যারা ওসমান হাদির ওপর গুলি চালিয়েছে তারা প্রায় দুই সপ্তাহ আগে তার প্রচারণার টিমে যোগ দিয়েছিল বলে জানিয়েছেন ইনকিলাব মঞ্চের একজন সদস্য।
ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য মোহাম্মদ ওসামা জানান, একটি মোটরসাইকেলে করে আসা দুইজনের মধ্যে থেকে একজন ওসমান হাদির ওপর গুলি চালায়। তার দাবি, “এই দুই জন প্রায় দুই সপ্তাহ আগে ওসমান হাদির প্রচারণার টিমে যোগ দিয়েছিল। মাঝখানে কিছুদিন তাদের দেখা যায়নি। কয়েকদিন আগে তারা আবার এসে প্রচারণার কাজে যোগ দেয়”।
এদিকে পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা ঘটনার বিষয়ে ভিডিও ফুটেজ ও সিসিটিভি ক্যামেরা ফুটেজ সংগ্রহ করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই কর্মকর্তা জানান, তারা সব তথ্য যাচাই করে দেখছেন।

প্রসঙ্গত, শুক্রবার দুপুরে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হন বলে জানায় পুলিশ। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছিলেন ওসমান হাদি।
ঢাকা মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক মোহাম্মদ সেলিম বিবিসি বাংলাকে জানান, বিজয়নগর এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন মি. হাদি। গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয় তাকে।
“ওসমান হাদি মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন” বলেও জানান মি. সেলিম। সন্ধ্যার দিকে মি. হাদির অস্ত্রোপচার শুরু হয় এবং ঢাকা মেডিকেলের সিনিয়র চিকিৎসকরা এতে অংশ নেন বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়।
ওসমান হাদির বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো তথ্য জানায়নি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে অপারেশন থিয়েটারের সামনে অপেক্ষমাণ স্বজনদের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, অপারেশনের প্রথম ধাপ শেষ হয়েছে। তাকে ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিট বা আইসিইউতে নেওয়া হবে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে মি. হাদিকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়।
গত বছর জুলাই গণঅভ্যুথানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা একটি প্ল্যাটফর্ম ইনকিলাব মঞ্চ। নিজেদের ‘অভ্যুত্থানে অনুপ্রাণিত সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম’ বলে দাবি করে এই মঞ্চের অফিশিয়াল ফেসবুক পাতায় লেখা রয়েছে, “সমস্ত আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও ইনসাফভিত্তিক একটি রাষ্ট্র বিনির্মাণই” তাদের লক্ষ্য।
ওসমান হাদির জনসংযোগ বা পিআর টিমের প্রধান এবং ইনকিলাব মঞ্চের সেক্রেটারি আব্দুল্লাহ আল জাবের বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, নির্বাচনের জন্য প্রচার চালানোর সময় ওসমান হাদির ওপর গুলি চালানো হয়। মি. জাবের জানান, ঘটনার সময় ওসমান হাদির সঙ্গে থাকা দুইজন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন, তাই সেসময় ঠিক কী হয়েছিল সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত তারা বিস্তারিত জানতে পারেননি।
এই ঘটনার জন্য কাউকে সন্দেহ করছেন কি না প্রশ্নে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের যারা শত্রু তাদের বিপক্ষে তিনি (ওসমান হাদি) সবসময় কথা বলেন। সেক্ষেত্রে বর্তমানে যে পরাজিত শক্তি রয়েছে, তাদের মাধ্যমে এই ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। আবার যারা নির্বাচনের মাঠে ওসমান হাদিকে থ্রেট (হুমকি) মনে করছেন, তাদের মাধ্যমে এটা হতে পারে।”
ঘটনাস্থলের যে ভিডিও ফুটেজ আছে তাদের কাছে, সেখান থেকে গুলি করা ব্যক্তিকে শনাক্ত করা সম্ভব হবে বলেও আশা করছেন তিনি।
এদিকে, তার খোঁজ নিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা-৮ আসনে দলটির প্রার্থী মির্জা আব্বাস হাসপাতালে গেলে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। ইনকিলাব মঞ্চের কর্মীদের বিক্ষোভের মুখে তিনি সেখান থেকে চলে যান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সামনে বিপুল সংখ্যক সেনাসদস্য, বিজিবি ও পুলিশ সদস্যদের মোতায়েন করতে দেখা গেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের বিবৃতি
ওসমান হাদির ওপর গুলির ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদি দুর্বৃত্তদের গুলিতে গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
“নির্বাচনী পরিবেশে এমন সহিংস হামলা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য এবং দেশের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক অঙ্গনের জন্য এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা” বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা।
হামলায় জড়িত সবাইকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ‘দ্রুত ও ব্যাপক তদন্ত’ চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি ওসমান হাদির সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন বলেও প্রেস উইং জানিয়েছে।
“নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে কোনো ধরনের সহিংসতা বরদাশত করা হবে না” এবং “দোষীরা যে-ই হোক, আইনের আওতায় আনা হবে” বলেও এই বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

রাজনৈতিক নেতারা কী বলছেন
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হবার ঘটনায় উদ্বেগ, নিন্দা ও শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
ঘটনার পরপরই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, “গণতন্ত্রে রাজনৈতিক সহিংসতার কোনো জায়গা নেই। কোনো সময়ই না। আমাদের মতাদর্শ যাই হোক, যে কেউ ভয়ভীতি বা শক্তির আশ্রয় নিলে তাকে একসঙ্গে প্রত্যাখ্যান করতে হবে”।
তিনি আরও বলেন, “যখন পুরো জাতি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন খোদ ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার নিন্দা জানানোর কোনো ভাষা নেই”। ওসমান হাদির দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন মি. আলমগীর। একইসাথে অন্তর্বর্তী সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সন্ত্রাস দমনে দৃঢ়ভাবে ব্যবস্থা নেবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হবার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান। দুপুর তিনটার দিকে নিজের ফেসবুক পাতায় তিনি লেখেন, “কোনো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা মতভিন্নতার কারণে এ ধরনের সহিংসতা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়”। এই ঘটনার দ্রুত, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত দাবি করেন মি. রহমান। একইসাথে মি. হাদির পূর্ণ সুস্থতা কামনা করেন তিনি।
এই ঘটনার পর এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, “আল্লাহ আমার ভাইকে বাঁচাইয়া রাখো”। দলটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ও রাজনৈতিক পরিষদ সদস্য আরিফুল ইসলাম আদীব নিজের ফেসবুক পেইজে লিখেছেন, ‘জান দেব তবু জুলাই দেব না’ —- ওসমান হাদি”।
সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীও। “গণহত্যার দায়ে কনভিকটেড হাসিনা ভারতে বসে একের পর এক খুনের হুমকি দিচ্ছিল গত কিছুদিন ধরেই। আর আজকে গুলিবিদ্ধ হলো ওসমান হাদি। এর আগে হাদী বহুবার ভারতীয় নাম্বার থেকে খুনের হুমকি পেয়েছেন,” লিখেছেন তিনি। “আমরা এখনো নিশ্চিত জানি না, কে বা কারা এটা ঘটিয়েছে। যারাই ঘটাক এটার মূল্য তাদের দিতে হবে”।
হাদিকে দেখতে হাসপাতালে মির্জা আব্বাস
এদিকে গুলিবিদ্ধ হাদীকে দেখতে শুক্রবার বিকেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও দলটির ঢাকা-৮ আসনের প্রার্থী মির্জা আব্বাস। এসময় সেখানে উপস্থিত ইনকিলাব মঞ্চের কর্মীদের সাথে মির্জা আব্বাসের সাথে থাকা নেতাকর্মীদের উত্তেজনা তৈরি হয়। উভয়পক্ষ পাল্টাপাল্টি স্লোগান দিতে থাকে। তবে সংঘর্ষের কোনো ঘটনা ঘটেনি সেখানে।
কিছুক্ষণ পর মির্জা আব্বাস তার কর্মীদের নিয়ে হাসপাতাল থেকে চলে যান।
পরে জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমানও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে মি. হাদির অবস্থার খোঁজ নেন। এদিকে, হাসপাতালে পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক সেনা সদস্য মোতায়েন করতেও দেখা গেছে।

