কাণ্ডারি হুঁশিয়ার ।। আবদুল হাই শিকদার

প্রবন্ধ-কলাম সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

দীর্ঘ ১৭ বছরের বুকফাটা হাহাকারের পর, আমাদের সন্তানদের অসীম অপরিসীম ত্যাগ এবং প্রাণের বিনিময়ে, রক্ত ঢালা পথে অর্জিত হয়েছে বিপ্লব ’২৪। আধিপত্যবাদের তাঁবেদার ফ্যাসিস্ট শাসক হাসিনার হিংস্র থাবার নিচ থেকে উদ্ধার হয়েছে হারিয়ে যাওয়া স্বাধীনতা।

হাড় হিম করা পৈশাচিক ভীতির অন্ধকার থেকে শিক্ষার্থীরা দেশকে, দেশের মানুষকে ফিরিয়ে দিয়েছে মুক্তপক্ষ বিহঙ্গের অবাধ আলোকিত আকাশ। শহীদদের রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি। ঘরে ঘরে সন্তানহারা জননীর হৃদয়ভাঙা আহাজারি, অশ্রুর নদী। আহতদের কাতর কাতরানিতে বাংলাদেশের আকাশ বাতাস ভারী হয়ে আছে এখনো।

অথচ এরই মধ্যে নিষ্ঠুর গণহত্যাকারী শেখ হাসিনা ও তার পুত্র আমাদের এই মহিমান্বিত বিপ্লবকে ধ্বংস করে ‘আওয়ামী জাহেলিয়াত’ ফিরিয়ে আনার জন্য আবার মেতে উঠেছে নানা জটিল কুটিল ষড়যন্ত্রে। মাঠে নামানোর অপচেষ্টা করছে তাদের ঘাতক আওয়ামী গুণ্ডা বাহিনীকে। গর্ত থেকে আবার মাথা বের করছে রাষ্ট্রদ্রোহী মানবতার দুশমন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পঞ্চম বাহিনী। নেপথ্যে থেকে তাদের মদদ দিচ্ছে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’। বিজেপির মিডিয়া চালাচ্ছে বিরামবিহীন উদ্ভট, অবিশ্বাস্য নির্জলা মিথ্যা নোংরা প্রচারণা।

আমাদের কচি কচি দুধের বাচ্চাগুলো যখন রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, খেয়ে না খেয়ে অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে, দেশের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রাণপাত করে কাজ করছে, সড়কের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে, দেয়াল ও রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন করছে, বাজার মনিটরিং করছে, সারা রাত জেগে জেগে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বাড়িঘর উপাসনালয় পাহারা দেয়া-সহ নানাবিধ কর্মে ব্যস্ত- সেই সময় হাসিনা ১৫ আগস্ট সামনে রেখে, ৩ নভেম্বর ’৭৫ এর কায়দায় তার রেখে যাওয়া উচ্ছিষ্টভোগী তাঁবেদার, দুর্নীতিবাজ পঞ্চম বাহিনী দিয়ে চালাচ্ছে ভয়ঙ্কর চক্রান্ত। সিরিয়া, সুদান ও লিবিয়ার মতো গৃহযুদ্ধ বাধানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।

প্রথমে সেনাবাহিনীর ভিতরে ঝামেলা পাকাতে ব্যর্থ হয়ে চেষ্টা করে পুলিশকে ক্ষেপিয়ে তুলতে। তারপর সওয়ার হয় সুপ্রিম কোর্টের ঘাড়ে। কিন্তু হাসিনাকে হতাশ করে ছাত্র-জনতা ও সেনাবাহিনীর সতর্কতায় জুডিশিয়াল ক্যুর ষড়যন্ত্রকারী বিচারপতি নামধারী দাসগুলো ধরাশায়ী হয়।

সবশেষে বেছে নিয়েছে সংখ্যালঘু কার্ড। আসলে সংখ্যালঘু নয়, সংখ্যালঘুর নামে, মাঠে নেমেছে আওয়ামী দুর্বৃত্তরা। এই দুর্বৃত্তরা ১৭টা বছর ধরে চালিয়েছে নৃশংস দুঃশাসন। ধ্বংস করেছে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান। ধ্বংস করেছে দেশটাকে। দুর্নীতি, গুম, খুন, মামলা ও দুঃশাসনের কুৎসিত এক দোজখে পরিণত করেছিল লক্ষ শহীদের রক্তে রাঙা দেশটাকে।

এক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের করণীয় কী?

দেশের প্রশাসন, পুলিশ, বিচারালয়, শিক্ষাঙ্গন ও সংস্কৃতি অঙ্গন-সহ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ভিতরে ঘাপটি মেরে আছে আওয়ামী দুর্বৃত্তরা। শুধু মাথা কেটে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিষমুক্ত করা সম্ভব নয়। সব কিছু ঢেলে সাজাতে হবে। উপদেষ্টাদের সবাই একই ভাষায় কথা বলছেন না। তাদের সাথে নিয়মিত মতবিনিময় করে, পরামর্শ দিয়ে বিপ্লবের গাড়ি সঠিক পথে রাখতে হবে।

স্যাডো ক্যাবিনেট গঠন করতে হবে। একটি বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিল গঠন করা জরুরি। নইলে সব কিছু ভণ্ডুল হয়ে যেতে পারে।
কোনো অবস্থায়ই রাজপথ ছাড়া যাবে না। রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান কড়া নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রতিবিপ্লবীরা যে কোনো মুহূর্তে হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।

বিপ্লবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত নিরন্তর কাজ করে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, দেশ মেরামতের এটাই শেষ সুযোগ। গণতদন্তের মাধ্যমে অতি দ্রুত সব হত্যার বিচারের উদ্যোগ নিতে হবে। সব লুটেরা, দুর্নীতিবাজ, হামলাকারী দুর্বৃত্তকে, আধিপত্যবাদের দালাল ও দোসরদের নির্মূলে বদ্ধপরিকর হতে হবে।

গণহত্যার দায়ে শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের উদ্যোগ নিতে হবে। জাতিসঙ্ঘের সহযোগিতা চাওয়া যেতে পারে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কাঠগড়ায় তাকে তুলতেই হবে। পাঠ্যপুস্তক সংশোধনীতে হাত দিতে হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় মন দিতে হবে।
ব্যাংকগুলোকে লুটেরাদের হাত থেকে উদ্ধার করতে হবে। বিদেশে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে হবে। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, ইংরেজি মিডিয়াম-সহ সব শিক্ষাব্যবস্থার সমন্বয় সাধন করে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, মানবিকতা ও আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বিজাতীয় অপসংস্কৃতির ছোবল থেকে বাঁচার জন্য, নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশ ও লালনের জন্য ‘জাতীয় সাংস্কৃতিক নীতিমালা’ প্রণয়ন ও তা শক্ত হাতে প্রয়োগ করতে হবে।

বাবা-মা, ভাই বোন, শিক্ষক অভিভাবকদের করণীয়

আমরা কি আমাদের সন্তানদের ওপর সব দায়িত্ব চাপিয়ে ঘরে বসে থাকব? বিপ্লব সার্থক করতে আমাদের কী কিছু করণীয় নেই? স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আমরা কি সন্তানদের পাশে শক্তভাবে দাঁড়াবো না? তাদেরকে সাহস দিয়ে, সমর্থন দিয়ে, পরামর্শ দিয়ে তাদের কাজে অংশ নেবো না? আওয়ামী হায়েনা ও আধিপত্যবাদের মরণ কামড় রুখতে আমরা কি সন্তানদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করব না? আমরা কি আমাদের শহীদ সন্তানদের রক্তের সাথে বেঈমানি করে আধিপত্যবাদের উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার পথ সহজ করে দেবো? যদি সবগুলো উত্তর ইতিবাচক হয়, তাহলে আর দেরি নয়। শিক্ষার্থীদের সাথে সহযোগিতা করুন। পথেই থাকুন।

১৭ কোটি মানুষ সিসাঢালা প্রাচীরের মতো কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে আওয়ামী দানবকে প্রতিহত করবই। বাংলাদেশের আকাশে কালো মেঘের মতো জাঁকিয়ে থাকা শকুন, স্বাধীনতার শত্রুদের উৎখাত করবই। বিভেদ, ঘৃণা ও হানাহানি সৃষ্টিকারী শয়তানির দুর্গ উৎপাটন করে, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে প্রীতি ও প্রেমের পুণ্যভূমিতে পরিণত করব, এই হোক আজকের শপথ।

* আবদুল হাই শিকদার বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি, সাংবাদিক ও গবেষক, নজরুল ইনস্টিটিউটের সাবেক নির্বাহী পরিচালক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *