লুৎফর রহমান হিমেল
ইত্তেফাক এ দেশের সফল এবং ঐতিহাসিক এক দৈনিক। এক সময় এই দৈনিকে কাজ করাটা একটি ‘প্রেস্টিজিয়াস’ বিষয় ছিল। ইত্তেফাকে চাকরির অফার পেলে লোকে তখন সরকারি ক্যাডার সার্ভিস বা অন্য বড় বড় চাকরির অফারও অবলীলায় ফিরিয়ে দিত। সেই ইত্তেফাক প্রায় ‘সতের বছর’ শীর্ষে থেকে দাপট দেখিয়ে রাজ করেছে বাংলাদেশের পাঠকমহলে। এরপর ধীরে ধীরে পড়ে যায় পত্রিকাটি।
এরপর জনকণ্ঠ, আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ জয়ঢঙ্কা বাজিয়ে এসে আবার ঝিমিয়েও পড়ল। এরপর এল প্রথম আলো। এটি দীর্ঘ ২৩-২৪ বছর ধরে পাঠকমহলে আস্থার জায়গা তৈরি করে তাদের দায়িত্ব পালন করে চলেছে। গুণগত মানের দিক দিয়ে দৈনিকটি একালের সেরা দৈনিক। তবে গত এক যুগ আগে যে মান পত্রিকাটির ছিল, সেটিতে আর স্থির থাকতে পারেনি তারা। তারপরও অন্য পত্রিকাগুলো থেকে তারা এখনও ঢের মান সম্পন্ন। অর্থাৎ পত্রিকাটি মন্দের ভাল হিসেবে বিদগ্ধ পাঠক মহলে নন্দিত এখনও। মান নিয়ে অনেকের তীর্যক সমালোচনা থাকলেও তারা দিনশেষে পত্রিকাটির ওপরই ভরসা করেন। তাদের সামনে যে আর দ্বিতীয় কোনো অপশন বা বিকল্প নেই আপাতত।
নতুন পত্রিকা বা মিডিয়া করার কথা উঠলেই তাই প্রথম আলোর কথা আসে। অনেক মিডিয়া মালিক সম্পাদক-সাংবাদিকদের বলেই বসেন, প্রথম আলোর মতো পত্রিকা বানাতে হবে। এই দাবিটি ভাল। আমি ত বলতে চাই তারা বলুক, প্রথম আলোর চেয়েও অগ্রসর পত্রিকা বানাতে চান তারা। এরকম দাবি পেশাদার দাবি। শুধু সাংবাদিক-সম্পাদকই পেশাদার হবেন এমন নয়। বিনিয়োগকারীদেরও পেশাদার হওয়ার দরকার। কিন্তু তারা যখন সম্পাদক বাছাই করতে যান, তখনই ভুলটা করে বসেন! তারা যোগ্য সম্পাদক বাছাই করতে ব্যর্থ হন। খুঁজতে খুঁজতে তাঁরা শেষ পর্যন্ত ‘প্রেসক্লাব সম্পাদক’ না হয় টকশোর জনপ্রিয় মুখ বেছে নেন, পত্রিকা সম্পাদক নয়। যে কারণে পত্রিকাও আর দাঁড়ায় না। ছয় মাস, এক বছর পর না হয় পত্রিকা বন্ধ হয়, না হয় বনসাই গোছের সার্কুলেশন দিয়ে সেটি টিকিয়ে রাখা হয়। ‘প্রথম আলো’ আর হয়ে উঠা হয় না তাদের। প্রথম আলোকে ছাড়িয়েও যাওয়া হয় না। ফলে প্রথম আলো ‘প্রথম’ই থাকে।
গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রথম আলো আর ইংরেজি ডেইলি স্টার দাপটের সাথে প্রিন্ট মিডিয়ার শীর্ষে অবস্থান করছে। গুনে মানে তাদের সমান তো দূরের কথা, তাদের কাছাকাছিও যেতে পারেনি অন্য পত্রিকাগুলো। এ দেশে ২০ কোটি মানুষ। ঢাকাতেই ৩ কোটি মানুষের বাস। অথচ পত্রিকার মোট সার্কুলেশন কত? বলবো না সেই সংখ্যা। শুধু বলি, কেন এত নগণ্য সার্কুলেশন? কেন আর নতুন পাঠক তৈরি হয়নি? এসব প্রশ্নের উত্তর একটিই: মালিক পক্ষের যোগ্য সম্পাদক খুঁজে বের করার ব্যর্থতা। আর যোগ্য সম্পাদকদের মিডিয়াপ্রেমী বিনিয়োগকারীর সাথে যুক্ত হতে না পারা।একজন পেশাদার যোগ্য সম্পাদক সব সময়ই তার মতো যোগ্য-দক্ষ কর্মীই নিয়োগ দিয়ে থাকেন। তিনি পত্রিকার স্বার্থটাই বড় করে দেখেন। স্বজনপ্রীতি তার কাছে প্রাধান্য পায় না। ফলে মিডিয়া দাঁড়িয়ে যায়। এ কারণে যারা মিডিয়া করতে চান, তাদের উচিৎ প্রথমেই যোগ্য একজন সম্পাদককে খুঁজে বের করা। নতুন পত্রিকা কেউ করতে চাইলে প্রথমেই আমি তাকে যে কথাটা বলি, আপনাকে ভাল বিনিয়োগও করতে হবে। এ যুগে সস্তায় ভাল পত্রিকা করা যায় না। কখনোই না। এই চেষ্টা করাটাও অনুচিৎ। ভাল সাংবাদিক পেতে হলেও ভাল স্যালারি দিয়েই তাকে যুক্ত করতে হবে। বিশেষ করে সম্পাদক বাছাইয়ে একজন উদ্যোক্তাকে যথেষ্ট যাচাই বাছাই করে নিয়োগ দেওয়া উচিৎ। কারণ, সম্পাদকই পরে তার কর্মীবাহিনীর নিয়োগ সম্পন্ন করবেন।
কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিনিয়োগকারী উদ্যোক্তারা সাংবাদিক নেতাদের সম্পাদক বানানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন। নতুবা টিভির জনপ্রিয় টকশোর মুখকে খোঁজেন। বিনিয়োগকারীদের ধারনা, যে যত জনপ্রিয় (আসলে শব্দটি হবে আলোচিত) তিনি ততো যোগ্য। এ যুগে মিডিয়া সম্পাদকের জনপ্রিয়তায় চলে না। আমি বলছি না যে, টকশো যাঁরা করেন তাঁরা সবাই অযোগ্য, বা যাঁরা প্রেসক্লাব করেন, তাঁরা সবাই অযোগ্য। মূলত এবং কার্যত মিডিয়া চালানোর দক্ষতা ও যোগ্যতা যাঁদের বেশি তাঁদের হাতে সাংবাদিক সংগঠন করবার মতো অতো সময় সেভাবে থাকে না।
একটি আদর্শ পত্রিকা বা মিডিয়া আস্থার জায়গা তৈরি করে। অডিয়েন্সের মধ্যে বিশ্বাস সৃষ্টি করে। সেই আস্থা ও বিশ্বাসের মূল্য মিডিয়া প্রতিদিন প্রতিমূহুর্তে দিয়ে চলে। ফলে পত্রিকা মানুষ কিনে পড়ে। অনলাইন নিউজ পোর্টালে মানুষ সার্চ করে গিয়ে পড়ে। তারা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। কনটেন্ট তাদের মতের পক্ষে গেলে প্রশংসা করে, বিপক্ষে গেলে গালিগালাজও করে। রিয়েকশন বা ফিডব্যাকই মিডিয়ার বেঁচে থাকার বড় সনদ। যে মিডিয়ার রিয়েকশন নাই, সে মিডিয়া কার্যত মৃত। কনটেন্ট দেখে সরকার এবং তাঁর মন্ত্রী-এমপিরা বিষোদগার করবে। কিন্তু দিনশেষে পত্রিকার দর্পণে নিজেকে ও দেশকে দেখতে ওই পত্রিকার সামনেই তারা দাঁড়াবে।
আর যদি তোষামোদি পত্রিকা বা মিডিয়া করা হয়, পাঠকের আস্থা তৈরি হবে না। সরকারপন্থী হলেও সেই মিডিয়াকে সরকারগুলোই তাচ্ছিল্য করবে। বিরোধীদের বকাঝকা ত বোনাসই। এমন মিডিয়ার আখেরে সার্কুলেশন বা জনপ্রিয়তা থাকে না। শেষে বিজ্ঞাপনও আসে না। আর্থিক ভিত্তিও তৈরি হয় না মিডিয়ার। আর এই আর্থিক ভিত তৈরি না হওয়ায় পত্রিকা বা মিডিয়াটিও আর প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠে না। শেষমেস বিনিয়োগকারীর কোটি কোটি টাকার শ্রাদ্ধ হয়। মিডিয়া মালিক সেই যে দই মনে করে চুন খেয়ে মুখ পুড়লেন তো, আর ওমুখো হন না। তখন যোগ্য সম্পাদকেরা দই নিয়ে গিয়ে তাদের মুখের সামনে ধরলেও আর তিনি পরে মিডিয়া করেন না। তারা তখন বলেন, চুন খেয়ে আর মুখ পুড়তে চাই না।
এভাবেই চলছে গত দুই দশক ধরে।
১৯ মে ২০২২, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৯
লেখক: লুৎফর রহমান হিমেল
সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট.লাইভ
আরও পড়ুন
দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ছে মাঙ্কিপক্স; প্রয়োজন সতর্কতা
দেহকে সুস্থ রাখবে অ্যালোভেরা
বসন্তের বাতাসে অ্যালার্জির প্রবণতা, একটু গাফিলতি হলেই মারাত্মক বিপদ
রাসূল সা: প্রবর্তিত খাদ্যবিজ্ঞান । ডা: মো: তৌহিদ হোসাইন
তরমুজের উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ
যে খাবারে শিশুর উচ্চতা বাড়ে
ইন্ডাস্ট্রির সকলের স্বার্থে কপিরাইটের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিঃ ফাহিম ফয়সাল
অতিরিক্ত আবেগ মনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে
আক্ষেপ প্রকাশ করলেন ‘ছুটির ঘণ্টা’র নির্মাতার মেয়ে বিন্দি
ওজন কমাতে সাহায্য করে যে সকল খাবার