সাঈদ চৌধুরী
মাওলানা আবু আহমাদ হিফজুর রহমান ছিলেন একজন নিরব সাধক, সদালাপী, বিনয়ী ও নির্মোহ ব্যক্তিত্ব। ২০০২ সাল থেকে লন্ডনে দারুল উম্মাহ মসজিদে যুক্ত ছিলেন। ইমাম ও খতিব হিসেবে তাকে পেয়ে মুক্তাদিরা ছিলেন গর্বিত। তার কান্নাজড়িত দোওয়া এবং রূহানীয়তপুর্ণ বয়ান ও নসিহতে শ্রোতাদের মনে জাগ্রত হত সততা, সাবধানতা এবং তাক্ওয়া।
খতীব হিসেবে আবু আহমাদ হিফজুর রহমানের বয়ানে ছিল প্রাণচঞ্চলতা। ‘ওয়ারাসাতুল আম্বিয়ার’ ধারা নিয়ে কথা বলতেন। নবী-রাসুলগণের পদাংক অনুসরণে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ী’ন, তাবে তাবেয়ী’ন, আইয়িম্মায়ে মুজতাহিদ্বীন, আওলিয়ায়ে কেরাম ও মশায়েখে ইজামগণের সিলসিলার ব্যাপারে বেশ সংবেদনশীল ছিলেন।
আদর্শ পরিবার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর বয়ান ছিল বেশ উজ্জ্বল। ব্যক্তি জীবনে নির্লোভ ও পরোপোকারী ছিলেন। জীবন ও কর্মের মধ্য দিয়ে ইসলামী মূল্যবোধকে প্রসারিত ও বিকশিত করেছেন। সাধাসিধে জীবনের অধিকারী এই ব্যক্তিত্ব ছিলেন অত্যন্ত অবিচল মুত্তাকী। তাক্ওয়া ও পরহেজগারীর চিহ্ন ছিল তার মুখমন্ডলে। নীতিনিষ্ঠ এই মহতি মানুষ খুবই প্রচার বিমুখ ছিলেন। কাজ করেছেন নীরবে নিরন্তর। কখনো খ্যাতির প্রত্যাশা করেননি।
দুনিয়ার ঝামেলায় জড়াতে পছন্দ করতেন না। আল্লাহর দ্বীন কায়েমের জন্য নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন আজীবন। এক সময় দাওয়াতুল ইসলাম ইউকে এন্ড আয়ারের সফল সেক্রেটারি ছিলেন।
মাওলানা আবু আহমাদ হিফজুর রহমান স্মৃতি-তাড়িত হয়ে বারবার ফিরে যেতেন অতীতে। সিলেট সরকারী আলিয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়ন কালের কতকথা আলোচনা করতেন। আলিয়ায় আমাদের ওস্তাদদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন প্রখ্যাত ইসলামি ব্যক্তিত্ব আল্লামা ফখরুদ্দীন। অধ্যয়নকালের ব্যবধান এক যুগের অধিক হলেও ফখরুদ্দীন জনাবকে উভয়ে পেয়েছি।
১৯৬৮ সালের ৩১ অক্টোবর আল্লামা ফখরুদ্দীন সিলেট আলিয়ায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর কয়েক দফা ঢাকা ও সিলেট আলিয়ায় বদলি ও প্রমোশন হয়েছে। ১৯৮৯ সালের ৫ আগস্ট যখন ঢাকা থেকে সিলেট আসেন তখন আমি সিলেট আলিয়া মাদ্রসার ছাত্র। ১৯৯৩ সালে তিনি সিলেট জেলা থেকে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন।
আল্লামা ফখরুদ্দীন ছিলেন ইলমে হাদিস, ফিকহ ও তাসাউফ বিশেষজ্ঞ। জাতির মেধাবী মানুষ গড়ার কারিগর। মাদ্রাসা ছাত্রদের কাছে নক্ষত্রতুল্য এবং শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষণজন্মা হাদীস বিশারদ হিসেবে সমধিক খ্যাত। গুনী অধ্যাপক ও অভিজ্ঞ প্রশাসক। মুহাদ্দিস হিসেবে দীর্ঘ দিন হাদিসের পঠন-পাঠনের ফলে গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। এক ধরনের হাফিজ মনে হত।
ক্লাসে একটা হাদিস ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অসংখ্য হাদিস থেকে বর্ণনা দিতেন। ক্লাসের আলোচনায় প্রায়ই রিসালাত এবং ওয়ারাসাতুল আম্বিয়ার গুরুত্ব বিশ্লেষণ করতেন। অত্যন্ত গভীরভাবে অতীত ঐতিহ্য ও আজকের প্রত্যাশা তুলে ধরতেন। আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বাতলে দিতেন। মিশকাতুল মাসাবিহ অধ্যয়ন কালে ‘আল ওলামাউ ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া’ অর্থাৎ আলেমরা হলেন নবী-রসুলদের উত্তরসূরি- একথা বুঝাতে বেশ কয়েকদিন ক্লাস নিয়েছেন।
আরবিতে দক্ষতার সাগর ছিলেন। তাঁর প্রতিটি নিঃশ্বাসে তসবিহ অথবা তা’লিম ছিল। প্রত্যেকটি কথা ও উচ্চারণ মহান মাবুদের অনুগ্রহ হাসিলের পাথেয় ছিল। কথার মাঝে আলোর ঝলক ছিল। মাঝে মধ্যে রসিকতাও করতেন। তাতেও একটা আর্ট ছিল। জ্ঞান ও সৌন্দর্যে ছিল ভরপুর।
সিলেট আলিয়ায় অধ্যয়ন শেষে আবু আহমাদ হিফজুর রহমান প্রায় ২১ বছর ছিলেন আরব আমিরাতের আবুধাবিতে। সেখানে ইমাম ও খতিব হিসেবে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন। আরব জাহান নিয়ে আমার লেখা ‘ধূসর মরুর বুকে’ পড়ে প্রতিক্রিয়া জানাতেন এবং স্মৃতিকাতর হয়ে পড়তেন।
আল্লামা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর খুবই প্রিয়ভাজন ছিলেন তিনি। লন্ডনে এক সময় আল্লামা বিরোধী ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় তার নিরন্তর প্রয়াস আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি তখন সাপ্তাহিক ইউরো বাংলা সম্পাদনা করি এবং দৈনিক ইনকিলাবের লন্ডন প্রতিনিধি। আল্লামা সাঈদীর হাতের লেখা চিঠি দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীনের কাছে পৌছাবার জন্য তিনি আমাকে এনে দিয়েছিলেন।
আল্লামা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমান ও শায়খুল হাদিস আল্লামা হাফেজ তাফাজ্জুল হক মুহাদ্দিসে হবিগঞ্জীকে এক মঞ্চে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে আমার সাথে তিনি এবং বন্ধু আক্তার হোসেন কাওসার অসামান্য ভূমিকা পালন করেছেন।
মাওলানা আবু আহমাদ হিফজুর রহমান ছিলেন শিক্ষা বিস্তারে খুবই নিবেদিতপ্রাণ। তাওহিদী সংস্কৃতির শক্তিগুলো তিনি শনাক্ত করতেন। সততা ও শ্রম দিয়ে ইসলামী আন্দোলনের বাগান সাজাতেন। মানুষের চিন্তার পরিশুদ্ধি ঘটানোই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান।
শায়েখ হিফজুর রহমান সিলেট বিভাগে হবীগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলায় রাইয়াপুর গ্রামে জন্মে ছিলেন ১৯৫২ সনে। বাবা হাফিয সিফাতুর রহমান ছিলেন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। দাদা মাওলানা সায়ফুল্লাহ ছিলেন খ্যাতনামা আলিমে দ্বীন। পারিবারিক ঐতিহ্যের আলোকে অকল্পনীয় আমল ও সততার নীতিকে প্রধান্য দেওয়াই ছিল তাঁর বর্ণাঢ্য জীবণের অন্যতম বৈশিষ্ট।
গত রবিবার (১০ ডিসেম্বর ২০২৩) রাত ১২টায় তিনি ইন্তিকাল করেছেন। ইন্না-লিল্লা-হি ওয়া ইন্না-ইলাইহি রা-জিউ‘ন। মরহুমের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। মহান আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন। আমীন।
* সাঈদ চৌধুরী– সময় সম্পাদক, কবি ও কথাসাহিত্যিক