ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের প্রভাব ভারতের উপর কতটা পড়বে?

অর্থনীতি আন্তর্জাতিক পর্যটন মধ্যপ্রাচ্য সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

গৌতম হোড় দিল্লি, ডিডাব্লিউ

ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের প্রভাব বিশ্বের প্রায় সব দেশের উপরেই পড়ছে। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। ভারত বিশেষভাবে চিন্তিত অশোধিত তেলের দাম এবং তা আমদানি করার খরচ বেড়ে যাওয়ায়। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের সময় রাশিয়া থেকে কম দামে তেল আমদানি করতে পেরেছিল ভারত। ফলে সেই যুদ্ধের আঁচ ভারতের অর্থনীতিতে সেইভাবে পড়েনি। কিন্তু ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সাম্প্রতিক সংঘাত শুরু হওয়ার পর তার প্রতিক্রিয়া ভারতের উপর ভালোভাবেই এসে পড়েছে।

ভারত অশোধিত তেলের জন্য মধ্যপ্রাচ্য, রাশিয়াসহ কিছু দেশের উপর নির্ভরশীল। ৮০ শতাংশ তেল ভারতকে আমদানি করতে হয়। তাই বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়ে গেলে ভারতের উপর তার বিপুল প্রভাব পড়ে। জিডিপি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, জিনিসের দাম বাড়ে, বেশ কিছু শিল্প প্রভাবিত হয়। আর ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের ফলে ইরানের আকাশপথ বন্ধ, হরমুজ প্রণালী দিয়ে জাহাজ যাতায়াতে অসুবিধা দেখা দিয়েছে। ফলে জাহাজ ও বিমানকে অনেক ঘুরে যেতে হচ্ছে। তার একটা প্রভাব রয়েছে। বিমার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। সবমিলিয়ে এই সবের প্রভাব ভারতের অর্থনীতির উপর ভালোকরেই পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ভারতীয়দের ইরান থেকে দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়াও চলছে।

ইওয়াই ইন্ডিয়ার প্রধান নীতি বিষয়ক পরামর্শদাতা ডি কে শ্রীবাস্তব সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ”২০২৫-২৬ আর্থিক বছরের শুরুতে অশোধিত তেলের দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ৬৪ দশমিক তিন ডলার। ইসরায়েল-ইরানের সংঘাতের পর তার দাম বাড়তে শুরু করেছে। প্রতি ব্যারেলে যদি ১০ ডলার বাড়ে, তাহলে জিডিপি কমবে শূন্য দশমিক শূন্য তিন শতাংশ, কনজিউমার প্রাইস ইনডেক্স বাড়বে শূন্য দশমিক চার পয়েন্ট।”

ইতিমধ্যেই বিপিসিএল, এইচপিসিএল, ইন্ডিয়ান অয়েলের শেয়ার সাড়ে তিন শতাংশ পড়ে গেছে।

ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিসের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং এক্সাইজ ও কাস্টমস বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান সুমিত দত্ত মজুমদার কর্মসূত্রে চারবছর মধ্যপ্রাচ্যে ছিলেন। ডিডাব্লিউকে তিনি বলেছেন, ”এখানে ইসরায়েল এবং ইরান দুজনেই ভারতের বন্ধু দেশ। তাই ভারত দুই বন্ধু দেশের সংঘাত নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। ইরান ভারতকে বন্ধুত্বপূর্ণ শর্তে তেল দেয়, যা দিল্লির জন্য খুব দরকার। ইসরায়েলের সঙ্গেও সুসম্পর্ক রাখা দরকার। তেলের দাম বাড়লে ভারতের সমস্যা তো হবেই। আর ভবিষ্যতের কথা ভেবে, ইরান এবং ইসরায়েল দুই দেশের সঙ্গেই ভারতের সম্পর্ক ভালো রাখতে হবে। ফলে ভারতের সাম নে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ দুটোই আছে।‘‘

ভারতের উপর কোথায় প্রভাব পড়বে?

সম্প্রতি ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাবধান করে দিয়ে বলেছেন, সংঘাত আরো তীব্র হলে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি দুইশ থেকে তিনশ ডলার পর্যন্ত যেতে পারে। গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ(জিটিআরআই)-এর রিপোর্ট বলছে, ভারত সরকারের উচিত, আরো দেশ থেকে অশোধিত তেল কেনা এবং তেলের স্ট্র্যাটেজিক রিজার্ভ তৈরি করা।

ভারতের সাবেক অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিনহা ডিব্লিউকে বলেছেন, ”ভারতের কাছে একটা স্ট্র্যাটেজিক অয়েল রিজার্ভ আছে। যখন তেলের দাম কম থাকে, তখন তা রিজার্ভ করে রাখা হয়।”

দ্য টেলিগ্রাফের দিল্লিতে অর্থনীতি বিষয়ক সাবেক সম্পাদক জয়ন্ত রায়চৌধুরী ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ‘’ভারতকে অবশ্যই পেট্রোলিয়ামের স্ট্র্যাটেজিক মজুতনীতি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। এজন্য স্টোরেজ ব্যবস্থায় বিনিয়োগ আরো বাড়াতে হবে। বন্ধু দেশগুলির সঙ্গে মজুত বিনিময় চুক্তি করাও দরকার।”

ভারতের বাসমতী চাল ইরানে প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি করা হয়। ২০২৪-২৫ আর্থিক বছরে ভারত থেকে ছয় হাজার ৩৭৪ কোটি টাকার বাসমতী চাল ইরান গেছিল। ভারতের সঙ্গে ইরানের মোট বাণিজ্যের পরিমাণ এক হাজার কোটি ডলার। তেল, কৃষি, প্রতিরক্ষা, এআইসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুই দেশের বাণিজ্য হয়। ইরানের চাবাহার বন্দরে ভারত আট কোটি ৫০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করেছে। সেটা নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

ভারতের আরেকটি আশঙ্কার জায়গা আছে। ভারতের আন্তর্জাতিক ডেটা ট্র্যাফিক কেবল সমুদ্রের তলা দিয়ে গেছে। ৯৫ শতাংশ কেবলই মধ্যপ্রাচ্য হয়ে গেছে। সেই কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হলে ভারতের দুই লক্ষ ৪৫ হাজার কোটি ডলারের ডিজিটাল অর্থনীতি সংকটে পড়বে।

যশবন্ত বলেছেন, ”মধ্যপ্রাচ্য অশান্ত হলে, বিশেষ করে হরমুজ প্রণালী বন্ধ থাকলে বা নিরাপদ না হলে তার বিপুল প্রভাব ভারতের উপর পড়বে। কারণ, এর প্রভাব জাহাজ চলাচলের উপর পড়বে। জাহাজগুলিকে অনেক ঘুরে যেতে হবে।”

তার ফলে জাহাজে জ্বালানি খরচ বাড়বে, বিমার খরচ বেড়ে যাবে, ছোট ও মাঝারিমাপের আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে জড়িতরা ভয়ংকর সমস্যায় পড়বেন।

যশবন্ত জানিয়েছেন, ”ইসরায়েলের উপরও ভারত ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক পণ্যের বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল। ফলে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।”

আর কোথায় প্রভাব পড়বে?

অশোধিত তেলের দাম বাড়লে বিমানের জ্বালানির দামও বাড়বে। সেক্ষেত্রে বিমানের ভাড়া বাড়বে। তখন বিমান যাত্রার চাহিদাও কমতে পারে। পেইন্ট বা রং উৎপাদকরাও তেলের দাম বাড়লে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং রং-এর দাম বাড়বে। নাইট্রোজেন ভিত্তিক সারের উৎপাদন খরচ বাড়বে, গাড়ি নির্মাতারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

এই সংঘাত প্রলম্বিত হলে তখন তার প্রভাব বড়ো আকারে ভারতের কর্পোরেটগুলির উপরে পড়বে।

জয়ন্ত মনে করেন, ”শুধু তেলের দাম নয়, ভারতের বাণিজ্য ব্যবস্থাও এই সংঘাতে বিপর্যস্ত হতে পারে। রেড সি বা লোহিত সাগর হয়ে পণ্য পরিবহনের জন্য বিমার খরচ দ্বিগুণ হয়ে গেছে। অনেক জাহাজ সংস্থা সুয়েজ খাল এড়িয়ে গিয়ে আফ্রিকার চারপাশ ঘুরে যাচ্ছে—ফলে সময়, খরচ এবং প্রতিযোগিতা—সবই বাড়ছে। পোশাক, কৃষিপণ্য, অটো পার্টস, ও হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যের ব্যবসা তাতে প্রভাবিত হবে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *