শিফারুল শেখ
রাশিয়ার ট্যাংক হামলা এবং বন্দুকের বারুদ কেবল ইউক্রেনকেই উত্তপ্ত করছে না। বারুদের উত্তাপে গরম হয়ে উঠেছে কানও। ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উত্সবে ইউক্রেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ করেছেন এক নারী যা নজর কেড়েছে সারা বিশ্বের। ফ্রান্সের কানের মতোই মানুষের কানকেও সজাগ করে তুলেছে ইউক্রেন যুদ্ধ। বিশ্বের নীতি-নির্ধারকদের কান এখন শুনতে পাচ্ছে ভবিষ্যতে ভয়াবহ খাদ্যসংকটের কথা। ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘস্হায়ী হলে সেই সংকট দুর্ভিক্ষে রূপ নেবে বলেও আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। কারণ বিশ্বে খাদ্যশস্য, সার এবং তৈলবীজ উত্পাদনের অন্যতম প্রধান দুই দেশ রাশিয়া এবং ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়েছে।
দীর্ঘস্হায়ী হবে ইউক্রেন যুদ্ধ!
বিশ্বে অনেক যুদ্ধই হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ইরাক যুদ্ধ, আফগানিস্তান যুদ্ধ, সিরিয়া যুদ্ধসহ অনেক। এগুলো যখন শুরু হয় তখন মনে হয় সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু দিন যত যায় যুদ্ধ যেন ততই সামনের দিকে যায়। সময়ের মতো এর রাস্তাও যেন শেষ হয় না। ফলে এসব যুদ্ধের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং মানবিক সংকটেরও শেষ থাকে না।
রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়েও প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল, তিন থেকে চার দিনের মধ্যেই কিয়েভ দখলে নেবে মস্কো। এরপর সেটা সপ্তাহ এবং মাসের ধারণা করা হয়। কিন্তু প্রায় তিন মাস হতে চলল। যুদ্ধ বাড়ার লক্ষণ দেখা গেলেও কমার ইঙ্গিত নেই। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেছেন, কূটনীতির মাধ্যমেই যুদ্ধ শেষ হবে। কিন্তু প্রত্যক্ষ কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও খুব একটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বরং যেন রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কিংবা পশ্চিমা বিশ্বের মর্যাদা রক্ষার লড়াই শুরু হয়েছে। রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালাচ্ছে। তবে রাশিয়ার ওপর হামলা কিংবা ইউক্রেনে সরাসরি সৈন্য না পাঠালেও অস্ত্র থেকে শুরু করে সব ধরনের সহায়তা যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী মিডিয়া সিএনএন বলছে, ইউক্রেন যুদ্ধ এতটা দীর্ঘ হচ্ছে যে, পৃথিবীর কেউ এই ভয়াবহতা থেকে রেহাই পাবে না, সেটা আমেরিকার ছোট্ট শহর বা দারিদ্র্যপীড়িত আফ্রিকার প্রত্যন্ত এলাকা হোক। আর যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে, ঠিক তার চেয়েও বেশি গতিতে খাদ্য অনিরাপত্তা বাড়বে।
খাদ্যনিরাপত্তায় কতটা গুরুত্বপূর্ণ ইউক্রেন ও রাশিয়া
রাশিয়া প্রচুর পরিমাণে পটাশ এবং ফসফেট উত্পাদন করে। এ দুটি সারের মূল উপাদান যা উদ্ভিদ ও ফসলের উত্পাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। বিশ্বের অন্যতম বড় সার কোম্পানি ইয়ারার প্রধান ভেইন টোরে হোলসেথার গত মার্চেই বলেছিলেন, যুদ্ধ সারের দাম ব্যাপক বাড়িয়ে দেবে। ইয়ারা বিশ্বের ৬০টিরও বেশি দেশে কাজ করে এবং রাশিয়া থেকে প্রচুর প্রয়োজনীয় কাঁচামাল কিনে। রাশিয়ার ব্যাপক খনিজ ও জ্বালানি সম্পদ (তেল, গ্যাস ও কয়লা) একে বিশ্বের বৃহত্তম মজুতদার হিসেবে তৈরি করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গম রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া।
ইউক্রেনও কৃষিসম্পদে ভরপুর। একসময় ইউক্রেনকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘রুটির ঝুড়ি’ বলা হতো। ইউক্রেনে রয়েছে চার কোটি ২০ লাখ হেক্টর কৃষিজমি, যেটা পুরো ইউরোপের ২২ ভাগ। গম, ভুট্টা, সূর্যমুখীর তেল, যব ইত্যাদি কৃষিপণ্যে রপ্তানির অন্যতম প্রধান ইউক্রেন। আন্তর্জাতিক শস্য কাউন্সিলের তথ্য মতে, ২০২০-২১ সালে বিশ্বে চতুর্থ বৃহত্তম ভুট্টা রপ্তানিকারক দেশ ইউক্রেন। এছাড়া গম রপ্তানিতে দেশটি ষষ্ঠ।
কতটা ভোগাবে বিশ্বকে
খাদ্যসংকটের মুখে পড়তে চলেছে বিশ্ব। তার অন্যতম কারণ মস্কো-কিয়েভ লড়াই। ২০২০ সাল থেকে করোনা মহামারির প্রকোপে বিশ্ব জুড়ে বহু মানুষ কাজ হারিয়েছে। পাশাপাশি কমেছে চাষাবাদ থেকে বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে উত্পাদনও। জলবায়ু পরিবর্তন এবং একাধিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে চাষাবাদ মার খেয়েছে। তাই সারা বিশ্ব ইতিমধ্যেই খাদ্যসংকটের সীমানায়। কোভিড পরিস্হিতির সামান্য উন্নতির কারণে বিশ্ব সবেমাত্র ঘুরে দাঁড়ানোর পরপরই চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি কিয়েভের ওপর আঘাত হানে মস্কো। এই সংঘাত পৃথিবীতে খাদ্যসংকটের সম্ভাবনা আরো এক ধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও খাদ্যসংকটের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া একে অপরকে দোষারোপ করছে। রাশিয়ার হামলার কারণে ইউক্রেনের বন্দরগুলো দিয়ে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ এসব বন্দর দিয়ে বিপুলপরিমাণ সূর্যমুখী তেল, গম ও ভুট্টা রপ্তানি হতো।
ইন্টারন্যাশনাল গ্রেইন কাউন্সিল (আইজিসি) জানিয়েছে, চলতি বছরে খাদ্যশস্যের বৈশ্বিক উত্পাদন গত মাসে দেওয়া পূর্বাভাসের তুলনায় ১ শতাংশ কমতে পারে। সংস্হাটি জানায়, চলতি বছর খাদ্যশস্যের বৈশ্বিক উত্পাদন ২২৫ কোটি ১০ লাখ টনে পৌঁছার সম্ভাবনা রয়েছে। মৌসুম শেষে খাদ্যশস্যের মজুত কমে ৫৭ কোটি ৯৬ লাখ টনে নামতে পারে। গত মাসে দেওয়া পূর্বাভাসের তুলনায় মজুত দশমিক ২৬ শতাংশ কমবে।
বিশ্লেষকরা জানান, খাদ্যশস্য উত্পাদন কমে যাওয়ার পেছনে প্রধান ভূমিকা রাখছে গম ও ভুট্টা। শস্য দুটির উত্পাদন কমছে আশঙ্কাজনক হারে। গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর থেকেই দেশটির গম উত্পাদন ও রপ্তানিতে মন্দা দেখা দেয়। রুশ সামরিক বাহিনীর হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইউক্রেনের বিভিন্ন আবাদি অঞ্চল। ধ্বংস হয়ে গেছে কৃষি যন্ত্রপাতি। বিশেষ করে ২০২১-২২ মৌসুমে ইউক্রেনে উত্পাদন হয়েছিল ৩ কোটি ৩০ লাখ টন গম। চলতি মৌসুমে তা কমে ১ কোটি ৯৪ লাখ টনে নামতে পারে।
রাশিয়ার হামলার পর কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলোয় জাহাজ চলাচল করতে পারছে না, ফলে থমকে গেছে এসব বাণিজ্য। সে কারণে গম ও তেলবীজের দাম রেকর্ড মাত্রায় পৌঁছে যাচ্ছে। ইউক্রেনই হলো ইউরোপীয় ইউনিয়নে চতুর্থ বৃহত্ খাদ্য সরবরাহকারী। দেশটিকে ইউরোপের ‘সবজি বাগান’ বলা হয়ে থাকে। ইইউ নিজস্ব ভুট্টা আমদানির অর্ধেক, গমের এক-পঞ্চমাংশ এবং ভেজিটেবল অয়েল আমদানির এক-চতুর্থাংশ ইউক্রেন থেকে করে। আবার ইউরোপের কৃষকরা উচ্চ ফলন ধরে রাখতে চাইলে সারের জন্য তাদের বাড়তি মূল্য দিতেই হবে। কারণ ইইউ তার চাহিদার ৩০ শতাংশ সার রাশিয়া থেকে আমদানি করে। মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞার পর সারের দামে উচ্চগতি লক্ষ্য করা গেছে। মার্চেই বাড়ে ১৪২ শতাংশ।
খাদ্যের জন্য ইউক্রেন ও রাশিয়ার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল মিশর, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কো, লেবানন ও তুরস্ক। গ্যালপ রিসার্চের তথ্যমতে, আলজেরিয়ার ৪৮ শতাংশ গম আমদানির উত্স ইউক্রেন। আসলে যুদ্ধরত দুই দেশ দানাদার শস্য উত্পাদনের বিশ্বশক্তি। যৌথভাবে বিশ্বের মোট গম রপ্তানির ২৯ শতাংশ তাদেরই অবদান। আর ময়দা, আটা থেকে প্রস্ত্তত করা রুটিই অনেক দরিদ্র দেশের প্রধান খাদ্য। সারা বিশ্বে প্রায় ১২ শতাংশ খাদ্য সরবরাহ করে দুই দেশ। বছরের শুরুতেই গমের দাম আগের তুলনায় ৫৩ শতাংশ বেড়েছে। তাপপ্রবাহের কারণে ভারত থেকে গমের রপ্তানি বন্ধ হওয়ার কারণে গত ১৬ মের পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আরো ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে গমের দাম।
ইতোমধ্যেই ২০২২ সালকে ‘সর্বনাশা এক ক্ষুধার বছর’ বলে অ্যাখ্যা দিয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বা ডব্লিউএফপি। এই সংস্হাটি তার সরবরাহের অর্ধেকের বেশিই সংগ্রহ করে ইউক্রেন থেকে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম দুই সপ্তাহেই দানাদার শস্যের দাম গড়ে ৫০ শতাংশ বাড়ে বলে জানিয়েছিলেন জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি-অর্থনীতির অধ্যাপক মতিন কায়িম। খাদ্যসংকট রাজনৈতিক গোলযোগের সূচনা হয় এবং সেটা হবে বলে আশঙ্কা আছে। ইতিহাস বলে আরব বসন্তের সময়ও খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি মূল অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা রেখেছিল। কায়িমের মতে, ইতিমধ্যে সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রায় এক দশক পর রক্ষণশীল দলের পরাজয় ঘটেছে। এক্ষেত্রে জলবায়ু এবং খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিই ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
জাতিসংঘের হিসেবে গত বছরের তুলনায় এ বছর খাদ্যপণ্যের দাম ইতিমধ্যেই সারা বিশ্বে অন্তত ৩০ শতাংশ বেড়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মূল্য বৃদ্ধি পাওয়াতে দরিদ্র দেশগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গেছে। তার আশঙ্কা, শেষ পর্যন্ত ইউক্রেন থেকে রপ্তানি স্বাভাবিক না হলে বিশ্ব দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হতে পারে।
প্রসঙ্গত, রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্বের যত গম উত্পন্ন হয় তার ৩০ ভাগ উত্পাদন করে। যুদ্ধের আগে ইউক্রেন ৪৫ মিলিয়ন টন খাদ্য শস্য প্রতি মাসে রপ্তানি করত। কিন্তু রাশিয়ার আগ্রাসনের পর সব রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে এবং জাতিসংঘের হিসেবে ২০ মিলিয়ন টন ভুট্টা এখনো সেখানে আটকা পড়ে আছে। বিশ্বে ইতিমধ্যেই ৪৪ কোটি থেকে ১৬০ কোটি মানুষ দুই বেলা দুই মুঠো খাবারের জন্য হাহাকার করছেন বলেও উঠে এসেছে সমীক্ষায়। আরও প্রায় ২৫ কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষের সীমারেখায় দাঁড়িয়ে আছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে দ্য ইকনোমি।