মো: বজলুর রশীদ
পৃথিবী এগিয়ে যাওয়ার সময়, কেউ পুরনোকে আঁকড়ে থাকার স্বপ্ন দেখেন। ফারসি ভাষার একটি আকর্ষণীয় শব্দ ‘খোর’ মানে খাওয়া, আরেকটি, ‘খার’ মানে পানীয় রয়েছে; পাকিস্তানে উর্দুতেও ব্যাপকভাবে শব্দ দু’টি ব্যবহৃত হয়। মানে পান করো আর খাও। বিয়েশাদিতে এই শব্দ দু’টি বেশি ব্যবহৃত হয়, ওমর খৈয়ামও লিখেছিলেন খাও, পান করো আর ফুর্তি করো।
পাঞ্জাবে জনপ্রিয় খাবার হলো পোলাও, সিন্ধুতে এটি সিন্ধি বিরিয়ানি; রাজতন্ত্রের পতনের আগে ফ্রান্সের শেষ রানী মারি আন্টোইনেটের কাছে খাবার এসব শব্দ প্রিয় ছিল। তিনি ক্ষুধার্ত জনসাধারণের জন্য বলতেন, রুটি দিতে না পারলে, কেক খেতে দাও! পাকিস্তানের বিরোধী নেতারাও ‘নয়া পাকিস্তানের’ পরিবর্তে ‘পুরনো পাকিস্তানের’ জিগির তুলছেন। আহ! রাজনীতির কী রঙ!
দুর্ভাগ্যবশত ‘পাক স্থান’ বা বিশুদ্ধ দেশে, ১৯৮৫ থেকে ২০১৮ এই ৩৩ বছর বড় বড় পার্টি হয়েছে যেখানে শুধু ‘খোর এবং খার’ পরিবর্তে ‘ওয়াইনিং’ এবং ‘ডাইনিং’ চালু হয়েছে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে তিনটি ধারা বিদ্যমান। ১. আসল ধারায়- জিন্নাহ, ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত। ২. পুরনো পাকিস্তান-জিয়াউল হক, নওয়াজ শরিফ, জারদারি ১৯৭৭ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত। ৩. নয়া পাকিস্তান-ইমরান খান ২০১৮ থেকে এপ্রিল ২০২২। ৪. পুরনো পাকিস্তান এপ্রিল ২০২২ থেকে শুরু ও ক্রমিক ২ এর ধারাবাহিকতা।
১৯৭৯ সালের এপ্রিলে ভুটোর বিচারিক হত্যাকাণ্ডের পর, তার মেয়ে বেনজির চেষ্টা করলেও ২০০৭ সালে তিনিও গুপ্ত হত্যার শিকার হন। সম্প্রতি বিরোধীদলীয় নেতা ও পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ গর্বিতভাবে ঘোষণা করেছেন যে জনগণ ‘পুরনো পাকিস্তান’-এর জন্য আকাক্সিক্ষত! তার কথাগুলো সম্রাজ্ঞী মারি অ্যান্টোইনেটের কথার মতোই। অথচ তিনিই নওয়াজ শরিফের অফশোর দুর্নীতির প্রধান সহচর এবং নিজেও অর্থ পাচার মামলায় আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযুক্ত।
সামরিক শাসক আইয়ুব খান যখন তার অগ্রগতির দশক ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৮ উদযাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তখন বলা হয়েছিল ফরাসি বিপ্লবের মতো ‘এই দশক সেরা এবং সবচেয়ে খারাপ সময়।’ পুলিশ বাহিনীর টিয়ার গ্যাস ও তার ‘হালাকু খানদের’ লাঠিচার্জ বিক্ষোভ দমন করতে পারেনি। সমালোচকরা বলছেন, প্রজাতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক পতনের মুখোমুখি, ‘আসল পাকিস্তান’ নির্মাতাদের সব পরিশ্রম পুরনো পাকিস্তানের দুর্বৃত্তদের দ্বারা নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছে।
এমনকি হজ ও ওমরাহর মতো ধর্মীয় বাধ্যবাধকতাগুলোও সরকারি খরচে সম্পাদিত হয় যদিও তা করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। তীর্থযাত্রা ব্যক্তিগত সামর্থ্যরে সাথে আবদ্ধ, ক্ষমতা এবং সুযোগ-সুবিধার অপব্যবহার নয়। জনসাধারণের তহবিল সাধারণ কল্যাণে, ব্যক্তিগত ধার্মিকতার পরিপূর্ণতায় নয়। নয়া পাকিস্তানের উত্থানের জন্য, আরো অনেক কিছু করা দরকার; ‘খোর-খার’-এর পুরনো পথে ফিরে যাওয়ার পথও রুদ্ধ করা দরকার।
ইমরান খান তার পিটিআই সরকারের কর্মক্ষমতার বিষয়গুলো জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করেছেন নির্বাচন সামনে রেখে। যেখানে মূল সাফল্যগুলো তুলে ধরা হয়েছে যাতে সাধারণ মানুষ নয়া পাকিস্তানকে বুঝতে সক্ষম হয়।
প্রসঙ্গক্রমে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১০ বছর পর উন্নয়নের সফল দিকগুলো তুলে ধরে ‘ফ্রেন্ডস নট মাস্টারস’ প্রভু নয় বন্ধু বইটি লিখেছিলেন। সেখানে উন্নয়নের বিষয়গুলো তুলে ধরা হলে এ দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা সমালোচনা করে ‘ভূতের দশক’ নামে নিবন্ধ লিখে প্রচণ্ড সমালোচনা করে। কিন্তু পরে বিশ্লেষকরা বলেছেন, দেশের মূল যোগাযোগ ও উন্নয়নের মৌলিক কাজগুলোর ভিত্তি তিনিই করেছিলেন। পিটিআইয়ের অধীনে, কোভিড অতিমারি সত্ত্বেও পাকিস্তান উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন করেছে, দেশের রফতানি বেড়েছে। বিদেশী বিনিয়োগও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের র্যাংকিংয়ে পাকিস্তানের ১৪৮ পয়েন্ট থেকে ১০৮ পয়েন্টে উন্নীত হয় ইমরান খানের আমলে; বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধিতে মাইলফলক অর্জন করে। পিটিআই বলেছে, ২০২৩ সালের মধ্যে রফতানির রেকর্ড স্তরে পৌঁছাবে কিন্তু জনাব খানকে অতদূর থাকতে দেয়া হয়নি।
দুর্বলদের সুরক্ষায় পিটিআই সরকার প্রায় ৩৬টি সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচি চালু করে। সরকারের ফ্ল্যাগশিপ প্রোগ্রাম দারিদ্র্য, কর্মহীনতা ও স্বাস্থ্যের মতো সমস্যাগুলো সমাধানে রাষ্ট্র দায়িত্ব নিতে শুরু করে। প্রকল্পটি জনগণের কল্যাণে সরকারি সম্পদের কার্যকর ব্যবহারও নিশ্চিত করেছে।
পাকিস্তান বিশ্ব উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে সক্রিয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। খানের মতে, বনধ্বংস কার্যক্রম পরিবেশকে প্রভাবিত করেছে। পাকিস্তান বিশ্ব উষ্ণায়নের বিশাল হুমকির সম্মুখীন হয়েছে বিধায় গাছ লাগানো গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এর ফলে নয়া পাকিস্তানের তিন বছর এক বিলিয়ন গাছের বাগান সৃষ্টি হয়; এখন ব্যাপক বৃক্ষরোপণ অভিযানে ১০ বিলিয়ন গাছ লাগানো শুরু হয়। পিটিআইয়ের সাফল্যের গল্প নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বন্যা হলেও বিরোধী দল জনাব খানের সমালোচনায় তৎপর।
শাহবাজ শরিফ দাবি করেন, পিটিআই সরকার তিন বছরে ৫০০ শতাংশেরও বেশি ওষুধের দাম বাড়িয়েছে, যার মধ্যে জীবনরক্ষাকারী ওষুধও রয়েছে। বিরোধী দল দাবি করে, পাকিস্তানে দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতি এখনো অব্যাহত রয়েছে।
পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে মসজিদের ইমামদের জন্য মাসিক ভাতা চালু করা হয়েছে। যেসব ইমামের আয়ের অন্য কোনো উৎস নেই, তাদের আর্থিক সঙ্কট মেটাতেই এটি চালু করা হয়। ইমরান খান বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য পাকিস্তানকে একটি ইসলামিক কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করা। আমরা ২৫ বছর ধরে এর জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’ জানা যায়, এ প্রকল্পের মাধ্যমে ছয় হাজার ইমাম উপকৃত হয়েছেন। তাদের প্রতি মাসে ২১ হাজার রুপি করে দেয়া হচ্ছে। প্রশংসনীয় এ উদ্যোগ দেশের অন্য প্রদেশগুলোতেও চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।
এর আগে ইমরান খান দেশে ‘পাকিস্তান কার্ড’ চালু করেছিলেন। এতে স্বাস্থ্য কার্ড ও রেশন কার্ডের মতো কল্যাণমূলক উদ্যোগগুলো যুক্ত করা হয়েছিল। দেশটির সরকার প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকার কম উপার্জনকারী পরিবারগুলোকে সাহায্য করতে ১২০ বিলিয়ন রুপি বরাদ্দ করেছে। এর ফলে সাধারণ নাগরিকরা ঘি, ডালের মতো দৈনন্দিন ব্যবহারের পণ্যগুলোতে ৩০ শতাংশ ছাড় পাবে। পাশাপাশি দেশের ৬৩ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য চার হাজার ৭০০ কোটি রুপির বৃত্তি কর্মসূচি চালু করা হয়। প্রায় পুরো দেশে স্বাস্থ্য বীমা কার্ডের সংস্থান করার কাজ এগিয়ে যাচ্ছে।
ইমরান খানের উল্লেখযোগ্য সাফল্য হলো তার বিদেশনীতির উন্নতি। আফগানিস্তানের মতো আন্তর্জাতিক বিষয়ে পাকিস্তানের কঠোর অবস্থান একটি বড় অর্জন। মার্কিনিদের সামরিক ঘাঁটি দিতে অস্বীকার তুমুল প্রশংসা পেয়েছে। গত তিন বছরে অনেক দেশের সাথে তার কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নত হয়েছে।
বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্কের উন্নতির পাশাপাশি ইমরান খান বিভিন্ন সময়ে কাশ্মির ইস্যু আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিয়ে আসেন। ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে তার দৃঢ় দৃষ্টিভঙ্গি মুসলিম দেশগুলোতে সুনাম বাড়িয়েছে। আলজাজিরার সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান ‘সিবাক-উল-আখবার’ ইসলামোফোবিয়ার সমস্যা সমাধানে তার মতামত ও প্রচেষ্টায় তাকে ‘সেরা ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকে শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তান সম্পর্ক সৌহার্দ্যপূর্ণ। তামিল টাইগারের বিদ্রোহের তিন দশকের মধ্যে দুই দেশ কাছাকাছি এসেছিল কারণ পাকিস্তান শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীকে গোয়েন্দা, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের আকারে নিয়মিত সামরিক সহায়তা করেছিল। ১৯৮৫ সালে সার্ক গঠনের পর পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো জোরদার হয়। বর্তমানে পাকিস্তান ভারতের পর দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার।
জনাব খান এরই মধ্যে শ্রীলঙ্কায় অধিক পরিচিতি পেয়েছেন, বিদ্রোহের প্রজ্বলিত অগ্নিশিখার মধ্যে তিনি ক্রিকেট ম্যাচ খেলেছিলেন। সাম্প্রতিক সফরকালে তাকে দু’টি বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। প্রথমত, শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে তার ভাষণ বাতিল করা হয়। এরপর শ্রীলঙ্কার একদল মুসলিম সংসদ সদস্যের সাথে তার বৈঠক বাতিল করা হয়। সিপিইসি থেকে লাভবান হওয়ার জন্য শ্রীলঙ্কাকে দেয়া মিস্টার খানের প্রস্তাবও তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া পায়নি। আলোচনার মাধ্যমে ভারতের সাথে মতপার্থক্য নিরসনের প্রস্তুতিও ব্যক্ত করেন তিনি। এমনকি মোদির সাথে বিতর্ক করতেও প্রস্তাব দিয়েছিলেন। উপসাগরীয় সমস্যায় তিনি ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেছিলেন, জনাব খান আবারো আস্থা প্রকাশ করেছিলেন যে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে ভূমিকা রাখতে পারে। স্মরণ করা যেতে পারে, কেনেডির আমলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে পাকিস্তান এক টেবিলে নিয়ে আনতে সক্ষম হয়। হেনরি কিসিঞ্জারকে গোপনে পাকিস্তান থেকে চীনে সফরের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘেঁষা ভারত যখন যুক্তরাষ্ট্রের নামও নিত না, তখন ফার্স্ট লেডি জ্যাকুইলিন কেনেডি পাকিস্তানে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বেড়িয়েছেন। তাই ইমরানের যুক্তরাষ্ট্র-চীন মেরুকরণের প্রয়াস বিন্দুমাত্র অতিরঞ্জন নয়।
ইমরান খান প্রতিরক্ষা সম্পর্কের জন্য শ্রীলঙ্কাকে ৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মাদক পাচার, অস্ত্র চোরাচালান ও অন্যান্য অবৈধ কার্যক্রম বন্ধে বিদ্যমান ব্যবস্থা বজায় রেখে নিরাপত্তা খাতের সহযোগিতা বাড়াতে একটি চুক্তিও করেন। দুই দেশের জনগণকে আরো কাছাকাছি আনতে শ্রীলঙ্কায় খেলাধুলার প্রসারে ৫২ মিলিয়ন রুপি, ওষুধের জন্য ১০০টি এমবিবিএস বৃত্তি এবং পেরাডেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি এশিয়ান সভ্যতা ও সংস্কৃতি কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। এ ছাড়াও দুই দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং উৎকর্ষ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে খেলাধুলা, বিনিয়োগ ও সহযোগিতা সম্পর্কিত পাঁচটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করতে ফলো আপ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে আজ পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা উভয় দেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কটের অন্ধকার গহ্বরে পতিত হয়েছে। ইমরানের ওই সব প্রচেষ্টা ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরোধী ছিল। পাকিস্তানের আফগানিস্তান নীতিতেও যুক্তরাষ্ট্র বিরক্ত।
ইমরান খান মিসরভিত্তিক কোম্পানিগুলোকে তার দেশে বিনিয়োগ করাতেও সফল পদক্ষেপ নেন। মিসরীয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। নিয়োগকারী ও উদ্যোক্তাতাদের পাকিস্তানে লাভজনক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বিশেষ সুবিধা দেবেন বলে জানিয়েছেন। মিসরের এল সেয়েডি ইলেকট্রিক ৫০০ ডলার বিনিয়োগ করতে আগ্রহী; তারা জনাব খানের ব্যবসাবান্ধব নীতির প্রতি আস্থা প্রকাশ করে।
আমিরাত বেলুচিস্তানে ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে তেল শোধনাগার প্রকল্পে। সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রতিদিন ২৫০,০০০-৩০০,০০০ ব্যারেল উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে সর্বশেষ প্রযুক্তিচালিত এক শোধনাগারে বিনিয়োগের কাজ শুরু করেছে। আরব আমিরাতের মুবাদালা পেট্রোলিয়াম এরই মধ্যে প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন করেছে। প্রকল্পটি সংযুক্ত আরব আমিরাত-পাকিস্তান সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী করবে। একই সাথে আরো বিনিয়োগের পথ সৃষ্টি করবে। কুয়েত ইনভেস্টমেন্ট অথরিটিও পাকিস্তানজুড়ে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।
পাকিস্তানকে চীনের ‘আইরন ব্রাদার’ নামে ডাকা হয়। খান বিরোধীদের পেশ করা অনাস্থা ভোট আটকে দিতে সক্ষম হয়েছেন। প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরে খান এক ভাষণে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে তার সরকারকে উৎখাত করার ‘বিদেশী ষড়যন্ত্রের’ সাথে জড়িত ব্যক্তি হিসেবে একজন সিনিয়র মার্কিন কূটনীতিকের নামও উল্লেখ করেন। পশ্চিমাদের সরকার উৎখাত যেন এক রুটিন কাজ। কথা না শুনলেই তার দফারফা। বেনজির ভুট্টো তার ডটার অব ইস্ট বইতে লিখেছিলেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব যুক্তরাষ্ট্রের অনুকম্পার ওপর নির্ভরশীল! এ চিত্র আমরা দেখেছি ইরানে, আফগানিস্তানে, কম্বোডিয়ায় ও দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশে। হিলারি ক্লিনটন অহরহ বলতেন, ‘আসাদকে আর এক মুহূর্তও ক্ষমতায় দেখতে চাই না।’ কিন্তু সিরিয়ার আসাদ এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং রাশিয়ার পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন। ইরানের শাহের আমলে সিআইএ ও মোসাদের শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল তেহরান, আজ তারা বিতাড়িত। এখন চলছে অবরোধের স্রোত। ইমরান পশ্চিমাদের অনেক অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার বেলায়ও এসব নেমে এসেছে। এখন এরদোগান, ইমরান খান ও মাহাথির পশ্চিমাদের কড়া নজরে। মাহাথির নবতীপর ও দুর্বল। বাকি দু’জন এখন মঞ্চে রয়েছেন, সম্প্রতি ইমরানও পতিত হলেন।
পাকিস্তানে এখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কট শুরু হয়েছে। শেষটা তেমন ভালো নাও হতে পারে। পাকিস্তান যখনই কিছু অর্জন করা শুরু করে তখন রাজনৈতিক সঙ্কট সব তছনছ করে দেয়। তার ওপর রয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি ও প্রকল্প-অর্থ লুটমার করা। ইমরান খান দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন তাই দলে ও দলের বাইরে দুর্নীতিবাজ নেতারা তার বিরুদ্ধে এক হয়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতির জন্য গুরুতর রাজনৈতিক অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে আর্থিক ক্ষতি অন্তর্ভুক্ত, আর জনাব খান যেমন উল্লেখ করেছেন কিছু বাহ্যিক শক্তি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ এশীয় জাতির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে।
সাংহাই ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো ঝাও গানচেং বলেন, ওয়াশিংটন খানকে ফাঁসানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তাই এটি সম্ভব যে এখন পাকিস্তানের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে বর্তমান সরকারকে উৎখাত করা। রিসার্চ সেন্টার ফর চায়না-সাউথ এশিয়া কো-অপারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল লিউ জংয়িও বিশ্বাস করেন যে পশ্চিমারা এবং বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র খানকে ক্ষমতায় থাকতে দেখতে চায় না; কারণ তিনি তাদের প্রতি কঠোর হয়ে উঠেছেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, চীনের উত্থান এবং অন্যান্য দেশের সাথে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র সঙ্কট অনুভব করতে শুরু করেছে। চীন ও তার প্রতিবেশীদের মধ্যে সম্ভাব্য সব উপায়ে সম্পর্ককে বাধাগ্রস্ত করার সব প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। উদাহরণস্বরূপ চীন-প্রস্তাবিত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভকে প্রতিবেশী দেশগুলোতে ‘ঋণ ফাঁদ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কিছু আঞ্চলিক দেশ চীনের কাছ থেকে দূরে এবং নিজের দিকে ঝুঁকে পড়ার আশায় এটি ‘চীনের হুমকি’ নিয়েও খেলা চালিয়ে যাচ্ছে।
রাশিয়ার পাশের ইউক্রেনে যে গোলযোগ চলছে, সে রকম গোলযোগ চীনের আশপাশের দেশেও ঘটতে পারে চীনকে শায়েস্তার মানসে। সে ক্ষেত্রে পাকিস্তান চীনের বন্ধু হওয়ায় সে দেশে গোলযোগের ঘনঘটা আছড়ে পড়তে পারে। তবে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশে যুক্তরাষ্ট্রের ‘রঙিন বিপ্লব’ সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশ কম, যা ইরানেও সফল হয়নি।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার