও উদ্দেশ্য সাধনে সরকারি-বেসরকারি খাত, সরকারি প্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালগুলো এক সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গবেষণাকার্যক্রম চালাতে হবে। এ ব্যাপারে বেসরকারি খাতের বীজ কোম্পানিগুলোর ব্যাপক আগ্রহ আছে। সুতরাং, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় এনে, সরকারি ও বেসরকারি খাতের সব ভৌত অবকাঠামো ও মানবসম্পদের একত্র সমাবেশ ঘটানোর লক্ষ্যে একটি যথার্থ নীতিকাঠামো যথাশিগগিরই সম্ভব আবশ্যক।
বাংলাদেশের অগ্রসরমান বীজ খাত সব অংশীজনের সাথে আলোচনার মাধ্যমে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা সুসংহত করার লক্ষ্য অর্জনে এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অংশীদার হতে চায়। ভবিষ্যতের সমস্যা সমাধানে আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। এসডিজি অর্জনে বীজ খাত এক অনন্য খাত এবং কৌশলগতভাবে অনেক লক্ষ্য অর্জনে অবদান রাখতে পারে। যেমন- খাদ্যসঙ্কট থেকে মুক্তি, দরিদ্রতা কমানো, সুস্বাস্থ্য ও ভালো থাকা, লিঙ্গ সমতা, সমুচিত কাজের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সমাজে অসমতা হ্রাস, দায়বদ্ধ ভোগ ও উৎপাদন এবং জলবায়ু সংক্রান্ত নেতিবাচক প্রভাব কমানোর পদক্ষেপ। তাই এসডিজিসমূহের বাস্তবায়নের সাথে বীজ খাতের সম্পর্ক গভীরভাবে সংযুক্ত ও সম্পর্কিত, বরং বলা যায় অবিচ্ছেদ্য। এ কারণে আমরা সরকার এবং জাতীয় পর্যায়ে সবাইকে সঠিক নীতিমালা তৈরি ও বাস্তবায়নের আহ্বান জানাই। যাতে করে বিরল ও প্রাপ্য সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে ফসলের নতুন বৈশিষ্ট্যের জাত উদ্ভাবনকে ত্বরান্বিত করা যায়। এসব নতুন জাতের ফসল হতে হবে কৃষকদের কাছে গ্রহণযোগ্য, ফলন হবে গ্রাহকদের কাছে সমাদৃত এবং ভোক্তারা পাবেন মানসম্মত খাদ্য ও প্রয়োজনমাফিক পুষ্টি।
লেখক : এমএসসি, কৃষি অর্থনীতিবিদ, প্রেসিডেন্ট- বাংলাদেশ সিড অ্যাসোসিয়েশন, সাবেক সভাপতি- এফবিসিসিআই