আমি ১৯৮৩ সনের ডিসেম্বর মাসের কোন একদিন সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা’য় ষ্টাফ রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করি। সাধারণত যে প্রক্রিয়ায় লোকেরা একটি প্রতিষ্ঠানে কাজে যোগ দেয় বা চাকুরি পায় সে রকমটি ঘটেনি আমার বেলায়। মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে বসে ছিলাম। সিলেট শহরে নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামী কিন্ডার গার্টেন শাহজালাল জামেয়া ইসলামীয়ার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল মাওলানা ফরিদউদ্দিন চৌধুরী (পরবর্তীতে এম.পি) উপর্যুপরি লোক পাঠিয়ে তিনি স্কুলে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেন। আমি অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও এবং পরীক্ষার ফলাফলের পর অন্যত্র চাকুরি খুঁজে নেওয়ার মনোবাঞ্ছা মনে রেখে স্কুলে যোগ দিলাম। এরপর প্রায় একটি বছর স্কুলে ছিলাম। ইতোমধ্যে এলএলবিতে ভর্তি হয়েছি। অর্থাৎ পেশা নিবার্চন নিয়ে ছিলাম দ্বিধান্বিত। এমন সময় সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা’ থেকে আমন্ত্রণ পেলাম। কবি মতিউর রহমান মল্লিকের একান্ত আগ্রহ এবং আমার ছাত্র জীবনের সর্বোচ্চ নেতা জনাব মোঃ এনামুল হক মঞ্জু ভাইর (পরবর্তীতে এম.পি এবং তিনি আমার স্ত্রীর খালাত ভগ্নিপতি) উপর্যুপরি চিঠি এবং টেলিগ্রাম আমাকে বাধ্য করল ঢাকা পর্যন্ত আসতে। তখনো আমি কৃত সংকল্প ছিলাম নিজের এলাকায় থাকবো এবং শিক্ষকতার পরিবর্তে আইনকে পেশা হিসেবে নেবো।
পরিবারের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে উৎসাহ ছিল বেশী। কিন্ত ঢাকা আসার পর কবি মতিউর রহমান মল্লিক ভাইর অতিশয় আবেগ এবং ইসলামী সাহিত্য আন্দোলনের প্রয়োজনে ঢাকা আসা দরকার এই দায়িত্বানুভূতি আমাকে প্রলুদ্ধ করল সোনার বাংলায় আসার ব্যাপারে। আমার সাংবাদিকতায় যুক্ত হওয়ার ব্যাপারটিও বেশ দীর্ঘ ঘটনাবহুল জীবন কাহিনী, তাও এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। এখানে যার কথা বলতে গিয়ে এই সামান্য অবতারণা করলাম- তিনি আমাদের অতি প্রিয় জহুরী ভাইয়ের গত ৭ এপ্রিল ২০০৫ ইন্তেকালের প্রেক্ষিতে (ইন্নাল্লিহে ওয়া ইন্নালাই হে রাজিউন)।
আমার সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটে সাংবাদিকতার মাধ্যমেই। সোনার বাংলায় যুক্ত হয়েই মনে হয়েছে আর সব বিষয়ের মতো সাংবাদিকতা শিক্ষার জন্য গুরু ধরা প্রয়োজন। তাই, মনে মনে স্থির করলাম আমার দু’জন প্রিয় কলাম লেখক ‘জহুরী’ এবং ‘দূরবীন’ যেহেতু একই বিল্ডিংএ অবস্থান করছেন এঁদের কাছে গেলে সুপরামর্শ মিলতে পারে । বলে রাখা ভাল, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা অফিস তিন তলায় আর দৈনিক সংগ্রাম দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত। উল্লেখিত দু’জন প্রাজ্ঞ সাংবাদিক (কলাম লেখক) দৈনিক সংগ্রামের যথাক্রমে সহকারী সম্পাদক এবং সম্পাদক। তাই, সোনারবাংলায় এসে অল্প কিছু দিনের মধ্যে ছুটে গেলাম ‘জহুরী’ ছদ্মনামের আড়ালে আমার প্রিয় কলাম লেখক সালেহউদ্দিন আহমদ ভাইয়ের দপ্তরে। দিন তারিখ মনে নেই। তবে সেটা ১৯৮৪ সনের প্রথমার্ধের কোন একদিন হবে। এখানে বলা উচিত- ছাত্র জীবনে সাহিত্যচর্চার সুবাদে সিলেটের স্থানীয় পত্রিকা সাপ্তাহিক ‘যুগভেরী’ পত্রিকার অফিসে যাতায়াতের কারণে এবং দেশ-বিদেশ ও রাজনীতি বিষয়ে উৎসাহী হওয়ায় একাধিক পত্রিকা ক্রয় করে পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠেছিল।
সে সময় বিভিন্ন পত্রিকায় যাঁদের উপ-সম্পাদকীয় অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পাঠ করতাম এবং কাটিং করে সংগ্রহ করতাম, সেগুলো হলোঃ- ‘দৈনিক ইত্তেফাকের ‘লুব্ধক’ (আখতার উল আলম) দৈনিক আজাদের ‘মর্দে-মুজাহিদ’ (খন্দকার আবদুল হামিদ), ‘ফারাজী মুনশীর হপ্তানামা’ (ওসমান গনি), দৈনিক সংগ্রামের ‘দূরবীন’ (আবুল আসাদ), ‘জহুরী’ (সালেহউদ্দিন আহমদ) ইত্যাদি। এ ছাড়াও আরও অনেকের কলাম পাঠ করতাম এবং ভালও লাগতো। কিন্তু উল্লিখিতদের খুব একটা বাদ যেতো না পাঠ থেকে। এঁদের অনেকেই আজ পৃথিবীতে নেই। আর চলে যাওয়া সারিতে সামিল হলেন আমার প্রিয় আরেক কলাম লেখক জহুরী ভাইও। এখানে একটু বলে নিতে চাই, ছদ্মনামের আড়ালে আসল মানুষটিকে আগে চিনতাম না। সাংবাদিকতায় এসে এঁদের চিনেছি। ভাবের লেনদেন হয়েছে। ফলে সম্পর্কটা আসল নামের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। যেমন দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক মুহতারাম আবুল আসাদ নৈকট্যের বদৌলতে ‘ভাই’ শব্দটি যুক্ত হয়ে ‘আবুল আসাদ ভাই’ হয়ে গেলেন। কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটল সালেহউদ্দিন আহমদ ভাইয়ের ব্যাপারে। তিনি স্বনামে আর পরিচিতি পেলেন না। আমার কাছে তো নয়ই অনেকের কাছেই। তিনি সম্বোধন হিসেবে পরিচিতি পেলেন ‘জহুরী ভাই’। ইচ্ছেয় হোক কিংবা অনিচ্ছায় যারা তার কাছে ঘেঁষতে পারতো যারা তার চারপাশে থাকতো ‘জহুরী ভাই’ সম্বোধনে ডাকাডাকি চলতো। আর এভাবেই তাঁর আসল নামটা অবশেষে একেবারে চাপা পড়ে গেল। এমনকি কালেভদ্রে সালেহউদ্দিন আহমদ নামে চিনতো খুব কম লোকই। এতে প্রমাণ করে কলাম লেখক হিসেবে তিনি কতোটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। আমাদের দেশে এমন জনপ্রিয় কলাম লেখক সাংবাদিকের সংখ্যা খুব বেশী নেই। অতীতেও ছিলেন না। কিন্তু ব্যাপক পরিচিতি জুটেনি সম্ভবতঃ তাঁর আদর্শবোধ ও জীবন চেতনার জন্য।
পূর্বের প্রসঙ্গে চলি আসি। সোনার বাংলায় এসে সাংবাদিকতা শুরু করায় মনে মনে স্থির করলাম আমি নিজেকে একজন ভাল সাংবাদিক হিসেবে ধীরে ধীরে গড়ে তুলবো। তাই সাংবাদিকতায় কিভাবে ঋদ্ধতা অর্জন করা যায় এ ব্যাপারে জহুরী ভাইর পরামর্শ চাইলে তিনি স্বভাবসুলভ হাসি ছড়িয়ে বললেন- “কারু লাগে দশ বছর, কারু লাগে এক বছর। আপনার লাগবে এক বছর। আপনার ওস্তাদ লাগবে না যান। আমি বলে দিলাম।” এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে মরহুম জহুরী ভাইর বাড়ী বৃহত্তর সিলেট জেলায় এবং আমার দেশের বাড়ীও সিলেট। তাই, আমি উপস্থিত হলে তিনি আপ্লুত হয়ে সিলেটী বাক্ রীতিতেই কথা বলতে উৎসাহী হতেন। তবে তিনি বিশুদ্ধ সিলেটী রীতিতে কথা বলতেন না, একটা মিশ্রন ছিল। সিলেটী এবং ঢাকাইয়া দোআঁসলা বাচনিকতার মধ্য দিয়ে তিনি কথায় রস সৃষ্টি করতেন যা শ্রোতাকে আকৃষ্ট করতে সমর্থ হতো। অবশ্য কলাম লেখায় তা ধরা পড়তো না।
তাঁর সঙ্গে প্রায়শঃ দেখা সাক্ষাৎ হতো। সব সময় তিনি হাসি মুখে কৌতুক পরিবেশন করে বসতে বলতেন। তাঁর বাচনিকতায় একদিকে যেভাবে ছিল রস তেমনি ব্যঙ্গোক্তি। একজন রম্য লেখক হিসেবে তিনি আমার কাছে সব সময় প্রতিভাত হতেন। লেখার ভেতর দিয়ে তিনি যেভাবে সমাজ-দেশ-আন্তর্জাতিক নানা বিষয়ের উপর রম্য ভাষায় অসংগতি, আমানবিকতা, ষড়যন্ত্র, চক্রান্তকে অঙ্গুলি নির্দেশ করতেন, তেমনি একজন সত্যানিষ্ঠ মানুষ হিসেবে তিনি নিজেকে চাইতেন সব সময় মেলে ধরতে। নিজের মতো করে বলতেন। শুনতে একটুু কুট শোনালেও সত্যিকার অর্থে তাঁর কথায় অন্তর্নিহিত সত্যতা থাকতো।
জহুরী ভাইয়ের সঙ্গে আমার রয়সের ব্যবধানটা নেহায়েৎ কম না । অন্ততঃ উনিশ বিশ বছরের। তার মানে প্রায় পিতা পুত্রের ব্যবধান। কিন্তু তাঁর উদারতা এবং আপন করে নেবার অদ্ভুত চৌম্বক চারিত্রিক গুণ কখনো বুঝতে দেননি আমাদের মাঝে বয়সের এতো বড় দূরত্ব আছে। যখনি তার দপ্তরে এসেছি হয়তো তিনি কোন সম্পাদকীয় উপ-সম্পাদকীয় লিখছেন কিংবা কোন কিছু লেখার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, বিষয় নিয়ে ভাবছেন পত্রিকার ফাইল ঘেঁটে কিছু উদ্ধারে সচেষ্ট রয়েছেন। মুখোমুখি হওয়া মাত্রই সেই কাজ থামিয়ে একগাল হাসি ছড়িয়ে আমন্ত্রণ জানাতেন- বসুন। যদি বলতাম আপনি এখন ব্যস্ত, যাই। তিনি প্রবলভাবে আপত্তি তুলে বলতেন- না, না তেমন কোন ব্যস্ততা নেই- লেখক সাংবাদিকদের আড্ডা মারা গল্প করা এটাও কাজ- এটাও লেখার জন্য জরুরী। বসুন। আমার কোন সমস্যা হয় না।
আগেই বলেছি জহুরী ভাই ছিলেন একজন অতি জনপ্রিয় কলাম লেখক। তাঁর লেখার ঢঙ রম্য। পাঠক তাঁর লেখায় রস পেতো। তথ্য পেতো এবং কঠোর সমালোচনাও দেখতে পেতো- স্বভাবতঃই এসব ত্রিগুণের সমাহারের জন্য তিনি পাঠক নন্দিত হয়েছিলেন। সম্ভবতঃ তাঁর জনপ্রিয়তা ও পাঠকগ্রাহ্যতা আবিষ্কার করেই জনৈক প্রকাশক (তিনি আল ফালাহ প্রেসের ভূতপূর্ব ম্যানেজার)। ‘জহুরী’র জাম্বিল’ নামে গ্রন্থ প্রকাশে উদ্যোগী হলেন। বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাজার থেকে হাওয়া। মানে হটকেকের মতো বইটির কাটতি লক্ষ্য করা গেল। তাতে জহুরী ভাইয়ের লেখক মূল্য রাতারাতি আরও বেড়ে গেল। গ্রন্থ প্রকাশের বিষয়টিও সহজতর হয়ে গেল। এরপর তিনি অবিরাম লিখে গেছেন এবং গ্রন্থ প্রকাশও হয়েছে নেহায়েৎ কম না।
আমাদের দেশে সাংবাদিকের বই এভাবে প্রকাশ হয় না- বিক্রিও হয় না। তাঁর গ্রন্থের কয়েকটি সংস্করণ হওয়া ছিল খুব স্বাভাবিক ঘটনা। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের প্রকৃত সংখ্যা আমার এ মুহুর্ত্তে জানা নেই। তবে যেসব বই আমার হাতে এসে পড়েছে বা আমি জানতে পেরেছি সে গুলো হলোঃ
১। অপসংস্কৃতির বিভীষিকা (১ম, ২য়, ও ৩য় খন্ড) ২। জহুরীর জাম্বিল (১ম, ২য়, ও ৩য় খন্ড) ৩। মাস্তানদের জবানবন্দী ৪। তথ্য সন্ত্রাস ৫। খবরের খবর ৬। প্রেস্টিজ কনসার্ণড ৭। তিরিশ লাখের তেলেসমাতি ৮। ক্রিতদাসের মত যাদের জীবন ৯। ধূম্রজালে মৌলবাদ ১০। স্বজন যখন দুশমন হয় ১১। শব্দ সংস্কৃতির ছোবল ইত্যাদি। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা আরও অনেক বেশি এবং প্রকাশিত গ্রন্থগুলিতে গভীর অন্বেষা, চিন্তাশীলতা তথ্য ও বিশ্লেষণে সমৃদ্ধ।আমাদের সাহিত্যের একটা ধারা হচ্ছে- রম্য রচনা। কিন্তু রম্য লেখকের সংখ্যা খুব বেশি নয়। বিশেষ করে সীরিয়াস বিষয় নিয়ে রম্য রচনা করে পাঠকনন্দিত হয়েছেন এঁদের সংখ্যা একেবারে অঙ্গুলিমেয়। রম্য লেখক হিসেবে প্রথমেই যার নাম উল্লেখ করতে হয় তিনি সৈয়দ মুজতবা আলী। ঘটনা চক্রে তাঁর বাড়িও বৃহত্তর সিলেট জেলায়। ষাট দশকে ‘কালো পেঁচার ডায়েরী’ শীর্ষক কলাম লেখক আবদুল গনী হাজারী অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। আবুল মনসুর আহমদ তো বাংলা রম্য লেখকদের পথ প্রদর্শক। বিশেষ করে সিরিয়াস বিষয় নিয়ে রম্য ভাষায় পাঠক প্রিয়তা লাভের উৎকৃষ্ট উদাহরণ আবুল মনসুর আহমদ। এরপর আশির দশকে দৌর্দন্ড প্রতাপের সঙ্গে রাজত্ব করেছেন সংবাদপত্র জগতে খন্দকার আলী আশরাফ (দুর্জন উবাচ) ওসমান গনি এবং লুৎফর রহমান সরকার প্রমুখ। জহুরী কিন্তু এঁদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন মেজাজের লেখক। সমাজ দেশ ও মুসলিম উম্মাহ সম্পর্কে তাঁর ছিল গভীর মমতা এবং ভিন্ন পর্যবেক্ষণ। দরদী হৃদয় সুচিন্তিত বিবেচনা প্রসূত ও যুক্তির সমন্বয়ে শানিত ভাষায় তিনি লড়াই করেছেন কলম সৈনিক হিসেবে। দায়িত্বশীলতা তাঁর লেখার প্রধান গুণ।
আবার বক্তিগত পর্যায়ের ঘটনায় চলে যাই। ১৯৮৯ সনের সেপ্টেম্বর মাসের ঘটনা। আমি তাঁর দপ্তরে গিয়েছি। তিনি বললেন আমি একটা বই লিখছি-বিষয়টি একটু ভিন্ন ধরণের। ভারতের কংকাল ব্যবসায়ের উপর নয়াদিল্লী থেকে রয়টার একটা খবর পরিবেশন করেছে। রিপোর্টে ভারত থেকে বিশ্বের ২১টি দেশে নরকংকাল রপ্তানী হওয়ার কথা বলেছে। পরবর্তীতে পশ্চিম বাংলার একটি পাক্ষিক পত্রিকায় এর উপর একটি সচিত্র বিস্তারিত প্রতিবেদন কভার স্টোরী করেছে। এ বিষয়ে আপনার কাছে কোন তথ্য থাকলে আমাকে জানাতে ভুলবেন না। আমি তৎক্ষনাৎ তাঁকে জানালাম পশ্চিম বাংলার পাক্ষিক পত্রিকা ‘প্রতিক্ষণ’ আমার কাছে আছে। আপনাকে আমি তা দিতে পারবো। আমি যথারীতি কিছুদিন পর অনেকগুলো সংখ্যা সম্বলিত এক সংগে বাঁধানো এক সেট ‘প্রতিক্ষণ’ তাঁকে দিয়ে আসলাম। জহুরী ভাইয়ের ‘খবরের খবর’ গ্রন্থের সবচেয়ে মূল্যবান লেখাটি আমার সরবরাহকৃত তথ্যের মাধ্যমে আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। তিনি তাঁর প্রবন্ধে একথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন এভাবে- ‘কিন্তু পাক্ষিক প্রতিক্ষণ ম্যাগাজিন দেখার ও পাওয়ার আগ্রহ তাতে আরো বেড়ে যায়। প্রতিক্ষণ পাওয়ার এই অস্থিরতার কথা সাপ্তাহিক সোনারবাংলার নিউজ ইনচার্জ বন্ধুবর জনাব সোলায়মান আহসানকে একবার জানিয়েছিলাম। তিনি ৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৮৯ সোমবার প্রতিক্ষণের সেই সংখ্যাটি আমার কাছে নিয়ে আসেন’।
জহুরী ভাইয়ের তথ্য গ্রহণ এবং পরিবেশনে এই যে সতর্কতা ও সততা তা একজন সৎ লেখক ও মহৎ প্রাণের মানুষেরই পরিচয় বহন করে। জহুরী ভাইয়ের লেখার মূল্যায়ন এখানে সম্ভব নয়। সে প্রয়াস থেকে এখানে বিরত থাকছি। তবে মূল্যায়নের দায় সম্পর্কে একটি অনুভূতির কথা বলতে চাই। জহুরী ভাইকে যেভাবে শ্রদ্ধা করতাম তেমনি ভয়ও পেতাম। আমার মতো প্রায় সবার অবস্থাই সমান মনে হয়। কারণ জহুরী ভাই ছিলেন স্পষ্টবাদী লেখক। স্বভাবসুলভ রম্যভাষায় তিনি সমালোচনা মুখর থাকতেন। যে কারণে খানিকটা ভয় এবং সংকোচ কাজ করতো তাঁর সঙ্গে মিশতে বা কথা বলতে।
জহুরী ভাই দৈনিক সংগ্রামে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। কিন্তু এক পর্যায়ে সংগ্রাম ছেড়ে চলে যান ‘দৈনিক মুজদ্দেদ’ পত্রিকায়। কারণটা নিশ্চয়ই প্রিয় প্রসঙ্গ নয়। তবে মন মগজ ছিল সংগ্রামের জন্য উপযুক্ত। তাই, সেখানে থেকেও তিনি সংগ্রামসহ আমাদের প্রত্রিকাগুলোতে লিখতেন। এক পর্যায়ে তিনি পুনরায় সংগ্রামে প্রত্যাপর্তন করেন। ফিরে আসার পর আমি একদিন দৈনিক সংগ্রামে গিয়েছি। তাঁর সঙ্গে দেখা। দেখে মনে হলো তাঁর পূর্ব পরিচিত স্থানে ফিরে এসে খুব একটা তৃপ্ত নন। এ বিষয়ে আমি তেমন কথা বাড়াইনি। তাঁর স্বাস্থ্যগত অবস্থা ততো ভাল না বলে মনে হলো। তাঁর শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিতে চাইলে তিনি স্বভাসুলভ ভঙ্গিতে দায়সারা জবাব দিলেন। এমনিতে তার সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতা এক কঠিন কাজ। সেদিন তেমন মনে হলো না। অনেকক্ষণ কথা বলার পর তিনি হঠাৎ জানতে চাইলেন- আপনার কাছে আমার কোন্ কোন্ বই আছে দয়া করে একদিন আমাকে লিস্ট দিয়ে যাবেন। যেগুলো নেই আমি আপনাকে পৌঁছাবো। আর এই নিন আমি চিরকুট দিচ্ছি যাবার সময় তাসমিয়া লাইব্রেরী থেকে বই তিনটি নিয়ে যাবেন। বলা তো যায় না মানুষের কথা।
সেদিন বই তিনটি নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু বইয়ের লিস্ট দেওয়া আর হয়নি। দিই দিই করে দেওয়া হয়নি। এরপর আরও কয়েক দিন তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে। মনেই হয়নি জহুরী ভাই সহসা চলে যাবেন। প্রচন্ড ব্যস্ত ছিলাম একটি জাতীয় সেমিনার অনুষ্ঠান নিয়ে। সেই ব্যস্ত মুখর সময়ে দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায় একটি ছোট্ট নিউজ চোখে পরল। তাঁর মৃত্যু সংবাদ। বিশ্বাস করা কঠিন হচ্ছিল এমন অসময়ে, নোটিশ না দিয়ে জহুরী ভাই চলে গেলেন। তবে আজ বুঝতে পারছি কেন তিনি তাঁর প্রকাশিত বইগুলো দিতে চেয়েছিলেন। তিনি হয়তো আমাকে গভীরভাবে ভালবাসতেন। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন একই অঞ্চলের অধিবাসী হিসেবে, স্বাভাবিক দায়িত্ব বোধ ও শ্রদ্ধার বশবর্তী হয়ে তাঁর সাহিত্যের মূল্যায়ন একদিন করবো। হ্যাঁ, আমি তাঁর ইঙ্গিত বুঝতে পেরেছি। আল্লাহতা’লা আমাকে দিয়ে তাঁর মনোবাঞ্ছা পূরণ করুন সেই ইচ্ছার কথা এখানে জানিয়ে রাখলাম।
লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট