লন্ডন বাংলা বইমেলা ও সাহিত্য-সংস্কৃতি উৎসব

যুক্তরাজ্য শিল্প-সংস্কৃতি
শেয়ার করুন

সালমা বেগম

১৫তম লন্ডন বাংলা বইমেলা ও সাহিত্য-সংস্কৃতি উৎসবের উদ্বোধনী অধিবেশনই ছিল বেশ সরব ও প্রাণবন্ত। এটি ছিল বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বাংলা একাডেমীর সহযোগিতায় টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের এবং উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর বিশেষ প্রয়াস। ৯ ও ১০ নভেম্বর দু’দিনব্যাপী লন্ডনের বুকে আয়োজিত এই উৎসব বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে উদযাপনের এক অসাধারণ উদ্যোগ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যেখানে একত্রিত হয়েছিলেন নানা বয়স, ভাষা এবং বর্ণের শিল্পী, সাহিত্যপ্রেমী ও সংস্কৃতিসেবীরা।

পুর্ব লন্ডনের টাউন হলে অনুষ্ঠিত হয় লন্ডন বাংলা বই মেলা সাহিত্য ত্ত সস্কৃতিক উৎসব। এতে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্হিত ছিলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের প্রাক্তন চেয়্যারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। ১ম ও ২য় দিনের উৎসবের সভাপতি গোলাম মোস্তফা ও কথা সাহিত্যিক সালেহা চৌধুরীর সভাপতিত্তে বিশেষ অতিথি ছিলেন টাওয়ার হ্যামলেটের কাউন্সিলের সস্কৃতি বিষয়ক ক্যাবিনেট মেম্বার কাউন্সিলর কামরুল হোসেন এবং ক্যাবিনেট মেম্বার ব্যারিস্টার মুসতাক আহমদ। এনফিল্ড কাউন্সিলের মেয়র মোহাম্মদ ইসলাম,নিউহ্যাম কাউন্সিলের সিভিক এমব্যাসাডর কাউন্সিলর রহিমা বেগম এবং বৃটিশ কবি ডেভিড মরগেন। অনুষ্ঠানটি শুরুতে সমবেতভাবে বাংলাদেশর জাতীয় সংগীত পরিবশেন করা হয়।

বেশ উৎসবমুখর পরিবেশে বই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এটি ছিল একটি চমৎকার আয়োজন, যেখানে বিভিন্ন বয়সী এবং পেশার মানুষ একত্রিত হয়ে বাঙালি সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে উদযাপন করেছিলেন। মেলার প্রথম অংশে শিশুদের পরিবেশনায় চিত্রাঙ্গন প্রতিযোগিতা, নৃত্য, সংগীত ও বড় এবং আবৃত্তি দর্শকদের হৃদয় স্পর্শ করেছে। নৃত্যের কারিগর ছিলেন শ্রীপর্ণা দেব সরকার। সঙ্গীত পরিবেশনায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন উদীচী সংগীত বিদ্যালয়ের প্রতিভাবান শিশু শিল্পীদের মিউজিক টিচার হীরা কাঞ্চন হীরা। এছাড়াও, ইউকে’র স্বনামধন্য শিল্পী গৌরী চৌধুরী তার অসাধারণ সংগীত পরিবেশন করে সবার মন জয় করেছেন। শিশুদের একাগ্রতা এবং প্রতিভার সঙ্গে গৌরী চৌধুরীর সুরের মূর্ছনা পুরো অনুষ্ঠানকে নতুন এক আঙ্গিকে রাঙিয়ে তোলে।

এছাড়াও শিশুদের মুখাবয়ব, এক্সপ্রেশন এবং সেই মনোমুগ্ধকর নৃত্যবিভা সত্যিই মুগ্ধকর ছিল। শ্রীপর্ণার দক্ষতা এবং শিশুদের নিখুঁত প্রস্তুতি, অনুষ্ঠানকে করেছে অনন্য। শিল্পী রূপী আমিনের গ্রুপ, সপ্তসুর, একত্রিত হয়ে একটি চমৎকার পরিবেশনা উপস্থাপন করেছিলেন। এমন এক পরিবেশনায় আমি নিজেও অভিভূত হয়ে গেছি।

এরপর শুরু হয় “নারী প্রেরণায় সংস্কৃতি” শীর্ষক একটি সেশন। পরিচালনা করেন নিশাদ খুঁজবো, আতিয়া এবং সালমা বেগম (আমি নিজেই)। এই সেশনে নারীরা তাদের জীবনের সাফল্যের গল্প শেয়ার করেন, যা উপস্থিত দর্শকদের অনুপ্রাণিত করেছে। তাদের সংগ্রাম ও সাফল্যের কাহিনী নতুন শক্তি ও আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে।

পরবর্তী আকর্ষণ ছিল ১৬টি দেশের কবিদের কবিতা আবৃত্তি। বিভিন্ন ভাষার মেলার পরিবেশ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এতে কবি হাফসা ইসলামের দক্ষ উপস্থাপনা দর্শকদের মন জয় করেছে। নতুন কবিদের নিয়ে একটি বিশেষ আলোচনা পর্বও অনুষ্ঠিত হয়। উত্তরণ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত বইতে প্রতিটি কবির দুটি কবিতা অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা পাঠকদের আকর্ষণ করে। নতুন কবিরা তাঁদের লেখা কবিতা পাঠ করেন।

বইমেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল বাংলাদেশ থেকে আগত শিল্পীদের গান পরিবেশনা। তাঁদের সুরের মূর্ছনায় মেলার পরিবেশ আনন্দমুখর হয়ে ওঠে। বইমেলায় উপস্থিত ছিলেন বহু কবি, সাহিত্যিক, গবেষক এবং সংস্কৃতিসেবী, যাঁদের সঙ্গে মতবিনিময় ও সৃজনশীল আলাপচারিতা আয়োজনকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে।

১৫তম লন্ডন বাংলা বইমেলায় অংশ নিয়ে আমি এক অনন্য অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। মেলায় অনেকগুলো স্টল ছিল। বাংলাদেশ, ভারত ও বিলেতের প্রকাশনী মোট ১৫ টা স্টলে নানা রকমের সাহিত্যের বই। আমার লেখা চারটি বই ছিল স্টলে, মেলায় স্টল সাজানোর পরপরই আমার লেখা দুটি বই “পিঞ্জর খোলা পাখি” এবং “ভালোবাসার কাব্য মোহল” বিক্রি হয়েছে। এই দুটি বই ক্রয় করেছেন কাউন্সিলর শান্ত ফেরদৌস। এটি আমার জন্য অত্যন্ত অনুপ্রেরণার মুহূর্ত ছিল।

বইমেলায় দর্শকদের সাড়া ছিল অভূতপূর্ব। এতটাই দর্শনার্থীর সমাগম ঘটেছিল যে, এক পর্যায়ে প্রবেশদ্বার বন্ধ করতে বাধ্য হন আয়োজকরা। মেলার প্রতি মানুষের ভালোবাসা এবং আগ্রহ বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁদের গভীর শ্রদ্ধার প্রতিফলন।

এই সফল আয়োজনের নেপথ্যে কাজ করেছেন প্রিয় গোলাম মোস্তফা, মজিবুল হক মনি, হাফসা ইসলাম, সালমা বেগম, সালিনা, মাদবি, তানজিন বাড়ি সুসমা সালিনা, আতিকা বেগম জর্না, কালিশ আহমেদ, জুবায়ের আহমেদ, মলি মোলিকা, মাহদী হাসান, তৌফিক, শাহ বেলাল, দেবাশিস, হিরোক, আসাদ, আফরিন আহমেদ, রুহী, সালিনা আক্তার, শ্রী পর্ণা, মিসবা আহমেদ, জিনুক তালুকদার, পুরবা কুন্ডু, হেবা বেগম,

শিল্পী শ্যামল চৌধুরীর পরিচালনায়, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর, গণসংগীত পরিবেশনা সবার মন কেড়ে নেয়। উদীচী শিল্পীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন: তানজিনা বাড়ি সুমা, হীরা কাঁচন হীরক, আজিজা সুমি, কুদরতে খুদা লাকি, ফারহান লেমান, রুমা জাফর, গোলাম মোস্তফা, ফামিয়া খান-সহ আরও অনেক নিবেদিতপ্রাণ সদস্য।

১০ নভেম্বর বইমেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি সালেহা চৌধুরী। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কাউন্সিলর কামরুল হোসেন মুন্না, কাউন্সিলর রহিমা রহমান, কবি গোলাম কবির, প্রধান সমন্বয়ক গোলাম মোস্তফা এবং সদস্য সচিব মজিবুল হক মনি। আমি এই বইমেলায় প্রধান অতিথি-সহ গেস্টদের অভ্যর্থনা কমিটিতে থাকার সুযোগ পেয়ে ভীষণ গর্বিত। বিশেষ করে “নারী প্রেরণা ও সংস্কৃতি” সেশনটি পরিচালনা করতে পারার অভিজ্ঞতা ছিল আমার জন্য অনন্য। এমন সুন্দর একটি আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। এত সুন্দর একটা প্রোগ্রাম অর্গানাইজ করার জন্য সকল আয়োজক, অংশগ্রহণকারী এবং দর্শকদের প্রতি জানাই আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও শুভকামনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *