এক
কবি মুসা আল হাফিজ এক আশ্চর্য প্রতিভা। প্রতিভার কাজ হচ্ছে আলো আর অন্ধকারকে আলাদা করা। স্বভাবতই তখন দ্বন্দ্ব অনিবার্য । তবে এই দ্বন্ধ কবি-মনের অর্ন্তদ্বন্দ্ব নয়, এটা পাঠক কিংবা সমালোচকদের পার্শপ্রতিক্রিয়ার ফল। যার পেছনে থাকে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, আদর্শিক নানান থিওরিটিক্যাল ফ্রেইম। বাংলা সাহিত্যের এই আশ্চর্য প্রতিভাকে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে সমালোচনা হবে। যেভাবে হয়েছে বড় প্রতিভাদের নিয়ে, কালে কালে।
ষোড়শ শতকে স্টিফেন গজন (১৫৫৪-১৬২৪) অগণিত অভিযোগ আনয়ন করেছিলেন কবি এবং কবিতার বিরুদ্ধে। অন্যদিকে কবি ও সাহিত্যবিশ্লেষক স্যার ফিলিপ সিডনি (১৫৫৪-১৫৮৬) উল্লেখযোগ্য অভিযোগ সমূহের মোকাবেলা করেন। An Apology for Poetry শিরোনামের (১৫৮০ সালে লিখিত হলেও ১৫৯৫ সালে মরোনোত্তর প্রকাশিত) স্টিফেন গজনের সেই সব প্রশ্নের সমুচিত জবাব দিয়েছিলেন, যেগুলো জবাব পাবার যোগ্যতা রাখে। সেন্স টু সেন্স প্রসেসে এই শিরোনামের অর্থ করলে দাঁড়ায়: কবিতা নিয়ে মিথ্যাচারের জবাব। তারই পথ ধরে আমার আজকের লেখার শিরোনাম An Apology for Musa Al-Hafij।
কবি মুসা আল হাফিজের বিরুদ্ধে দূর কিংবা নিকট ভবিষ্যতে সংস্কৃতির নামে, প্রগতির নামে এমনকি রাষ্ট্রীয় মদদে রচিত হবে কুৎসা। যদিও কাজটা অতটা সহজ হবে না। প্রতিভার বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো যখন কঠিন হয়ে পড়ে, তখন কৃত্রিম প্রশংসা করে একঘরে করে রাখার নজিরও বিশ্বসাহিত্যে আছে। তাই আমার মন বলছে ভবিষ্যতে কবি মূসা আল হাফিজের কবিতার বিরুদ্ধে যত আক্রমন আসবে তার মধ্যে অন্যতম হবে- উনি যতটা না কবি তার চেয়ে বেশি পাদ্রী (ধর্মগুরু)। যেমন করে বিংশ শতাব্দীর প্রতিভা টিএস এলিয়টকে নিয়েও বলা হয়েছিল।
টিএস এলিয়ট’র The Waste Land কবিতার মুখোমুখি দাঁড়াতে না পেরে তথাকথিত সমালোচনাকারীরা অনেকটা প্রশংসার সুরে বলতে চেয়েছেন এগুলো তো কবির কবিতা নয়, পাদ্রির সারমন। এ হচ্ছে কবিতার মঞ্চ থেকে কবিদের সাইড লাইনে পাঠিয়ে দেয়ার চতুর কৌশল, যা ব্যর্থ সমালোচকদের মধ্যে দেখা যায়। মুসা আল-হাফিজের বেলায়ও এটা পরিকল্পিতভাবে করা হবে। তবে সমালোচনাকারীরা পেরে উঠবে না এই দেবদারুর সামনে।
কবি মুসা আল হাফিজের কবিতার অন্তর্লাবণ্য, দার্শনিক চিন্তা, শব্দচয়ন, মেটাফর, বাণীমহিমা, ইঙ্গিত, মোটের উপর তার কাব্যশৈলীর সামনে মুখ থুবড়ে পড়া ছাড়া নিন্দুকদের করার তেমন কিছু থাকবেনা। যে কাব্য প্রতিভা কোরান, পুরান, ইতিহাস, দর্শন ইত্যাদি মন্থন করে সময়কে স্পর্শ করে, তাকে মোকাবেলার যোগ্য কণ্ঠস্বর যখন-তখন পাওয়া যায় না।
এক সময় প্রশংসার ছলে হয়তো বলবেন কবিতার উপকরণ হিসেবে কবি মুসা আল হাফিজ যে বিস্তরভাবে ধর্মীয় অনুসঙ্গ দিয়ে আধ্যাত্মিক আবহ তৈরী করেছেন, তাতে কবিতার ময়দানকে সার্থকভাবে তাফসির মাহফিলে রূপান্তরিত করছেন। এ যেন কবিতার পাঠঘর নয়, বরং ফুরকানিয়া মজলিশ যার মুহতামিম কবি মুসা আল হাফিজ। কিংবা এ যেন সুফিদের খানকা, যেখানে শব্দের শিরনী বিতরণ করছেন তিনি। অতএব, কবিতার আসনে সমাসীন হওয়ার চেয়ে বরং প্রার্থনালয়ের মিম্বরে তাকে বেশ মানাবে।
মিস্টিক কবিতার সাথে মিত্রতা করে আসছে আদি থেকেই। কিন্তু সফল কবিরা তাকে অবলম্বন করেছেন। এমনকি কবিতার পিয়র চাইল্ড খ্যাত- জন কীটস (১৭৯৫-১৮২১) ও জীবনানন্দ দাশের (১৮৯৯-১৯৫৪) কবিতাগুলোও মিস্টিসিজম দ্বারা সংক্রমিত, অমরত্বের তৃষায় তৃষিত। ধর্মীয় রুহজগতকে টেনে না আনলেও কীটস এর পলায়নবাদ বা জীবনানন্দ দাশের জন্মান্তরবাদ খুঁজে ফিরেছে আত্মার সুরক্ষা, আত্মার অমরত্ব। এরিস্টটল (৩৮৪-৩২২ খ্রিস্টপূর্ব), ভার্জিল (৭০-১৯ খ্রিস্টপূর্ব), অভিদ (৪৩ খ্রিস্টপূর্ব- ১৭/১৮ খ্রিস্টাব্দ), দান্তে (১২৬৫-১৩২১), সিডনি (১৫৫৪-১৫৮৬), ওয়ার্ডসওয়ার্থ (১৭৭০-১৮৫০), ম্যাথু আরনল্ড (১৮২২-১৮৮৮) সাক্ষী-সূচনালগ্ন থেকেই কবিতার কাজ ছিল পাঠককে নৈতিক শিক্ষা দেয়া। মূর্ত ও বিমুর্তের মিলণ ঘটানো।
মুসা আল হাফিজ ক্লাসিক্যাল মাস্টারদের পথেই হেঁটেছেন এবং সেটা সফলভাবেই। ইংরেজি সাহিত্যের অগ্রগণ্য কবিদের উল্লেখযোগ্য লেখার সাথে মিলিয়ে আলোচনা করলে বুঝা যাবে মুসা আল হাফিজকে ডিফেন্স করার প্রয়াস যতটা না ব্যক্তিক তার চেয়ে বেশি নৈর্ব্যক্তিক।
দুই.
পশ্চিমা সাহিত্যের সুতিগাকার গ্রীক কিংবা পৃথিবীর সমগ্র সাহিত্যের রসদ জুগিয়েছে বিভিন্ন ধর্মের বিশ্বাসজাত বিষয়াদি। বিশ্বসাহিত্যের আদি কবিকুলের কাব্য প্রতিভার প্রথম পাঠ ছিল ধর্মীয় বিশ্বাস। যার প্রমাণ প্রত্যেক দেশের সাহিত্যের আদিবইগুলো। আপাতত বিশ্ব সাহিত্য রেখে দৃষ্টি দেওয়া যাক শুধু ইংরেজি সাহিত্যে। ইংরেজি সাহিত্যে ধর্মীয় চেতনা যে পরিসরে এসেছে, তার পরিধি ব্যাপক। তাই পুরো সাহিত্য না এনে শুধু কবিতার প্রসঙ্গ আনতে যাচ্ছি। তাও সব কবিতা ছোট আকারের এই লেখায় উপস্থাপন করা সম্ভব নয়, সংগতও নয়; আমার বক্তব্যের প্রমাণের জন্য হিসেবে যতটুকু আনা দরকার, ততটুকুই আনব।
মেটাফিজিকাল কবিদের দেহের উর্ধ্বে ওঠে আত্মা বা পরমসত্তার জয়গান গাওয়ার যে প্রচেষ্টা, কবি মুসা আল হাফিজের কবিতার পরতে পরতে যেন তারই তপোধ্বনি। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, এডমান্ড স্পেন্সারের মত সমসাময়িক কিংবদন্তি লেখকদের ভিড় ঠেলে কাব্য জগতে তার স্বকীয় জায়গা দখল করে নিয়েছিলেন মেটাফিজিকাল কবিতার পুরোধা- জন ডান (১৫৭২-১৬৩১)। যাকে বাদ দিলে ইংরেজি সাহিত্যের মেটাফিজিকাল কবিতার অভাবনীয় সৌন্দর্য বাদ যাবে। তিনি পাদ্রীও ছিলেন, এমনকি প্রখ্যাত গীর্জা সেন্টপলস এর ভাইস চ্যান্সেলরও হয়েছিলেন। সুতরাং মাদ্রাসা শিক্ষার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত শায়েখ মুসা আল-হাফিজের নিশ্চয় কবি মুসা আল হাফিজ হওয়াতে কারো আপত্তি থাকার কথা না।
যাই হোক। শুরুর দিকে জন ডান প্রেমের কবিতা লিখলেও পরিণত সময়ে তার লিখিত কবিতার গায়ে পরিয়ে দিয়েছেন ধর্মীয় চেতনার চাদর। ঔ যে তার হলি বা পবিত্র সনেটগুলো; নামকরণই তো পাঠককে জানিয়ে দিয়েছে ভেতরে ধর্মীয় বোধের সুনিপুণ উপস্থাপনার কথা। মাত্র একটা কবিতার উদাহরণই যথেষ্ট- Holy Sonnet 14 or Batter my heart, three-person’d God। কবিতার শুরুর তিন লাইনে জন ডান কোন অধিপতির কাছে যেন ফরিয়াদ করছেন-
হে ত্রয়ী সত্ত্বার স্রষ্টা!
আমার অন্তরসত্তায় ঝাঁড়া দাও- নবনির্মাণে।
এই ঝাঁড়া, পর্যবেক্ষণীয় বিরতি, ঘষামাজা-
ধরে নেব আমারই সংশোধনে;
যাতে আমি জাগরিত ও উত্থিত হতে পারি…।
মনে হচ্ছে এটা কোনো কবির কবিতা নয়, যেন কোনো পাদ্রির কন্ঠে উচ্চারিত স্তোত্র। কবি মুসা আল হাফিজের মুক্তির ফরমানও রবের সান্নিধ্যে থাকার মধ্যে নিহিত। তাই মর্তলোকের সমুদয় আকষর্ণে না আটকে তার হ্নদয় লীন হয়ে আছে স্রষ্টার আলোয়-
চিত্রপ্রদর্শনী, কবিতার শিবিরে, প্রাচীন সরল ভোর
জ্যোৎস্নার দারুণ ঢেউ নেই কোথাও!
আয়াজের মতো আমি মাতাই মাঠের ঘাস
পাখির মতো নীলিমায় ছড়াই বুকের আগুন
নিখোঁজ নিখোঁজ বলে হাতড়াই মেঘের নাড়িভুঁড়ি!
পেলাম না কোথাও
হৃদয়!
হৃদয়!
পেলাম না।
হে প্রভু আমার মজনু হৃদয়
তোমারই আলোয় তবে লীন হয়ে গেছে?” (তোমার রহস্যে)।
জন ডান শয়তানের ধোকায় পড়লে সহজ সরল পথের জন্যে হাত তুলার জায়গাটা চিনিয়ে দিচ্ছেন কায়মনোবাক্যে। যেমন-
তোমার (মহান সৃষ্টিকর্তার) কাছে নিয়ে
তোমার গোলাম করে রাখলেই আমি হবো
সত্যিকারের মুক্ত, তোমার করুণায় বিধৌত না হলে
আমি হবো না কখনোই সূচি-শুদ্ধ।
মুসা আল-হাফিজের বিশ্বাসও তাই। স্রষ্টার নাম জপ, ধ্যান ও প্রেমে তার সমস্ত আরোগ্য, সমুদয় বিজয়। যেমন –
আমার নিঃশ্বাস থেকে কালের প্রান্তরে
জ্বলে উঠল সুগভীর বিজয়ের শিখা
আমার বিশ্বাস থেকে সমস্ত আত্মার পাখি
মহাকালে জিকির করছে স্বর্গীয় মৌতাতে। (জয়যাত্রার গান)।
কবি মুসা আল হাফিজের বলার যে আত্মবিশ্বাস, তা কেবল কবিমন বলতে পারে না, আবার কেবল ঋষিমন এককভাবে বলতে পারার কথা না। দুইয়ের যৌথ প্রযোজনাতেই সম্ভব। যেমন-
এইবার দেহের কবর ভেঙে সত্তার পুনরুত্থান কে ঠেকাবে?
অস্তিত্বের প্রতিটি কণায় তরুণ নক্ষত্রের মতো জ্বলে উঠছে
পরমের নামের নামতা। রক্তের গহিনে তার ঘোরের ঘূর্ণি লেগে
সুবিমল যে জোয়ার সবেগে জেগেছে
তার তোড়ে জীবনের প্রাণ পেয়ে গেলে
আমি বলে আর কোনো প্রতিমা থাকবে না।
আমিহীন উদ্ভাসনের শুদ্ধপ্রাণঝড়ে
মহাবিশ্বে জেগে উঠব অন্তহীন অস্তিত্বের জ্বলন্ত তুর পাহাড়।” (ফানার প্রতীক্ষা)
তাই মুসা আল-হাফিজ কবি এবং পুরোহিত দুটাই।
তিন.
মেটাফিজিকাল কবিদের মধ্যে জর্জ হারবার্ট (১৫৯৩-১৬৩৩) ও হেনরী ভন (১৬২১-১৬৯৫) প্রথম সারির কবি। কলেজ পড়ুয়া ষোল বছরের একটা ছেলে তার মাকে নববর্ষের উপহার হিসেবে দুটি সনেট লিখে পাঠিয়েছিল। যেখানে ছেলেটা প্রশ্নাকুল মনে জানতে চেয়েছে- কবিতায় কেন শুধু প্রেমের কথা বলা হবে? প্রকৃতির কথা এবং তার নিয়ন্তার কথা কেন বলা হবে না? জানতে চাওয়া সেই ছেলেটি জর্জ হারবার্ট। তাই তো তার পরিণত বয়সের কবিতায় সৃষ্টিকর্তার ঐশ্বরিক ক্ষমতা, সৃষ্টিকর্তার মহিমাসহ আধ্যাত্মিকতার পরশ জায়গা করে নিয়েছে।
জর্জ হারবার্ট এর Discipline, The Alter, Vertue, The Collar, Easter Wings, The Affliction, The Puplley সহ অসংখ্য কবিতায় ধর্মীয় চেতনার স্পষ্ট বার্তা পাই। ঠিক একইভাবে মুসা আল-হাফিজের কবিতা ফ্রয়েডিয় কামুক প্রেমকে পাশ কাটিয়ে, স্রষ্টা অনুমোদিত প্রেমের আবাহনের ভেতর দিয়ে জীবন ও জগতে স্রষ্টার শৈলী, করুণা ও প্রতিপালনের মহিমা তুলে ধরেছে। তার কবিতা ফিজিক্স এবং মেটাফিজিক্সসকে এক করে স্রষ্টার নৈকট্য লাভের পথ দেখিয়েছে। ফ্রয়েডের মনোপ্রকল্প যে প্রভাব তৈরী করে, তা বিদ্ধ হয়েছে মুসা আল হাফিজের নিন্দায়। দীর্ঘ ও বিখ্যাত একটি কবিতায় তিনি লিখেন-
সত্তার যে চাষাটি
জ্যোৎস্নাভরা খেতে করবে মনীষার চাষ, সে এখন
বোধের পাহাড় কাটে
ফ্রয়েডের ছদ্মমানুষ। (মহাবিশ্বের করতালি)
অক্সফোর্ডের খাতায় নাম লেখানো হেনরি ভন লন্ডনে চলে গেলেন আইন পড়ার জন্যে, যদিও শেষমেষ হয়েছেন ডাক্তার। মুসা আল হাফিজের কবিতার বিষয়বস্তুর মতই সহমর্মিতা, সৌহার্দ, সহনশীলতা এবং আত্মশুদ্ধি- ঘুরে ফিরে এসেছে হার্বাটের কবিতায়। সেই সব কবিতার মধ্যে Peace, The Retreate, Regeneration অন্যতম। The Retreate কবিতার শেষ দুই লাইনে কবি সীমাহীন আশা প্রকাশ করেছেন- তিনি পুনরায় ফিরে যাবেন সৃষ্টিকর্তার কাছে, তার স্বর্গীয় নিবাসে। মুসা আল-হাফিজের ট্রেন কবিতার ট্রেনও যাচ্ছে পরম সত্ত্বার কাছে-
ট্রেন ছুটছি, সামনেই মঞ্জিল
হার্দিক হুইসেলে মাটির বিদ্যুতে জাগে ফেনিল দাবিনামা!
’কী চাই মাটির’ আকাশের চারদিক কেঁপে শিরিন ধ্বনি ওঠে
মানুষের স্টেশনে নামো অনন্তের শ্লাঘা
সূর্যের সৈকত এসো চুপ করে শৈবালের পাশে
চুম্বকদিগন্তে ঐ সচ্ছল ঘাস, কেউ তার বুক মাড়িয়ো না
আর যিনি মহীয়ান, সত্তার ওয়াদাসহ
পাঠাতে হবে দূত। আদমের চর সাক্ষী
কলবের উলাসে নীলিমা হবে জিলানীর নিঃশ্বাস!
ট্রেনের ঝরোকা থেকে উড়বে প্রাণের পাখি কুসুম জিকিরে।
হৃদয়ের আলো ও বিশ্বাসের জীবন্ত আলিঙ্গণ কতো ঐকান্তিক হলে কবিতা এরকম মহির্ষির মত প্রাজ্ঞ হয়ে ওঠে? উত্তরটা পাঠকের কল্পনা থেকেই আসুক।
কবিতার মনোযোগী পাঠক মাত্রই ভিক্টোরিয়ান যুগের প্রবক্তা আলফ্রেড টেনিসন (১৮০৯-১৮৯২) এর নাম শুনে থাকবেন। Crossing the Bar নামে টেনিসনের একটা কবিতা আছে। কবিতার সমাপ্তিটা হয়েছে সৃষ্টিকর্তার সাথে দেখা হওয়ার এক স্বর্গীয় আত্মবিশ্বাসী প্রত্যাশা দিয়ে। কত মমতা নিয়েই না বলেছেন-
যখনই অতিক্রম করব বালুচর
সরাসরি দেখা দেবেন আমার ইশ্বর।
প্রভুপ্রেমী কবি মুসা আল-হাফিজ আলফ্রেড টেনিসনের প্রত্যাশাকে অতিক্রম করেন। কারণ ইতোমধ্যে তার হ্নদয় নিমজ্জিত হয়ে গেছে পরমসত্ত্বার সত্যে-
হে প্রভু আমার মজনু হৃদয়
তোমারই আলোয় তবে লীন হয়ে গেছে? (তোমার রহস্যে)
ইংরেজ মহাকবি জন মিল্টনের (১৬০৮-১৬৭৪) মহাকাব্য আমাদের আলোচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক জায়গা। সেখানে তিনি এ্যাডাম ও ঈভকে নিয়ে কাব্য করেছেন। মুসা আল হাফিজও তা করেছেন ঈভের হ্রদের মাছ ও আদমের আত্মজীবনী থেকে কবিতায়। ঈশ্বরের সাথে শয়তানের চিরন্তন প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর মাঝখানে পড়ে মানুষের অসহায়ত্ব নিয়ে কথা বলেছেন মিল্টন। বাইবেলকে অবলম্বন করে তার কবিতা রচিত হয়। সেখানে স্বাধীনতা ছিলো মূল আকাঙ্খার বিষয়। মুসা আল হাফিজের ঈভ ও আদম বিষয়ক কাব্যে প্রেম, বিশ্বজনীনতা ও মানবমহিমা হলো মূল আকাঙ্খার বিষয়। এ বিষয়ে কথা অনেক দীর্ঘ হতে বাধ্য। ঈভের হ্রদের মাছ ও আদমের আত্মজীবনী কবিতাদ্বয় রোমান্টিকতার পাশাপাশি দার্শনিকতা ও ভাবুকতার দ্বারা বৈশিষ্টমণ্ডিত।
এ নিয়ে কথা না বাড়িয়ে জন মিল্টনের On His Blindness শিরোনামের ছোট্ট একটা সনেটের প্রসঙ্গ আনা যাক। কবিতার বক্তা হতাশ। কেননা অর্ধজীবন পার হওয়ার আগেই সৃষ্টিকর্তা তাকে অন্ধ করে দিয়েছেন। যদি অন্ধ করে না দিতেন, তাহলে সে উপযুক্তভাবে তার সুপ্ত প্রতিভা দিয়ে সৃষ্টিকর্তার উপাসনা করতে পারত। বক্তার ব্যথিত মন অভিযোগের সুরেই জানতে চায়, পরকালে তার হিসাবটা কি অন্যদের মতই হবে? তাকে কি একটু বিবেচনা করা হবে না?
বক্তার অধৈর্য্য মন সহসা শান্ত হয়, পুনর্জাগরিত হয়। কারণ সে উপলব্ধির মোহনায় পৌছে যায়। সে বুঝতে পারে , কে অন্ধ কে বধির, কার কী আছে কার কী নেই, সব অভিযোগ পাশ কাটিয়ে যার যার অবস্থানে থেকে সৃষ্টিকর্তার আদেশ শর্তহীনভাবে মেনে নেওয়াটাই সুখ, উত্তম উপাসনা। এভাবে তার সত্তা উচ্ছ্বসিত হতে থাকে, হ্নদয়ের স্বাধ ধরা দেয় নতুন মুগ্ধতা নিয়ে। কবি মুসা আল হাফিজের কাব্যেও আমরা দেখবো ভিন্ন চরিত্রে একই ধারার ঘটনা ঘটে।
মুসা আল হাফিজ সিনাইয়ের তুর হিসেবে নিজের সত্তাকে ভাবতে পারার মাঝে আধ্যাত্মিক সুখ অনুভব করছেন। হ্নদয়ের সমস্ত সুখ, শিহরণ, নবজাগরণ যেন অতিইন্দ্রিয় অনুভূতিতে। কবি বলেন-
যে দিন হলাম আমি সিনাইয়ের তূর
দগ্ধ হয়ে হই সেই মুগ্ধ উদ্ভাস
সত্ত্বায় জেগে উঠলো নিখিলের সুর
জীবনের নদী হলো তোমার উচ্ছাস
যে দিন পেলাম সেই হৃদয়ের স্বাদ
আহা সে কী দীপ্ত মুগ্ধ স্নিগ্ধ শিহরণ
প্রকৃতির রক্তজলে তারই ঐকনাদ
বৃষ্টির হরফ লেখে সেই বিবরণ
বিগত প্রহরে ছিলো মহাকাল কাছে
বুকে তার নদীর মতো গীতিকার ঢেউ
মাতামাতি করে চির ব্রীড়াতুর মাছে
অনন্তের চিত্রকর তিনি ছাড়া কেউ?
আমাতে তলিয়ে আমি তারে শুধু পাই
তার গানে সুর দিলে আমি আর নাই। (তিনি)।
এতে মুসা আল হাফিজকে কবি না পুরোহিত একক সম্ভাষণে না যেয়ে অপরিহার্যভাবে শব্দসমন্বয় করে বলতে হচ্ছে তিনি ঋষি-কবি, কবিতা-পুরোহিত। (চলেব)
* মোহাম্মদ মহি উদ্দিন পিএইচডি গবেষক, এডুকেশনাল লিডারশীপ, পলিসি এন্ড টেকনলজি স্টাডিজ, আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র mohi.sust6049@gmail.com