ছবি দুটো আমার স্কুলের। একটি আমার সময়ের প্রধান শিক্ষকের। স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯১৯ সালে। ওই বছরই অবসান ঘটেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের। বিশ্ব শান্তির স্মারক হিসেবে শেরপুরের জমিদার গোবিন্দ কুমার চৌধুরী স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। স্কুলের প্রতিষ্ঠাকালীন নাম ছিল “গোবিন্দ কুমার পিস মেমোরিয়াল ইন্সটিটিউশন” সংক্ষেপে “জিকেপিএম ইন্সটিটিউশন” আমরা এবং এলাকার লোকজন আরও সংক্ষিপ্ত আকারে বলতাম “জিকে স্কুল।” স্কুলটির বয়স ১০৩ বছর পেরিয়ে গেছে। শেরপুর এলাকায় শিক্ষা বিস্তারে জিকে স্কুলের অবদান অসামান্য। জিকে স্কুলের চির প্রতিদ্বন্দ্বী শেরপুরের আরেকটি স্কুল “ভিক্টোরিয়া একাডেমি”। জিকে স্কুল প্রতিষ্ঠার ৩২ বছর আগে ১৮৮৭ সালে ইংল্যাণ্ডের রানি ভিক্টোরিয়ার সিংহাসনে আসীন হওয়ার ২৫তম বার্ষিকী উপলক্ষে ভিক্টোরিয়া একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন এলাকার আরেক জমিদার রায় বাহাদুর চারু চন্দ্র চৌধুরী। দুটি স্কুলের নাম থেকেই স্পষ্ট যে জমিদারদের অনেক কাজের মধ্যে অন্যতম কাজ ছিল ব্রিটিশ রাজকে তুষ্ট করা। কিন্তু শিক্ষা বিস্তারে দুটি স্কুলের অবদান অস্বীকার করার মতো নয়।
জিকে স্কুলের দৃষ্টিনন্দন মূল ভবন শেরপুর এলাকায় স্থাপত্যকলার অন্যতম নিদর্শন। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। উত্তর দক্ষিণে লম্বিত ভবনের সামনে পূর্ব পাশে পুকুর, পেছনে পশ্চিম পাশে মাঠ। আমাদের সময়ে মাঠ ছাড়িয়ে ছিল ফসলের সবুজ ক্ষেতের বিস্তার। পাকিস্তান আমলে পুকুরের দুই পাশে আরও ভবন যুক্ত হয়েছে। পুকুরের উত্তর পাশে বিজ্ঞান ভবন ও জিমনেসিয়াম, দক্ষিণ পাশে স্কুলের হোস্টেল। পুকুর ছাড়িয়ে পূর্ব দিকের স্কুল সীমানা প্রচীরের পর শেরপুর-জামালপুর সড়ক এবং এর পাশে শেরপুর পৌর পার্ক, খেলার মাঠ, ঈদগাহ, পাবলিক লাইব্রেবী, টেনিস কোর্ট ও অফিসার্স ক্লাব।
আমি জিকে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম ক্লাস ফোরে, আজ থেকে ঠিক ৬০ বছর আগে ১৯৬২ সালে। একই সাথে আমার বড় ভাই ভর্তি হন ক্লাস সিক্সে। আমি এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি ১৯৬৯ সালে। ওই বছর হিসেবে নিলে জিকে স্কুলে আমার স্মৃতিময় আট বছর কেটেছে। পরবর্তীতে আমার ছোট দুই ভাইও জিকে স্কুলেই পড়াশোনা করেছে। ওই সময় আমাদের স্কুলে সহশিক্ষা ছিল না। তা সত্ত্বেও আমাদের আরবি ও ধর্ম শিক্ষক, যিনি ‘মৌলভি স্যার’ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন, সেকান্দর আলী স্যারের মেয়ে এবং তখনকার শেরপুরের সবচেয়ে বড় প্রশাসনিক কর্মকর্তা ‘সিও’ (সার্কেল অফিসার) সাহেবের মেয়ে আমার সহপাঠি ইকবালের বোন ফিরোজা জিকে স্কুলের ছাত্রী ছিল। স্কুলে হেডমাষ্টার হিসেবে আমরা পেয়েছিলাম রোহিনী কান্ত হোড়কে। তাঁর মতো ডাকসাইটে প্রধান শিক্ষক ওই তল্লাটে আর ছিল না। হয়তো হবেও না।
জিকে স্কুলের সকল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল ভিক্টোরিয়া একাডেমির সঙ্গে। কোন্ স্কুলে বৃত্তি পরীক্ষায় ক’জন বৃত্তি লাভ করলো এসএসসি পরীক্ষার ক’জন ফার্স্ট ডিভিশন পেল এবং বিশেষ করে ইন্টার স্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতায় কোন্ স্কুল জয়ী হলো – এসবই ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখ্য বিষয়। যেদিন জিকে ও ভিক্টোরিয়ার মধ্যে ফুটবল খেলা হতো সেদিন ওই সময়ের থানা শহর শেরপুরের মানুষ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়তো। এখন শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু স্কুলের কিশোরদের ফুটবল খেলা দেখার জন্য শহরের দোকানপাট, বাজার বন্ধ হয়ে যেত। মাঠ উপচে পড়তো দর্শকে। তখন বিশ্বকাপ ফুটবল বা অলিম্পক হকি দেখার সুযোগ ছিল না, কারণ ১৯৭০ সালের আগে শেরপুরে কারও টেলিভিশন ছিল না। কিন্তু আমাদের স্কুল জিতলে মনে হতো আমরা দুনিয়ার সেরা খেলায় জয়লাভ করেছি। হেরে গেলে আমরা হতাশ হতাম, লুকিয়ে কাঁদতাম। খেলায় জিকে স্কুল বরাবর ভিক্টোরিয়ার চেয়ে ভালো ছিল এবং আমাদের সময়ে একবার শেরপুর থানা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে, জামালপুর মহকুমা পর্যায়ে জিতে ময়মনসিংহ জেলায় খেলতে গিয়েছিল জিকে স্কুল। দর্শক ও উৎসাহ দানকারী হিসেবে স্কুলের প্রতিটি খেলা দেখতে গেছি।দুই স্কুলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এতটা প্রবল থাকা সত্ত্বেও আমরা ভিক্টোরিয়া একাডেমির প্রতিটি শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলাম। আমাদের হেডস্যারকে দূর থেকে দেখতে পেলে যেমন গলিঘুপচিতে লুকিয়ে পড়তাম, ভিক্টোরিয়ার প্রধান শিক্ষক সাবেদ আলী স্যারকে দেখলেও একইভাবে আড়াল হতাম। ওই স্কুলের অন্যান্য শিক্ষক, যিনিই হোন না কেন, যেখানেই দেখা হোক না কেন, দাঁড়িয়ে পড়ে মাথা নিচু করে হিন্দু হলে ‘আদাব,’ মুসলিম হলে ‘সালাম’ দিতাম। তিনি চলে না যাওয়া পর্যন্ত আমরা স্থান অতিক্রম না। একবার শেরপুরের তিন স্কুলের তিনজন Ñ ভিক্টোরিয়া একাডেমির ছানা ভাই, শেরপুর হাইস্কুলের জয়নুল ভাই এবং জিকে স্কুলের আমি ঢাকা থেকে ট্রেনে বাড়ি যাচ্ছিলাম। তিন জন পাশাপাশি বসেছি। আমি ছাড়া দু’জনই কোট টাই পরা। হঠাৎ কম্পার্টমেন্টে মৌলভি স্যার ওঠলেন। আমরা বহু আগে যার যার স্কুল ছেড়েছি। মৌলভি স্যারও বহু আগে অবসর নিয়েছেন। বয়সের ভারে অনেকটাই ন্যুব্জ। এগিয়ে আসতেই আমরা তড়াক করে ওঠে দাঁড়িয়ে বিনয়ের সঙ্গে সালাম দিলাম। তার হাতের ব্যাগ নিয়ে নিলাম। আশাপাশের যাত্রীরা অবাক হলো যে এই হুজুর টাইপের একজন বৃদ্ধের প্রতি আমাদের এই শ্রদ্ধা কেন। শিক্ষকের প্রতি এতটাই আমরা দুর্বল ছিলাম।
জিকে স্কুল একটি প্রতিদ্বন্বিতায় ভিক্টোরিয়ার কাছে হেরে যায়, সেটি ছিল স্কুলের সরকারিকরণ। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময় ভিক্টোরিয়া স্কুল সরকারিকরণ হয়। জিকে স্কুলের প্রশাসন ও শিক্ষকরা অনেক চেষ্টা করেও এই উদ্যোগে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে স্কুলটি সম্ভবত ভালো সরকারি অনুদান লাভ করেছে এবং স্কুলের আদি নাম পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান নাম হয়েছে, “গোবিন্দ কুমার পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়।” ভিক্টোরিয়া স্কুলের নাম হয়েছে “শেরপুর গভর্নমেন্ট ভিক্টোরিয়া একাডেমি।” জিকে স্কুলে এখন সহশিক্ষা চালু হয়েছে। জানি না এখন আমার স্কুলের ফলাফল কেমন বা খেলাধূলায় কেমন করছে।