মুকিমুল আহসান বিবিসি
স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত জাতীয় সংসদের ১২টি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি নির্বাচন বাদে বেশিরভাগ নির্বাচন নিয়েই ছিল নানা প্রশ্ন, যা থেকে বাদ যায়নি বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনও।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার এক বছরের মাথায় ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের নতুন সংবিধান প্রণয়নের পর প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালের সাতই মার্চ।
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগের হাতে তখন দেশের শাসন ক্ষমতা। দেশের সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল দলটি এবং ভোটারদের পছন্দের জায়গায় ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু এই সব ধারণাই পাল্টে দিয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গল্প।
গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ৭৩ সালের প্রথম সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে সরকার গঠন করতো এতে কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু এরপরও সেই নির্বাচনে সারা দেশে ব্যাপক অনিয়ম-কারচুপির ঘটনা ঘটেছিল।
এমনকি, একজন প্রার্থীকে জেতাতে হেলিকপ্টারে করে ব্যালট পেপার ঢাকায় নিয়ে আসার মতো ঘটনাও ঘটেছিল।
গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “স্বাধীনতার পর প্রথম নির্বাচনটি এমনভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে তা কেউ ভাবেনি। যে কারণে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থাহীনতা সেই শুরু থেকেই জন্ম নিয়েছে”।
ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ ১৪টি রাজনৈতিক দল ও হাজারের ওপর স্বতন্ত্র প্রার্থী ভোটে অংশ নেয়, তবে ২৯৩টি আসনে জয় নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ ও বাংলাদেশ জাতীয় লীগের একজন এবং পাঁচটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।
রাজনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনই নয়, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ওপর আওয়ামী লীগ এমনভাবে কর্তৃত্ব স্থাপন করে যে দেশের প্রথম সংসদে কোনো বিরোধী দলই ছিল না।
আলোচিত খন্দকার মোশতাকের ভোট
১৯৭৩ সালের নির্বাচনের সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করা হয় তৎকালীন কুমিল্লা-৯ আসনের নির্বাচনকে। ওই নির্বাচনে কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। তিনি বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পরে ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্ট শেখ মুজিবকে স্বপরিবারে হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ।
লেখক ও বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ, বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচন নিয়ে ‘তেহাত্তরের নির্বাচন’ নামে একটা বইয়ে খন্দকার মোশতাককে জেতাতে আওয়ামী লীগ তখন কী করেছিল তার বিস্তারিত তুলে ধরেছেন।
নির্বাচনের সময়ের পত্রিকাগুলোর খবর ও তথ্য বিশ্লেষণ করে এ নিয়ে তথ্য উপাত্ত তুলে ধরেছেন লেখক মহিউদ্দিন আহমদ।
মি. আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “দাউদকান্দির রশিদ ইঞ্জিনিয়ার খুব জনপ্রিয় নেতা ছিল। অপরদিকে খন্দকার মোশতাকের ইমেজ অতটা ভালো ছিল না। ভোটের দিন খবর আসতে শুরু করলো খন্দকার মোশতাক বিপুল ভোটে হেরে যাচ্ছেন। এই খবর পেয়ে তখন কুমিল্লা থেকে ব্যালট বাক্স ঢাকায় নির্বাচন অফিসে নিয়ে আসা হয়”।
এই লেখকের ভাষ্য, ভোটের দিন এটা যখন স্পষ্ট হতে শুরু করে যে খন্দকার মোশতাক আহমেদ জিতবেন না, তখন ব্যালট পেপার সেখানে গুনতেই দেওয়া হয়নি। সব ব্যালট নিয়ে আসা হয় ঢাকায়।
ভোটের পর নির্বাচন কমিশনের আনুষ্ঠানিক ফলাফলে দেখা যায়, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ৫২ হাজার ৪১৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। আর তার বিপরীতে মি. রশিদের ভোট ছিল ৩৬ হাজার ৬৩০।
কুমিল্লার এই আসনের নির্বাচনটি যে কারণে বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আলোচিত ও সমালোচিত ঘটনা ছিল।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আব্দুল লতিফ মাসুম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “শুধুমাত্র খন্দকার মোশতাককে জেতাতে পুনঃগণনার জন্য ব্যালট পেপার নিয়ে আসা হয়েছিল ঢাকায় এবং পুনঃগণনায় মোশতাক আহমেদ জিতে যান”।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়
নব্বই পরবর্তী বাংলাদেশের নির্বাচনগুলোয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বড় দুটি শক্তি হিসেবে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পরিচিত। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতির হিসাবটা অন্যরকম ছিল। তখন আওয়ামী লীগের কাছাকাছি শক্তিরও কোনো দল ছিল না ভোটের মাঠে। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার সামনে অন্য যে দলগুলো ভোটের অংশ নিয়েছিল তাদের অবস্থানও ততটা শক্তিশালী ছিল না।
লেখক মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, তখনকার বাস্তবতা এমন ছিল যে আওয়ামী লীগের অনায়াসে দুইশো আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠনের বিষয়টি একেবারেই নিশ্চিত ছিল। শেখ মুজিবুর রহমান, তোফায়েল আহমেদের আসনসহ ১১টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পায় আওয়ামী লীগ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, তখন শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত ইমেজ ও আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা এতটাই ছিল যে আওয়ামী লীগের জয়ের ব্যাপারে কারো কোনো সন্দেহ ছিল না।
সেই নির্বাচনে নিজের দেখা একটি অভিজ্ঞতার কথা বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আব্দুল লতিফ মাসুম। তিনি বলছিলেন, এখনকার মতো সে সময় এত জেলা ছিল না। তখন ভোলা জেলা ছিল বাকেরগঞ্জের অধীনে। বাকেরগঞ্জ চার আসনের খুব জনপ্রিয় নেতা ছিলেন বর্তমান বিএনপি নেতা মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদের পিতা আজহার উদ্দিন আহমদ। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আজহার উদ্দিন আহমদ পেয়েছিলেন জাসদের মনোয়ন।
অধ্যাপক মাসুম জানান, পেশায় চিকিৎসক আজহার উদ্দিন বিনা পয়সায় মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিতেন। তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদেরও সদস্য ছিলেন। ওই এলাকায় জাসদ এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে তাকে হারানোর মতো কোনো প্রার্থী ওই অঞ্চলে ছিল না।
“তখন আজহার সাহেবকে হারানোর জন্য তিনটি আসনের বাইরে বাকেরগঞ্জ ৪ আসনেও প্রার্থী হয়েছিলেন শেখ মুজিব। কিন্তু আজহার সাহেব যাতে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পারেন সে কারণে মনোনয়ন দাখিলের দিন হাইজ্যাক করা হয়েছিল আজহার সাহেবকে,” বলছিলেন অধ্যাপক মাসুম।
নির্বাচন কমিশনের ফলাফল তালিকায়ও দেখা গেছে, শেখ মুজিবুর রহমান যে দুইটি আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছিলেন তার একটি বাকেরগঞ্জ-৪ আসন।
গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “আজহার সাহেব মনোনয়নপত্র সাবমিট করতে যাওয়ার সময় ভোলায় তোফায়েল আহমেদের লোকেরা হাইজ্যাক করে তাকে মনোনয়ন সাবমিটই করতে দেয়নি”। তোফায়েল আহমেদ দীর্ঘদিন ধরে গুরুতর অসুস্থতায় চিকিৎসাধীন থাকার কারণে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও দেশের প্রথম নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন সোহরাব হোসেন, তোফায়েল আহমেদ, মোতাহার উদ্দিন, কে এম ওবায়দুর রহমান, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া, মনোরঞ্জন ধর, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও জিল্লুর রহমান।
প্রথম সংসদই ছিল বিরোধী দলবিহীন
সরকার–সমর্থক সংবাদপত্রগুলোতেও পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল, বিরোধী দলগুলো অন্তত ১৫-২০টি আসন পেতে পারে। কিন্তু ফল প্রকাশের পর দেখা গেল ২৯৩টি আসনেই জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ।
এই জয় পেতে নির্বাচনে নানা অনিয়ম কারচুপির আশ্রয় নিতে হয়েছিল বলে জানান গবেষক ও বিশ্লেষকরা। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধী হিসেবে অল্প কিছু পত্রিকা ছিল। তারমধ্যে একটি পত্রিকা ছিল দৈনিক গণকণ্ঠ। সাতই মার্চ ভোটের পরদিন আটই মার্চ দৈনিক গণকণ্ঠের প্রধান শিরোনাম ছিল ‘নির্বাচন প্রহসনে পরিণত’।
পরের দিন নয়ই মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের সংবাদ সম্মেলনের বরাত দিয়ে দৈনিক গণকণ্ঠের প্রধান শিরোনাম ছিল- ‘বাংলাদেশে কোনো বিরোধী দল নেই’।
শেখ মুজিব সেখানে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে কমপক্ষে আইন সভায় ২৫টি আসন না পেলে কোনো সংগঠন বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে না’। তিনি আরো বলেছিলেন, নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগ ছাড়া আর সবাইকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সুতরাং প্রথানুযায়ী, এদেশে কোনো বিরোধী দল আছে বলে তিনি মনে করেন না।
বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচন, অথচ দেশে কোনো বিরোধী দল নেই- এই বিষয়টি সে সময়ই দেশে খুব আলোচনার জন্ম দেয়। নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্নও ওঠে।
লেখক মহিউদ্দিন আহমদ বলছিলেন, ওই নির্বাচনের পরে একটি সংবাদ সম্মেলনে মোজফ্ফর আহমেদের নেতৃত্বাধীন ন্যাপ এর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে ‘সন্ত্রাসী কার্যক্রম করে’ দেশের অন্তত ৭০টি আসনের ফলাফল বদলে দেওয়া হয়েছিল। তবে তার মতে, এই সংখ্যা ৭০ না হলেও দেশের অন্তত ২৫ থেকে ৩০টি আসনে জয় পাওয়ার মতো প্রার্থী ছিল বিভিন্ন দলের। কিন্তু তারা নানা অনিয়মে জিততে পারেনি।
আবুল মনসুর আহমদ ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইয়ে লিখেছেন, “পার্লামেন্টারি পদ্ধতির ভিত্তি স্থাপন মানে বিরোধী দলের যথেষ্ট সংখ্যক ভালো মানুষ নির্বাচিত হবেন, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা। কাজেই নির্বাচনে (১৯৭৩) সরকারি দল আওয়ামী লীগের বিরোধী দলের প্রতি উদার হওয়া উচিত ছিল”।

