সৃষ্টিরহস্য অপার। অসীম। অনন্ত। অনতিক্রম্য বা অভেদ্য। মানুষের ক্ষুদ্র ও সীমিত জ্ঞানে তার খুব সামান্যই ধারণ করা সম্ভব। মানুষের দেহ মাত্র সাড়ে তিনহাত হলেও এতে কতো রহস্য আর অলৌকিকতা লুকোনো আছে তার কোনও শেষ নেই। মানুষকে এতো বুদ্ধিমান প্রাণি বলা হলেও আয়না ব্যতীত নিজের মাথার পেছনটাই দেখতে পায় না। ঘুমিয়ে গেলে কতো কিছু স্বপ্নে দেখে তার কি কোনও মাথামুণ্ড আছে? হাসে। কাঁদে। খেলে। যুদ্ধ করে। আবার প্রেমভালোবাসাতেও জড়ায়। ঘুম ভেঙে গেলে সবই ফাঁকা। তাই না? এরও কারণ আছে। ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। কিছু বোঝা যায়। কিছু যায় না। জন্মের আগে মায়ের পেটে কীভাবে ছিল মানুষ কিছুই বলতে পারে না। কতোদিন বাঁঁচবে তা জানে না। মরবে কখন এবং কোথায় তাও বলতে পারে না। এতোসব বাদ দিন। কখন ঘুমিয়ে পড়ে মানুষ? তা কি টের পায়? পায় না। ঘুম ভাঙলে বুঝতে পারে ঘুমিয়ে পড়েছিল। মানুষের ক্ষমতা এমনই সীমিত এবং নগণ্য।
বলা বাহুল্য, মানুষের আঙ্গুলের ছাপে সীমাহীন তথ্য লুকানো আছে। এতে জীবন-মৃত্যুসহ অনেক কিছুই লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। আঙ্গুলের ছাপ এবং হস্তরেখার সবরহস্য উন্মোচন হলে মানবজীবনের অনেক কিছু বুঝতে সহজ হবে। এমনকি চিকিৎসাসহ মানুষের জীবনযাপনও পাল্টে যেতে পারে। আঙ্গুলের ছাপ দেখে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণও হতে পারে বিজ্ঞানভিত্তিক এবং সহজতর।
বিজ্ঞানীরা আঙ্গুলের ছাপ ও হস্তরেখার রহস্য উন্মোচনে গবেষণা অব্যাহত রেখেছেন। কিছু উন্মোচিত হয়েছেও। তবে তা যৎসামান্য। সত্য বলতে কী, ষোড়শ শতকে বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত ফিঙ্গারপ্রিন্টের রহস্য নিয়ে আজও গবেষণা থেমে নেই।
১৬৮৪ সালে সর্বপ্রথম ইংলিশ ফিজিসিয়ান, উদ্ভিদবিজ্ঞানী এবং অনুবিক্ষণ যন্ত্রবিদ নিহোমিয়া গ্রিউ (১৬৪৭-১৭১২) বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকীতে হাতের তালু ও আঙ্গুলের ছাপরহস্যের সংযোগসূত্রের ধারণা উত্থাপন করেন। অতঃপর ১৬৮৫ সালে ডাচ ফিজিসিয়ান গোভার্ড বিডলো (১৬৪৯-১৭১৩) এবং ইটালিয়ান বিজ্ঞানী মারসিলো বিডলো (১৬২৮-১৬৯৪) এনাটমির ওপর বই প্রকাশ করে ফিঙ্গারপ্রিন্টের ইউনিক গঠনের আলোচনা উত্থাপন করেন। ১৬৮৪ সালের আগে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সম্পর্কে আর কোনও বিজ্ঞানীর আলোকপাতের কথা পাওয়া যায় না। এরপর দীর্ঘদিন অতিবাহিত হয়। ১৮০০ সালের পর ফিঙ্গারপ্রিন্ট আবারও জোরালোভাবে বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিজ্ঞানীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: ১৮৭৫ সালে জেন জিন্সেন, খুলনার সৈয়দ মুহাম্মাদ কাজী আজিজুল হক। ব্রিটিশ কর্মকর্তা এওয়ার্ড হেনরি। এ হেনরি আজিজুল হকের আবিষ্কার চুরি করেছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে।
পবিত্র কুরআনে আজ থেকে ১৪০০ বছর পূর্বে এবং ১৬০০ সালের প্রায় এক হাজার বছর আগে ফিঙ্গারপ্রিন্টের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, “মানুষ কি মনে করে যে আমি তার হাড়হাড্ডিসমূহ একত্রিত করতে পারবো না? বরং আমি তার আঙ্গুলের ডগা পর্যন্ত সঠিকভাবে সন্নিবেশিত করতে সক্ষম।”—-আল কিয়ামাহ : আয়াত ৩-৪।
উল্লেখ্য, পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষের আঙ্গুলের ছাপ সম্পূর্ণ ভিন্ন। পৃথিবীর সৃষ্টির প্রথম মানুষ থেকে শুরু করে শেষ মানুষ পর্যন্ত কোনও দুইজনের আঙ্গুলের ছাপ একই রকম হবে না। আঙ্গুলের ছাপের রেখার গঠন হয় মাতৃগর্ভের প্রথম তিন মাসে। আধুনিক বৈজ্ঞানিক ধারণা অনুযায়ী এ আঙ্গুলের ছাপেই মানুষের সকল বৈশিষ্ট্য লিপিবদ্ধ করা থাকে। আঙ্গুলের ছাপকে জিনের সংরক্ষিত তথ্যের মনিটর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। জিনের বিকল্প কাজ শুধু এ আঙ্গুলের ছাপ দিয়েই করা সম্ভব।
বর্তমান কালে ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হলো আঙ্গুলের ছাপ। এ ছাড়া ব্যাংক ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সিকিউরিটিসহ স্মার্টফোনের সুরক্ষার জন্য আঙ্গুলের ছাপ বা ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে। এ রহস্যময় আঙ্গুলের ছাপের গঠনশৈলীর সক্রিয়তার ইঙ্গিত আল্লাহ কুরআনে দিয়েছেন। কাফেররা যখন পুনরুত্থানের বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করে হাসাহাসি করতো। —বনী ইসরাইল : আয়াত ৪৯।
“তারা বলে: যখন আমরা অস্থিতে পরিণত ও চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবো, তখনও কি নতুন করে সৃষ্টি হয়ে উত্থিত হবো?”—- বনী ইসরাইল : আয়াত ৯৮।
“এটাই তাদের শাস্তি। কারণ, তারা আমার নিদর্শনসমূহ অস্বীকার করেছে এবং বলেছে : আমরা যখন অস্থিতে পরিণত ও চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে যাবো, তখনও কি আমরা নতুনভাবে সৃষ্টি হয়ে উত্থিত হবো?”একই কথা বলা হয়েছে সুরা আল মুমিনুনের ৮২ নং আয়াতেও। আরও বলা হয়েছে, “সে আমার সম্পর্কে এক অদ্ভূত কথা বর্ণনা করে, অথচ সে নিজের সৃষ্টি ভুলে যায়। সে বলে, কে জীবিত করবে অস্থিসমূহকে যখন সেগুলো পচেগলে যাবে?” —ইয়াসিন : ৭৮।
আল্লাহ যখন কুরআনে বারবার বিচারদিবস ও পুনরুত্থানের কথা বলেছেন তখন কাফেররা এ বলে হাসাহাসি করতো যে, পচাগলা হাড়গুলো কীভাবে একত্রিত করা হবে? একজনের অস্থির সঙ্গে অন্যজনের অস্থি বদল হবে না? আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন প্রত্যুত্তরে বলেছেন,“মানুষ কি মনে করে যে আমি তার অস্থিসমূহ একত্রিত করতে পারবো না? বরং আমি তার অঙ্গুলগুলোর ডগা পর্যন্ত সঠিকভাবে সন্নিবেশিত করতে সক্ষম।” —আল কিয়ামাহ : ৩-৪।
এখানে ফিঙ্গারপ্রিন্টের সক্রিয়তার ইঙ্গিত দিয়েছেন। আল্লাহ শুধু মানুষের অস্থিতে গোশত পরিয়েই উত্থিত করাবেন না বরং এমন নিখুঁতভাবে মানুষকে জীবিত করাবেন যেন জীবদ্দশায় তার আঙ্গুলের সুক্ষ্ণরেখা পর্যন্ত সুবিন্যস্ত করবেন। এখানে কাফেরদের অভিযোগেরও উত্তর দেয়া হয়েছে। কাফেররা বলে গলাপচা অস্থি বা একজনের হাড়ের সঙ্গে অন্য জনের হাড় মিশ্রিত হবে না? ফিঙ্গারপ্রিন্টকে ডাটাব্যাংক বলা হয়। জিনের মধ্য সন্নিবেশিত শুধু শারীরিক বৈশিষ্ট্যই নয়, প্রায় সকল বৈশিষ্ট্য এমনকি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পর্যন্ত আঙ্গুলের ছাপে সুবিন্যস্ত করা থাকে। তাই আল্লাহ এখানে কাফেরদের জবাব প্রদান এবং জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করেছেন যে, শুধুমাত্র আঙ্গুলের ডগার প্রিন্ট দিয়ে যদি একটি মানুষের সমুদয় বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা সম্ভব হয়, তাহলে প্রত্যেক মানুষকে তার নিজের অস্থি থেকে পুনর্বিন্যস্থ করা যাবে না কেন?
জিহ্বা দেখে যেমন মানুষের অনেক রোগনির্ণয় করা যায়, তেমনই চোখ দেখেও অনেকের চরিত্র বিশ্লেষণ করা সম্ভব। এ ছাড়া বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বলে একটা কথা আছে। অনেকের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বা দেহভঙ্গিও ভেতরের অনেক কিছু প্রকাশ করে দেয়।
যাই হোক, বলছিলাম ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে কথা। যেমন ‘বিন্দুতে সিন্ধু থাকে’ বলা হয় না? ওইরকম ফিঙ্গারপ্রিণ্টেও মানুষের পুরো আমলনামা লিপিবদ্ধ থাকে। বলতে পারেন, আঙ্গুলের ছাপ বা ফিঙ্গারপ্রিন্ট হচ্ছে মাইক্রোচিপস। এতে মানবজীবনের সবকিছু রেকর্ড হয়ে থাকছে। কালকিয়ামতে হাত-পা, আঙ্গুল ইত্যাদি কথা বলবে মানে কী? এর মানে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সবকিছু বলে দেবে। পৃথিবীতে মানুষের দ্বারা যাকিছু সংঘটিত হয়েছে তার ফুলরেকর্ড রয়েছে এতে। অস্বীকার করবার কোনও উপায় নেই। অর্থাৎ ফিঙ্গারপ্রিন্ট হচ্ছে মানুষের ইহজাগতিক ও পারলৌকিক কর্মকাণ্ডের মাইক্রোচিপস বা আমলনামা। এতে সবকিছু রেকর্ড হয়ে থাকবে।
পৃথিবীর সর্বত্র মানুষকে সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করতে এখন আঙ্গুলের ছাপ গুরুত্ব পাচ্ছে। আমাদের দেশেও জাতীয় পরিচয়পত্রে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এছাড়া অন্যকোনও শনাক্তকরণ পদ্ধতির আর তেমন গুরুত্ব নেই। মানুষের চেহারা, কর্ম, কণ্ঠস্বর, রক্তের গ্রুপসহ একজনের সঙ্গে অন্যজনের অনেক কিছুর প্রায় হুবহু মিল থাকতে পারে। কিন্তু আঙ্গুলের ছাপ বা ফিঙ্গারপ্রিন্ট কারুরটা অন্য কারুর সঙ্গে মিলবে না। এটাও মহান আল্লাহর একটা মোজেজা বা আল্টিমেট মিরাকল। এরপরও মানুষ মহান আল্লাহকে চিনতে ভুল করে। এমনকি সৃষ্টিতেই প্রভুত্ব আরোপ করে বসে।
ইনসেট
——
পৃথিবীর সর্বত্র এখন মানুষকে শনাক্ত করতে আঙ্গুলের ছাপ বা ফিঙ্গারপ্রিন্ট গুরুত্ব পাচ্ছে। চেহারা, কর্ম, কণ্ঠস্বর, রক্তের গ্রুপ একজনের সঙ্গে আরেক জনের প্রায় হুবহু মিল থাকতে পারে। কিন্তু আঙ্গুলের ছাপের মিল হবে না। এটাও আল্লাহর মোজেজা বা আল্টিমেট মিরাকল। এরপরও মানুষ আল্লাহকে চিনতে ভুল করে। এমনকি সৃষ্টিতেই প্রভুত্ব আরোপ করে বসে।