আয়নাঘরে অকথ্য নির্যাতনের ভয়াবহ তথ্য দিলেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম আয়নাঘরে অকথ্য নির্যাতনের ভয়াবহ তথ্য দিয়েছেন। সম্প্রতি এক বক্তব্যে তিনি জানান, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এমন নির্যাতন সেলের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যেখানে বন্দিদের অকথ্য নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।

ভিডিও: https://youtu.be/E72NkMtADOw?si=WJXZm1ZFZqvEsdIL

চিফ প্রসিকিউটর উল্লেখ করেন, ঢাকার একটি নির্দিষ্ট টিএফআই সেলে একজন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ব্যারিস্টারকে টানা সাড়ে আট বছর বন্দি রাখা হয়েছিল। একটি ছোট, বাতাসহীন, আলোবিহীন কক্ষে তাকে দিনের বেলা সামনে হাতকড়া পরিয়ে ও রাতের বেলা পেছনে হাতকড়া দিয়ে শৃঙ্খলিত রাখা হতো। পরে শুধুমাত্র তাকে নজরদারি করার জন্য একটি ছোট্ট ছিদ্রের মাধ্যমে আলোর ব্যবস্থা করা হয়।

তাজুল ইসলাম আরও জানান, ওই বন্দি দীর্ঘদিন শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাকে সেই কক্ষেই অস্ত্রোপচার করানো হয়। পাশের কক্ষগুলোতে ছিল টর্চার সেল, যেখানে বন্দিদের ওপর অমানবিক অত্যাচার চালানো হতো। তাদের পা ও হাত বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হতো, যৌনাঙ্গে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হতো এবং দেওয়ালে বিভৎস ছবি টানিয়ে দেখানো হতো, যাতে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে।

তিনি আরও জানান, এক বন্দিকে এতটাই নির্যাতন করা হয়েছিল যে তার শরীর পচে দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করে। ওই দুর্গন্ধ আড়াল করতে বারবার এয়ার ফ্রেশনার ব্যবহার করা হতো। পরবর্তীতে সেই বন্দি মারা যান। পাশের সেলের বন্দিদের দিয়ে মৃতদেহের ওপর হাঁটিয়ে বলা হতো, ‘তোর অবস্থাও এমনই হবে, যা বলছি তা কর।’

এই ভয়াবহ নির্যাতনকেন্দ্রের বাস্তবতা উপলব্ধি করানোর জন্য চিফ প্রসিকিউটর ব্রিটিশ গণমাধ্যম স্কাই নিউজের এক সাংবাদিককে সেই নির্জন কক্ষে প্রবেশ করান। সাংবাদিক মাত্র এক মিনিটের মাথায় দম বন্ধ হয়ে বেরিয়ে এসে জানান, সেখানে থাকা ‘অভাবনীয়’ এবং ‘অসম্ভব’!

চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশকে এক পৈশাচিক নির্যাতনকেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছিল। বাংলাদেশকে আর কখনো সেই নৃশংস অতীতে ফিরতে দেওয়া যাবে না। জাতির শহীদ সন্তানদের আত্মত্যাগের সঙ্গে বেইমানি না করেই বাংলাদেশকে একটি নিরাপদ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিতে হবে, যেখানে মেধাবীরা দেশ ছেড়ে বিদেশে যেতে বাধ্য হবে না বরং তারা নিজ দেশেই যোগ্যতার মূল্যায়ন পাবে।

এদিকে আয়নাঘর নিয়ে স্কাই নিউজের বিশেষ এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বিগত দেড় দশক স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ কতোটা ভয়াবহতার মধ্যে ছিলে এই প্রতিবেদন উঠে এসেছে তারই খণ্ডচিত্র।

সাংবাদিক কর্ডেলিয়া লিঞ্চের করা প্রতিবেদনে শুরুতেই দেখানো হয়, কীভাবে রাষ্ট্রীয় মদদে মানুষ হত্যা করে লাশগুলো ডুবিয়ে দেয়া হতো বুড়িগঙ্গাসহ বিভিন্ন নদীতে। এই লাশ যাতে ভেসে না ওঠে, সে জন্য মরদেহের সাথে বেঁধে দেয়া হতো সিমেন্টের ব্যাগ। ফলে নিহতদের পরিবার বা আত্মীয়স্বজন তার সন্ধান কখনো পায়নি। অনেক ক্ষেত্রেই লাশের পেট চিরে ভিতরে সিমেন্ট বা ইট ঢুকিয়ে সেগুলোকে ডুবিয়ে দেয়া হতো।

প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়, সরকারের নির্দেশনায় এসব হত্যাকাণ্ড সংঘঠিত হওয়ার বেশকিছু তথ্য মিলেছে। ভারতে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি মানুষ গুম করার নির্দেশ দিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। গুম করা এইসব মানুষকে আটকে রাখা হতো আয়নাঘর নামে দেশব্যাপী বিস্তৃত শত শত বন্দিশালায়। বছরের পর বছর আটকে রেখে নির্যাতন করা হতো। কাউকে কাউকে রাখা হতো চোখ বেঁধে। কারো-বা জায়গা হতো অপ্রশস্ত জানালাবিহীন অন্ধকার কুঠুরিতে।

আয়নাঘরেরই একটি কক্ষে ছিল বন্দিদের নির্যাতনের জন্য বিদ্যুৎচালিত ভয়াবহ স্পিনিং চেয়ার। বন্দিদের সেই চেয়ারে বসিয়ে অত্যধিক দ্রুত গতিতে ঘোরানো হতো। কাউকে ঝুলিয়ে রাখা হতো সিলিং থেকে, বা পরিয়ে রাখা হতো শেকল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *