মুসাফির ।। হামিদ আজাদ

প্রবন্ধ-কলাম সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

একজন মুসাফিরের কাছে সমগ্র পৃথিবীই আপন দেশের মত। দেশ থেকে দেশান্তরে, নগর থেকে নগরান্তরে ঘুরে ফিরে মুসাফির। কোন দাবী নেই, কোন চাওয়া পাওয়া নেই। মানুষের ভালবাসা আর দোয়াতেই মুসাফির খুশী। প্রভুর সন্তোষ লাভেই মুসাফিরের আসল সাফল্য।

মহান আল্লাহ আমার জন্য সেই মুসাফির জিন্দেগীই নির্ধারিত করেছেন। আর তাতেই আমার তুষ্টি, আলহামদুলিল্লাহ। ইদানিং অনেকে একটু বেশী বেশী জিজ্ঞ্যেস করেন “দেশে আসছেন নাকি?” অথবা “কবে দেশে আসছেন?”। সঠিক জবাব কি খুঁজে পাইনা। ফলে অনেক সময় বিব্রত বোধ করি। কেননা আমিতো আল্লাহ্‌র পথে নিবেদিত একজন মুসাফির। আল্লাহর সৃষ্ট এ পৃথিবীটা আমার ইহলৌকিক ঠিকানা। আর অহর্নিশ দিক্বিদিগ ঘুরে ফিরছি আসল জীবনের যথার্থ ঠিকানাটা নিশ্চিত করার জন্য।

অতএব, আমিতো প্রতিদিন দেশে যাচ্ছি আর দেশেই আসছি। গত ৬ সপ্তাহে তিন মহাদেশের ৫টি দেশের ১৪টি শহরে আল্লাহ আমাকে সফর করিয়েছেন। কর্তব্যের তাড়নায় এ পর্যন্ত প্রায় সত্তরটি দেশ সফর করতে হয়েছে। যত জনপদে গিয়েছি সব জায়গায় ভাই বোনরা এত ভালবাসা ও মহব্বতপূর্ণ আতিথেয়তা উপহার দিয়েছেন যে, কোথাও পরদেশে আছি বা গেছি বলে মনে হয়নি।

সেদিন খুবই সংক্ষিপ্ত সফরে বাংলাদেশ যাওয়ার পথে রিয়াদে মাত্র ছয় ঘন্টার stop over ছিল। খবর পেতেই রিয়াদের কিছু ভাই এয়ার পোর্টে এসে আমাকে নিয়ে গেলেন, একটা প্রতিষ্ঠানের বোর্ড মেম্বরদের সাথে মিটিং করালেন। আমার এক প্রিয় ভাতিজির বাসায় খাওয়ার আয়োজন করে আমার মাত্র ছয় ঘন্টার যাত্রা বিরতিকে যেভাবে ফলপ্রসূ ও আনন্দদায়ক করলেন, এতে মনে হয়েছে আমি আমার নিজ পাড়ায় আপন ভাইদের সাথে এবং ভাতিজি ও নাতি নাতনিদের ভিজিট করতে গিয়েছি।

এভাবে মক্কা, মদীনা, রিয়াদ, ডালাস, নিউ ইয়র্ক, বফেলো, মিলানো, মানচেষ্টার, বার্মিংহাম, রোম, স্টকহোম, প্যারিস, স্ট্রেসবোর্গ, পর্তু, লিসবন, জাকার্তা, রাবাত, ঢাকা, সিলেট, কোলকাতা, কুয়েত যেখানেই গিয়েছি বা যাই সেখানেই আপন ঘরের অনুভূতি ফিরে পাই আলহামদুলিল্লাহ। দ্বীনের জন্যে ঈমানের ভিত্তিতে গঠিত ভাই বোনদের মহব্বত সমগ্র দুনিয়াকেই এভাবে আপন পরিবারে পরিনত করেছে। যখন যে দেশে যাই সে দেশটিই মনে হয় আমার দেশ, যখন যে মহল্লার যাই সে মহল্লাটিই মনে হয় আমার মহল্লা। দোয়া করি এবং দোয়া চাই যেন আল্লাহ এ সফরের শেষ গন্তব্যটা জান্নাত আল ফেরদাউসেই নির্ধারন করেন, আমীন।

গত ৪০ বছরের প্রায় অর্ধেক সময় আকাশে অথবা গাড়ীর চাকার উপর চলন্ত অবস্থায় কাঠিয়েছি। যখন চলন্ত অবস্থায় ছিলাম বা থাকি তখন আল্লাহর মহিমায় শুধু আল্লাহর অনুগ্রহের বদৌলতে বেঁচে থাকি। যখন বিমানে উঠি অথবা গাড়ীতে পা দেই, তখন পুরোপুরি আল্লাহর মর্জির হাতে নিজেকে তুলে দিয়ে সফর শুরু করি এ বিশ্বাসে যে, আল্লাহ যদি চান তাহলেই শুধু জমিনে বা গন্তব্যে ফিরে আসব/যাব, না হয় এটিই হয়ত দুনিয়ার শেষ সফর।

এইতো গতকাল ইতালীর মিলানে এয়ারপোর্টে যাওয়ার পথে বিরাট একটা দূর্ঘটনায় পতিত হলাম। গাড়ীতে উঠে সফরের দোয়া শেষ করতে না করতেই আমাদের গাড়ীটা আরেকটা গাড়ীর সাথে সজোরে ধাক্কা খেল। আমাদের গাড়ীর সামনের অংশ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল। কিন্তু আমরা যারা গাড়ীতে ছিলাম সবাই অক্ষত রয়ে গেলাম, আলহামদুলিল্লাহ। মানবিক হিসাবে মিলেনাট কেমনে আমরা অক্ষত থাকলাম। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে আমরা অক্ষত। এটি নিছক আল্লাহর মায়া ছাড়া আর কিছু না, আলহামদুলিল্লাহ। দূর্ঘটনার খবরটি ২/১ জন ছাড়া কাউকে বলা হলনা। কিন্তু যারা খবর পেলেন তারাই আপন ভাইয়ের মত দরদী মন নিয়ে ছুটে এলেন এক অনাবিল মায়া আর পেরেশানী নিয়ে, আর বিনা বাক্য ব্যয়ে আমাদেরকে এয়ারপোর্টে drop দিলেন। এ ভালবাসা অনাবিল। দেশ ও আন্চলিক গন্ডির বাইরে এ ভালবাসা জান্নাত পর্যন্ত বিস্তৃত।

আমার মুসাফির জীবনের সবচেয়ে সুখের দিক হচ্ছে, যে দেশ থেকে সফর শুরু করেছি সে দেশে আমার স্বপ্নের বাগনটি ফুলে ফলে সুশোভিত আজ। পৃথিবীর অলিন্দে দ্বীনের মশাল হাতে যেখানেই যাই সেখানেই সে বাগানের ফুলের সম্মোহনী ঘ্রানে মন ভরে যায়। যে ছোট্ট বাগানের আমি একজন নগন্য মালি ছিলাম সে বাগানের চারাগাছ নিয়ে পৃথিবী জুড়ে হাজারো বাগান গড়ে উঠেছে। সে সব বাগানের ফল আর ফুলের সৌরভে আল্লাহর দুনিয়ার আনাচে কানাচে প্রশান্তির গুন্জরন শুরু হয়েছে। সবচেয়ে বড় প্রশান্তি হচ্ছে যে বুনিয়াদি বাগানে আমি মালি হিসেবে জীবন শুরু করেছি, সে বাগান আজ বিশ্বময় সুরভিত জীবনের প্রেরনার উৎসে পরিণত হয়েছে।নবীনরা আজ পথ দেখাচ্ছে, প্রেরনা দিচ্ছে। এর চেয়ে বড় প্রশান্তি আর কি হতে পারে। এ জন্যে মহান রব্বের দরবারে কায়মনোবক্যে শোকরিয়া জানাই, আলহামদুলিল্নাহ।

দোয়া চাই যেন আমৃত্যু জান্নাতের পথে নিবেদিত এ সফর সক্ষমতার সহিত অব্যাহত রাখতে পারি। “খোদার বিধানে মূখরিত হবে এ অপয়া পৃথিবী” এ স্বপ্ন নিয়ে সফর অব্যাহত রেখেছি, এ স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখে যেন মহান রব্বের কাছে ফিরে যেতে পারি।
বিশ্ব জুড়ে কর্মশালা / সবার আমি কর্মী / কাজের মাঝে জীবন খুঁজি / ঈমানটাই শুধু পুজি।

* ব্যারিষ্টার হামিদ হোসাইন আজাদ এমসিএ’র কেন্দ্রীয় প্রেসিডেন্ট, খ্যাতিমান আইনজীবী ও মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *