কফিনে শোয়া সিনেমাকে জাগাতে কি করতে হবে? | কামরুল হাসান দর্পণ

মতামত সময় টিভি
শেয়ার করুন

বিগত দেড় দশকে চলচ্চিত্রে ক্রেজ সৃষ্টি করতে পেরেছে, দর্শক মাতাতে পেরেছে, এমন নায়ক-নায়িকা আসেনি। যেমনটি এসেছিল সালমান শাহ-মৌসুমী জুটি হয়ে। বাপরে! সে কি উন্মাদনা! সালমান শাহ’র চেহারা যে খুব আহামরি ছিল তা নয়, অথচ কি এক আকর্ষণ ছিল যা অদৃশ্যে থেকেই আকৃষ্ট করত, মায়া বাড়িয়ে দিত। তার ফ্যাশন সচেতনতা সর্বকালের জন্য আইকন হয়ে আছে। অভিনয়টাও রক্তে ছিল। চলচ্চিত্রের মজার মানুষ হিসেবে পরিচিত মরহুম সিদ্দিক জামাল নান্টু ভাই তো একবার আমার সামনে বলেছিলেন, ও টাক্কু, টাক্কু, টাকলা। ও নায়ক হলো নাকি!

অন্যদিকে, মৌসুমী! মাই গড! আমার মনে হয়, থ্রি-ফোরের ছাত্র থেকে বুড়া পর্যন্ত মৌসুমীকে মনে মনে প্রেমিকার আসনে বসায়নি, এমন দর্শক খুব কম ছিল। এর এক ঝলক দেখা গিয়েছিল, স্প্রিং রেইন নামে একটি শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনে। তখন থেকেই আলোচনা, ‘কে এই মেয়েটি’। সালমানের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। একটি ক্যাডসের বিজ্ঞাপনে আর্মি ছাঁটের চুলে রেবন সানগ্লাস পরিহিত ছেলেটিকে দেখে মনে হয়েছিল, ‘কে রে বাবা তুমি!’ ‘কে এই মেয়েটি’ আর ‘কে রে বাবা তুমি!’-এই দুইজনকে নিয়ে যখন সোহানুর রহমান সোহান ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমার জমকালো ও চমকানো মহরত করলেন, সাংবাদিক তথা মিডিয়ার সামনে তাদের হাজির করলেন তখন যা ঘটেছিল, তা দর্শকের মনে হিরোশিমা বিস্ফোরণের চেয়ে কোনো অংশে কম বিস্ফোরণ ঘটেনি। মৌসুমীকে প্রেমিকা আর সালমানকে প্রেমিক ভেবে কত সংখ্যক ভক্ত ঘুমাতে গিয়ে বালিশ ধরে এপাশ-ওপাশ করেছে, তার খবর না পাওয়া গেলেও সংখ্যাটি কোটি কোটির কম হবে না।

এরপর টুকুসটাকুস নায়ক-নায়িকা যে আসেনি, তা নয়। এসেছে, তারাও দর্শক সাড়া পেয়েছেন, তবে সেই রাজ্জাক-কবরী থেকে শুরু করে সালমান-মৌসুমী পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। তবে নায়ক-নায়িকার অভাব ছিল না। একজন ড্যাশিং হলে তো আরেকজন মেগা, একজন লাভার বয় ও গার্ল হলে আরেকজন অ্যাকশন, আরেকজন গরিবের বন্ধু, কেউ রাখাল রাজা, কেউ বিউটি বাই নেচার, বিউটি কুইন, প্রিয়দর্শিনী, গ্ল্যামার গার্ল, স্বপ্নের রানী-এমন ক্যাটাগরি নিয়ে বেশ প্রতাপের সাথেই নায়ক-নায়িকারা ছিলেন।

মান্না, বাপ্পারাজ, ওমর সানি, চম্পা, অরুণা বিশ্বাস, মৌসুমী, শাবনূর, পপি, রুবেল, শাহনাজ, শিল্পী, লিমা, সোনিয়া, সিমলা, রিয়াজ, পূর্ণিমা, ফেরদৌস, মুক্তি, আমিন খান, রেসি, অপু বিশ্বাস, অমিত হাসান আরও কত তারকা! দূরে বহু দূরে সূক্ষ্ম আলোক রশ্নি হয়ে শাকিব জ্বলতেন টিমটিম করে। তাদের বাবা-চাচা, ভাই-ভাবী হিসেবে সমান্তরালে ছিলেন, রাজ্জাক, সোহেল রানা, উজ্জ্বল, ফারুক, সুচন্দা, শাবানা, ববিতা, সুচরিতা, অঞ্জনা, রোজিনা, ইলিয়াস কাঞ্চন প্রমুখ। এরা প্রত্যেকেই পুরনো এবং নব প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। আরও অনেকে ছিলেন। সবার নাম বলতে গেলে লেখা দীর্ঘ থেকে আরও দীর্ঘ হয়ে যাবে।

যাই হোক, উল্লেখিতরা নির্মাতাদের সামনে বিচরণ করায় তাদের সুবিধা হতো। নির্মাতাদের কল্পনার দুয়ার খুলে যেত, নতুন গল্প নিয়ে খেলা করতেন। অনেকে তাৎক্ষণিকভাবে গল্পের লাইনআপ রেডি এবং নায়ক-নায়িকা ঠিক করে সিনেমার কাজ শুরু করে দিতেন। এমন ঘটনা অহরহ ঘটেছে। অর্থাৎ নির্মাতাদের সামনে নায়ক-নায়িকা এবং জাঁদরেল ও শক্তিমান অভিনেতা-অভিনেত্রী থাকায় এবং নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ হওয়ায় কোনো না কোনো গল্প তাদের মাথা ও মননে খেলা করত।

বলার অপেক্ষা রাখে না, উপকরণ থাকলে সৃষ্টির চিন্তা ও সম্ভাবনা জাগে। না থাকলে চিন্তা আসে না। আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ড। আমাদের বর্তমান চলচ্চিত্রে কিছু না হওয়ার অন্যতম কারণ কিন্তু শিল্পী তথা পর্দার ফুল-ফল হয়ে ফুটে উঠার মতো কিছু না থাকা। নির্মাতাদের সামনে এই ফুল-ফল নেই, তাই তাদের তৃষ্ণা বা আকাঙ্ক্ষাও জাগে না। যেখানে তৃষ্ণা থাকে না, সেখানে কোনো কিছুর সন্ধান মেলে না। তৃষ্ণা আছে তো সৃষ্টি আছে।

তো আমাদের সিনেমার ধ্বংস শুরু হয়েছে গত দেড় দশক ধরে মান্নার মৃত্যু, শাকিবের উত্থানের মধ্য দিয়ে। বিষয়টি এমন আই রাইজ, ইউ ফল। আমার উত্থান, তোমার পতন। এ সময়ে শুধু শাকিবকে নিয়ে নির্মিত এককেন্দ্রিক কিছু সিনেমা ব্যবসা করেছে। নির্মাতারাও হয়ে পড়লেন এককেন্দ্রিক। সিনেমার সর্বনাশের শুরু এখান থেকেই।তারা (নির্মাতারা) শাকিবের বাইরে কোনো কিছু চিন্তাই করতে পারলেন না। চিন্তার দিগন্ত প্রসারিত করতে চাইলেনও না। অথচ এ সময়ে উল্লেখিত নায়ক-নায়িকারাও কিন্তু এলাইভ ছিলেন। তাদের দিকে দৃষ্টি না দেয়া এবং চিন্তা না করায়, তারাও উদ্যম ও ধার হারিয়ে মরিচিকায় পরিণত হলেন। এককেন্দ্রিক কোনো কিছুই যে স্থায়ী হয় না কিংবা একপালা বা খাম্বা বিশিষ্ট ঘর বেশিদিন টিকে না, তা শাকিবের বাজার হারানোর মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয়েছে, সেই সাথে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিও কফিনে শুয়ে পড়েছে।

ডিপজল নিজের মতো ব্যবসা সফল বেশ কিছু ব্যবসা সফল সিনেমা দিয়ে কিছুটা পথ প্রসারিত করেলও, অন্যরা সে পথে হাঁটলেন না। অনন্ত জলিল চমক দেখালেও, তা ছিল প্যারালাল একটি প্রক্রিয়া। ধারাবাহিকতায় ছিল ঘাটতি। আরও দুয়েকজনের আগমন ঘটেছে। বাপ্পী চৌধুরী, আরেফিন শুভ, সিয়াম, রোশান, মাহিয়া মাহি, পরীমনি, এদের আগমন ঘটলেও, সেই ক্রেজ যা শাকিব পর্যন্ত ছিল, তা সৃষ্টি করতে পারেনি। তাদের কেউ গরিবের বন্ধু, রাখাল রাজা, লাভার বয় কিংবা ড্যাশিং হয়ে উঠতে পারেনি।

নায়িকাদের মধ্যে দুয়েকজন ঝলক দেখালেও পাকনামির জন্য কিংবা আউলা-ঝাউলা লাইফ স্টাইল যা কোনোভাবেই ফিল্মিক ছিল না, তারাও তাইরে-নাইরে হয়ে গেছে। এদের কাউকে প্রেমিক বা প্রেমিকা কল্পনা করে কোনো দর্শক বালিশ নিয়ে এপাশ-ওপাশ করা দূরে থাক আড্ডায়ও তাদের নাম উচ্চারণ হতে দেখা যায় না।

এই যে শিল্পী সংকট, এটাকে প্রকৃত শিল্পী সংকট বলাই ভালো। এই সংকট নিয়ে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়ানো সম্ভব নয়। নির্মাতারাও শুয়ে বসে আছেন। তারাও তাদের চিন্তা নিয়ে খেলার মতো কাউকে খুঁজে বের করেন না। সিনেমা নিয়ে চিন্তা করেন না। তারা চিন্তা করেন, ইউটিউব কন্টেন্টের কথা। আগে একজন একনিষ্ঠ নির্মাতা কোনো মার্কেটে গেলে কিংবা ঘরোয়া অনুষ্ঠানে গেলে, কোনো মেয়েকে চোখে আটকে গেলে, দুই হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি জোড়া দিয়ে ফ্রেমিং করে চেহারা মাপতেন। মিলে গেলে নায়িকা বানানোর জন্য তার পেছনে উঠেপড়ে লাগতেন।

মার্কেটে কোনো মেয়েকে পছন্দ হলে তার পিছু নিতে গিয়ে পাবলিকের মাইরও খেয়েছেন। এভাবেই একেকজন নায়ক-নায়িকা আবিষ্কৃত হয়ে প্রখ্যাত-প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আবার এমন অনেক দর্শকপ্রিয় নায়ক আছে যারা দিনের পর দিন এফডিসিতে ঘুরেছেন। নির্মাতার পেছনে ঘুরতে ঘুরতে স্যান্ডেল ছিঁড়েছেন। কাঁকড়ার মতো কামড়ে ধরেছেন, ছাড়েননি। নির্মাতাকে বাধ্য করেছেন সুযোগ দিতে। সুযোগ পেয়েই তা কাজে লাগিয়ে দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। ডিভোশন, ডেডিকেশন কাকে বলে কত প্রকার ও কি কি তা তারা দেখিয়েছেন।

আমাদের চলচ্চিত্রের রমরমা যুগ, মধ্যযুগ এবং ক্ষয়ীষ্ণু এই তিন যুগ বিবেচনা করে আমাদের প্রথম দুই যুগের ধারায় ফিরে যাওয়া উচিৎ। মানুষ যতই আধুনিক হোক না কেন, সে কিন্তু তার মূলকে ভুলে না, নিজের ঘরেই ফিরে আসে, সেখানেই থাকতে ভালবাসে। চলচ্চিত্রকেও তার মূলে ফিরে যেতে হবে। তাহলে কিছুটা হলেও সিনেমা কফিন থেকে উঠে বসবে। ওসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর আধুনিকতা বা সময়োপযোগী ছাইপাস সিনেমার কথা বলে লাভ নেই। তা বানানোর মতো দক্ষতা ও হিম্মত আমাদের অনেক নির্মাতার নেই। বানাতে গিয়ে উল্টো মাখিয়ে ফেলেন। আমাদের যা আছে, তার মধ্য দিয়েই এগিয়ে যাওয়া উচিৎ। মনে রাখতে হবে, অনেক দেশেই ফেসবুক নেই। উন্নত দেশের অসংখ্য নাগরিক এটা ব্যবহারই করে না। তাই বলে কি তারা পিছিয়ে গেছে? বরং এনালগে থেকেই উন্নতির পথে এগিয়ে গেছে।

লেখক: কামরুল হাসান দর্পণ
সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক ও চলচ্চিত্র বিশ্লেষক
সদস্য সচিব, এডহক কমিটি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *