ইসরায়েলি বন্দিত্ব থেকে মুক্ত পুরস্কারপ্রাপ্ত ফিলিস্তিনি কবি মোসাব আবু তোহা

মধ্যপ্রাচ্য সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন
আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
ইসরায়েলি বোমা হামলায় বিধ্বস্ত গাজা উপত্যকার উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণাঞ্চলে যাওয়ার সময় ইসরাইয়েলি বাহিনীর চেকপয়েন্টে গত ১৯ নভেম্বর গ্রেফতার করা হয় খ্যাতনামা তরুণ ফিলিস্তিনি কবি মোসাব আবু তোহা’কে। তবে গত ২১ নভেম্বর ইসরায়েলি সামরিক কর্তৃপক্ষ তাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছে সাংবাদিকদের। দ্য গার্ডিয়ানের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, ইসরায়েলিরা তাকে মারধোর করেছে এবং এখন তিনি পরিবারের কাছে ফিরে চিকিৎসা গ্রহণ করছেন। পেন আমেরিকা এক বিবৃতিতে বলেছে, “কবি ও লেখকদের অবশ্যই ভয়ভীতির উর্ধে উঠে সত্য বলার স্বাধীনতা থাকতে হবে।”
গতবছর প্রকাশিত কবি মোসাব আবু তোহা’র প্রথম কাব্য গ্রন্থ “তুমি আমার কানে যা লুকোনো দেখতে পাবে,” (Things You May Find Hidden in My Ear) ‘প্যালেস্টাইন বুক অ্যাওয়ার্ড’ এবং ‘আমেরিকান বুক অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেছে এবং গতবছরই গ্রন্থটি আমেরিকার ‘দ্য ন্যাশনাল বুক ক্রিটিকস সার্কেল অ্যাওয়ার্ড,’ ও ‘দ্য ওয়ালকট পোয়েট্টি প্রাইজ’ এর চূড়ান্ত তালিকায় স্থান পেয়েছিল।
মোসাব আবু তোহা মাত্র এক মাস আগে ‘দ্য নিউইয়র্কার’ এ এক নিবন্ধে গাজার জীবন ও ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বোমা হামলার সন্ত্রাস ও ধ্বংসযজ্ঞোর বিবরণ লিখেছিলেন। তার লেখায় ফুটে উঠেছিল যে, এই ভয়াবহতার মধ্যে হয়তো তিনি, তার পরিবারের সদস্য ও পরিচিত জনেরা নিহতের পরিসংখ্যানে এক একটি সংখ্যা হবেন মাত্র। এর অতিরিক্ত আর কিছু নয়।
২০ নভেম্বর দ্য নিউইয়র্কারের এক্সিকিউটিভ এডিটর মাইকেল লো জানান যে আবু তোহার সঙ্গে তিনি যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছেন এবং পরে জানতে পারেন ইসরাইলিরা তাকে গ্রেফতার করেছে এবং সোমবার পত্রিকাটি তাদের একটি রিপোর্টে উদ্বেগ প্রকাশ করে যে তাকে কোথায় নেয়া হয়েছে তা জানা যায়নি। রিপোর্টে তার নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়।
ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভুত কানাডীয় আইনজীবী ডায়ানা বুত্তু’র সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল আবু তোহার। তিনি জানান, আবু তোহার তিন সন্তানের মধ্যে তিন বছর বয়সী পুত্র আমেরিকান সিটিজেন। তাকে উদ্ধারের জন্য মিশরে আমেরিকান দূতাবাসে আবেদন করা হয়েছিল দুই সপ্তাহ আগে এবং এ সংক্রান্ত ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পর উত্তর গাজা থেকে দক্ষিণ গাজায় মিশর সংলগ্ন রাফাহ সীমান্ত পর্যন্ত যাওয়া নিরাপদ বিবেচিত হলে তিনি পরিবার ও অন্যান্যের সঙ্গে ১৯ নভেম্বর রওয়ানা হন এবং মাঝপথে ইসরায়েলি বাহিনী আবু তোহাকে সহ অনেককে আটক করে। বিষয়টি প্রচার মাধ্যমে আসার পর আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্ট সিএনএন কে জানায় যে, আবু তোহাকে আটক করা সম্পর্কে তারা কিছু জানে না, তবে ইসরাইয়েলি কর্তৃপক্ষ কবি আবু তোহার ব্যাপারে সতর্ক হয়।
মোসাব আবু তোহা ১৯৯৩ সালে আল-শাতি নামে এক শরণার্থী শিবিরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ গাজা থেকে ইংরেজি সাহিত্যে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন। এর আগে তিনি ২০১৭ সালে বেইত লাহিয়া সিটিতে ‘এডওয়ার্ড সাঈদ লাইব্রেরি নামে গাজা উপত্যকায় প্রথম ইংরেজি ভাষার গ্রন্থের লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন। ২০১৯ সালে এ লাইব্রেরি দ্বিতীয় শাখা প্রতিষ্ঠিত হয় গাজা সিটিতে। তিনি গাজায় জাতিসংঘের রিলিফ এন্ড ওয়ার্ক এজেন্সি পরিচালিত স্কুলে ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে চাকুরি করেছেন ২০১৬ থেকে ২০১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ২০১৯ সালের অক্টোবরে তিনি ‘স্কলার-অ্যাট-রিস্ক’ ফেলোশিপে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং স্কলার হিসেবে যোগ দেন। কবিতার ওপর মাস্টার্স ডিগ্রি নেন সিরাক্যুজ ইউনিভার্সিটি থেকে এবং গাজায় ফিরে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি সেখানে টিচিং অ্যাসিস্ট্যন্ট হিসেবেও কাজ করেন।
ইসরায়েল যখন উত্তর গাজাবাসীদের নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার আহবান জানাচ্ছিল তখন তিনি পরিবার নিয়ে জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন। এসময় তিনি ফেসবুক পোস্টে লিখেন, “আমি জাবালিয়া শিবিরে আমার সাময়িক আবাসে বসে যুদ্ধবিরতির অপেক্ষা করছি। মনে হচ্ছে, আমি খাঁচায় আটকা পড়ে আছি। আমার লোকজনের সঙ্গে আমি প্রতিদিন নিহত হচ্ছি। আমি যে দুটি জিনিস করতে পারি, তা হলো, আতঙ্কিত হওয়া ও নি:শ্বাস নেয়ার এখানে কোনো আশা নেই।”
কবি আবু তোহা গত ১৫ নভেম্বর ফেসবুকে গাজার নারকীয় অবস্থা নিয়ে লিখেছেন: “আমরা এখনো বেঁচে আছি। আপনাদের সকলের দোয়ার জন্য ধন্যবাদ। আমাদের খাবার বা বিশুদ্ধ পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। শীত আসছে এবং আমাদের পর্যাপ্ত জামাকাপড় নেই। আমাদের সন্তানেরা কষ্ট পাচ্ছে। আমরা কষ্ট ভোগ করছি। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এখন আল-শিফা হাসপাতালে। কে থামাতে পারে আরো মৃত্যু, আরো ধ্বংস? মেহেরবানি করে এখনই এসব বন্ধ করুন”
মোসাব আবু তোহা’র কবিতা
তুমি আমার কানে যা লুকোনো দেখতে পাবে
তুমি যখন আমার কান খুলবে,
তখন আলতোভাবে কান স্পর্শ করো,
ভেতরে কোথাও অনুরণন আছে আমার মায়ের কণ্ঠের,
তার কণ্ঠের প্রতিধ্বনি আমাকে সাহায্য করে ভারসাম্য ফেরাতে
আমার একাগ্রতার সময় যখন আমি মাথা ঘোরা অনুভব করি,
তখন তুমি তোমার কানে হয়তো আরবি গানের সুর শুনবে,
আমি তখন মনে মনে ইংরেজি কবিতা আবৃত্তি করি,
অথবা বাড়ির আঙিনায় পাখিদের জন্য গাওয়া আমার একটি গান।
ক্ষতস্থান সেলাইয়ের সময় এসব আমার কানে রেখে দিতে ভুলো না।
তুমি শেলফে যেভাবে বই রাখো ঠিক সেভাবে সব গুছিয়ে রেখে দাও।
ড্রোনের টানা গুঞ্জন,
এফ-১৬ এর গর্জন,
বাড়িঘর, মাঠ এবং দেহের ওপর
পতিত বোমার প্রচণ্ড, তীক্ষ্ম আওয়াজ,
উড়ে যাওয়া রকেটের শোঁ শোঁ শব্দ থেকে
আমার কানের ক্ষুদ্র-পথ মুক্তি লাভ করুক।
ক্ষতস্থানে ছিটিয়ে দাও তোমার হাসির সুবাস।
আমাকে জাগাতে আমার শিরায় ভরে দাও জীবনের গান।
ঢাকে মৃদু আঘাত করো, যাতে আমার মনও তোমার মনের সাথে নাচে,
আমার ডাক্তার, আমার দিন ও রাত।
আমার দাদা এবং আমার বাড়ি
ফিরে আসার প্রতীক্ষায় আমার দাদা আঙুলে দিন গুনতেন
এরপর গণনা করতে তিনি ব্যবহার করতেন পাথর,
কিন্তু যথেষ্ট সংখ্যক পাথর ছিল না,
অত:পর তিনি মেঘ, পাখি ও মানুষ গুনতেন।
ক্রমে অনুপস্থিতি দীর্ঘ, অতি দীর্ঘ হয়ে উঠলো,
তার মৃত্যু পর্যন্ত দীর্ঘ ছত্রিশটি বছর,
আমাদের হিসেবে এখন সত্তর বছরের বেশি।
আমার দাদা তার স্মৃতি শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন,
তিনি সংখ্যা এবং মানুষের সংখ্যা বিস্মৃত হয়েছিলেন
তিনি বাড়ির কথা ভুলে গিয়েছিলেন।
দাদা, আমি যদি তোমার সঙ্গে থাকতে পারতাম,
তাহলে আমি স্বয়ং তোমাকে বহু সংখ্যক কবিতা
অনেক কবিতা লিখতে শেখাতে পারতাম,
এবং তোমার জন্য আমাদের বাড়ি রং করতাম,
আমি তোমাকে মাটি থেকে সেলাই করিয়ে নিতাম
এমন একটি জামা, যা গাছপালায় সাজানো থাকতো,
এবং তোমার রোপন করা গাছগুলোর মধ্যে
কমলা থেকে তোমার জন্য সুগন্ধি তৈরি করতাম,
আনন্দের আকাশ ভরা অশ্রু দিয়ে তৈরি করতাম সাবান,
এর চেয়ে খাঁটি আর কোনোকিছুর কথা ভাবতে পারি না।
৩,
প্রতিদিন আমি গোরস্থানে যাই,
সেখানে ব্যর্থভাবে খুঁজি তোমার কবর,
ওরা কি নিশ্চিত যে ওরা তোমাকে কবর দিয়েছিল?
নাকি তুমি একটি গাছে রূপান্তরিত হয়েছো?
অথবা তুমি কোনো পাখির সঙ্গে উড়ে গেছো অজানায়?
আমি তোমার ছবি একটি মাটির পাত্রে রেখেছি,
প্রতি সোমবার সেই ছবিতে আমি পানি দেই,
এবং বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আমাকে বলা হয়
ওই দিনগুলোতে তুমি রোজা রাখো।
রমজান মাসে আমি প্রতিদিন পানি দেই,
ত্রিশটি দিন ধরে আমি পানি দেই,
অথবা এর চেয়ে কম বা বেশি দিন।
আমাদের বাড়িটি কত বড়ো হওয়া উচিত বলে ভেবেছিলে?
তুমি সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত আমি কবিতা লিখে যেতে পারি,
যদি চাও, আমি পাশের দু’একটি গ্রহকে যোগ করতে পারি,
কারণ, এই বাড়ির জন্য আমি কোনো সীমানা টেনে দেইনি,
কোনো যতি চিহ্নও আঁকিনি।
      
* আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *