এক নারী চিকিৎসকের হিজাব খুলে ফেলাকে কেন্দ্র করে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন ভারতের বিহার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা জনতা দল (ইউনাইটেড)-এর নেতা নীতীশ কুমার। তাকে ‘মানসিকভাবে অস্থির’ বলেও অভিযোগ তুলেছে বিরোধীরা।
এই বিতর্কের সূত্রপাত সোমবার। ওইদিন একটি অনুষ্ঠানে তিনি নবনিযুক্ত ‘আয়ুষ’ (বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি এওয়াইইউএসএইচ) চিকিৎসকের হিজাব টেনে নামান, যার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
হিজাব পরিহিত নবনিযুক্ত ওই চিকিৎসক তার নিয়োগপত্র নিতে এসেছিলেন। ওই সরকারি নিয়োগপত্র নেওয়ার সময় বছর ৭৫-এর মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার তার হিজাব টেনে নামিয়ে ফেলেন। এই ভিডিওটি প্রকাশ্যে আসার পর একদিকে যেমন ঘটনার সমালোচনা শুরু হয়েছে, তেমনই নীতীশ কুমারকে নিশানা করছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো।
প্রসঙ্গত, আয়ুর্বেদ, ইয়োগা, ইউনানি, সিদ্ধা এবং হোমিওপ্যাথি ‘এওয়াইইউএসএইচ’-এর অন্তর্গত। এটি ভারতে ‘আয়ুষ’ নামে পরিচিত।
ভাইরাল হওয়া ওই ভিডিওতে বিহারের উপ-মুখ্যমন্ত্রী সম্রাট চৌধুরীকে নীতীশ কুমারের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। তিনি মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারকে থামানোর চেষ্টা করছেন, তাও দেখা যাচ্ছে। ওই একই ভিডিওতে দেখা গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্যসচিব দীপক কুমার এবং বিহারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মঙ্গল পান্ডে হাসছেন যাকে ঘিরেও বিতর্ক দানা বেঁধেছে।

কী ঘটেছিল?
১২০০-রও বেশি আয়ুষ চিকিৎসকদের নিয়োগপত্র দেওয়ার জন্য একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ে এদের মধ্যে কয়েকজনের হাতে মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার নিয়োগপত্র তুলে দেন।
অনুষ্ঠানের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ পোস্ট করে তিনি লেখেন, “আজ মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ের ‘সংবাদ’-এ ১২৮৩ জন আয়ুষ চিকিৎসককে নিয়োগপত্র প্রদানের জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানে সামিল হয়েছিলাম।”
নীতীশ কুমারের সঙ্গে অন্যান্যরা মঞ্চের ওপরে ছিলেন এবং নবনিযুক্তরা তার হাত থেকে নিয়োগপত্র নিচ্ছিলেন। সেই সময় একজন মুসলমান নারী তার কাছ থেকে নিয়োগপত্র নেওয়ার জন্য এগিয়ে যান।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, ওই চিকিৎসকের হাতে নিয়োগপত্র তুলে দেওয়ার সময় নীতীশ কুমার হঠাৎ বলে ওঠেন, ‘এটি কী?’ এবং কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকে তার হিজাব টেনে নিচে নামিয়ে দেন।
সেই সময় একাধিক মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ যেমন মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারকে থামাতে উদ্যত হন, কেউ ঘটনার আকস্মিকতায় অবাক হয়ে যান। মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্যসচিব এবং বিহারের স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ কাউকে হাসতেও দেখা যায়। এরপরই শুরু হয় বিতর্ক।

বিরোধীরা কী বলছে?
এই ঘটনায় নীতীশ কুমার ও তার দলকে কটাক্ষ করতে ছাড়েনি বিরোধীরা। আসাদুদ্দিন ওয়াইসির দল সর্বভারতীয় মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমীনের (এআইএমআইএম)-পক্ষ থেকে ঘটনার কড়া নিন্দা করে বিবৃতি জারি করা হয়েছে এবং বিহারের মুখ্যমন্ত্রীকে ক্ষমা চাওয়ার কথাও বলা হয়েছে।
এএমআইএম-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, “মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে যদি কোনো নীতিবোধ এবং লজ্জা অবশিষ্ট থেকে থাকে, তাহলে তার অবিলম্বে ক্ষমা চাওয়া উচিত। মুখ্যমন্ত্রী যখন এই ধরনের আচরণ করেন, তখন নারীদের সম্মান এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা কে দেবে?”
“প্রতি মাসে অ্যাকাউন্টে ১০ হাজার টাকা জমার পরিবর্তে কি নারীদের আত্মসম্মানের সওদা করা হচ্ছে? এআইএমআইএম নারীদের সম্মান এবং হিজাব রক্ষার জন্য তাদের সঙ্গে আছে।”
বিহারে প্রতি মাসে নারীদের অ্যাকাউন্টে সরকারের পক্ষ থেকে যে ভাতা দেওয়া হয়, সেই দিকে ইঙ্গিত করেছে আসাদুদ্দিন ওয়াইসির দল।
অন্যদিকে, বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কংগ্রেসও সরব হয়েছে। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে ঘটনার একটি ভিডিও পোস্ট করে লেখা হয়েছে, “ইনি বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। এর নির্লজ্জতা দেখুন। একজন নারী চিকিৎসক যখন তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার (নিয়োগপত্র) নিতে এসেছিলেন, তখন নীতীশ কুমার তার হিজাব টেনে নামিয়েছেন।”
কংগ্রেসের পক্ষ থেকে আরো উল্লেখ করা হয়, “বিহারের সর্বোচ্চ পদে আসীন ব্যক্তি প্রকাশ্যে এমন কাজ করছেন। ভেবে দেখুন, এই রাজ্যে নারীরা কতটুকু নিরাপদ? এই ঘৃণ্য কাজের জন্য নীতীশ কুমারের অবিলম্বে পদত্যাগ করা উচিত। তার এই আচরণ ক্ষমার অযোগ্য।”
বিরোধীদের কেউ কেউ আবার নীতীশ কুমারের মানসিক অবস্থা নিয়ে প্রশ্নও তুলেছে। সেই তালিকায় বিহারের প্রধান বিরোধী দল রাষ্ট্রীয় জনতা দলও (আরজেডি) রয়েছে। আরজেডি একটি পোস্টে লিখেছে, “নীতীশজির কী হয়েছে? তার মানসিক অবস্থা এখন খুব করুণ অবস্থায় পৌঁছেছে…।”
আরজেডি মুখপাত্র এজাজ আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছেন, “নীতীশ কুমারের হিজাব খুলে দেওয়া নারীদের প্রতি জেডিইউ-বিজেপি জোটের মনোভাবকে প্রকাশ করে।”
“একজন মুসলিম নারী যিনি পর্দা ব্যবহার করেন, তার মুখ থেকে হিজাব সরিয়ে তিনি (নীতীশ কুমার) স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে নারীর ক্ষমতায়নের নামে জেডিইউ এবং বিজেপি কী জাতীয় রাজনীতি করছে। কোনো নারীর পর্দা সরিয়ে দেওয়া কিন্তু এক অর্থে, একজনের সংস্কৃতি ও ধর্মীয় স্বাধীনতা অনুযায়ী তার জীবনযাপনের অধিকারকে কেড়ে নেওয়া। এই অধিকার ভারতীয় সংবিধান সকলের জন্য নিশ্চিত করেছে।”
এই ঘটনার প্রসঙ্গে দেওবন্দি আলেম ক্বারী ইসহাক গোরা বার্তাসংস্থা পিটিআইকে বলেছেন, “এটি দেখে শুধু আমার রক্তই নয়, সারা দেশের মানুষের রক্ত ফুটছে।”
“নীতীশ কুমারকে একটি অনুষ্ঠানে এক নারীর হিজাব টানতে দেখা গিয়েছে। একদিকে আপনি নারীর প্রতি সম্মানের কথা বলেন, আর অন্যদিকে একজন নারীকে অপমান করেন। এক্ষেত্রে গোটা দেশের নারীদের কাছে নীতীশ কুমারকে ক্ষমা চাইতে হবে।”
নীতীশ কুমারের দল কী বলছে?
বিরোধীরা ‘অযথা’ রাজনীতি করছে বলে পাল্টা অভিযোগ তুলেছে নীতীশ কুমারের দল, জনতা দল (ইউনাইটেড)।
ইংরেজি সংবাদ মাধ্যম ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’কে জেডি(ইউ)-এর মুখপাত্র নীরজ কুমার বলেছেন, “নীতীশ কুমার বিহারের নারী ও সংখ্যালঘুদের উন্নতির জন্য অনেক কিছু করেছেন।”
নীতীশ কুমারের দলের নেতা এবং সংখ্যালঘু কল্যাণ মন্ত্রী জামা খানের অভিযোগ, বিরোধী দল এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতারা নীতীশ কুমারকে বদনাম করার চেষ্টা করছেন। তার কথায়, “নীতীশজি শুধু একটি মুসলিম মেয়ের প্রতি স্নেহ দেখিয়েছেন। তিনি চেয়েছিলেন, মেয়েটি জীবনে সফল হওয়ার পর তার চেহারা সবাই দেখুক।”
“যারা নীতীশ কুমারের সমালোচনা করছেন তাদের জানা উচিত যে তিনি দেশের কন্যাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছেন। বিরোধী দলের যারা তার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তারা তাদের নিজেদের মানসিকতাকেই প্রকাশ করছেন।”
পাকিস্তানেও ঘটনা নিয়ে আলোচনা
ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাকিস্তানের নাগরিকদের মধ্যেও এই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক আম্মার মাসুদ বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের ওই ভিডিও ক্লিপ শেয়ার করে লিখেছেন, “এটি ভারতে মুসলমানদের প্রতি দুর্ব্যবহারের একটি দুঃখজনক উদাহরণ। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার নিয়োগপত্র দেওয়ার সময় এক নারী চিকিৎসকের পর্দা জোর করে খুলে ফেলেন।”
পাকিস্তানি সাংবাদিক মঈদ পীরজাদাও ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন। এক্স মাধ্যমে একটি পোস্টে তিনি লিখেছেন, “এটি বিভিন্ন স্তরে পুরুষতন্ত্র এবং আধুনিকতার মধ্যে থাকা সাংস্কৃতিক সংঘর্ষকে দর্শায়। যে মুখ্যমন্ত্রী কোনো নারীর মুখ থেকে হিজাব খুলে ফেলেন তিনি তার পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতায় নিরাপদ বোধ করেন।”
“তিনি মনে করেন, তিনি ওই নারীকে তার মুখ দেখাতে এবং তার সাফল্য বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে উৎসাহ দিচ্ছেন! সর্বোপরি, একজন নারী কেন তার পরিচয় গোপন করবেন যখন তিনি পুরষ্কার পাচ্ছেন এবং তার সাফল্য উদযাপন করা হচ্ছে?”
মঈদ পীরজাদা লিখেছেন, “তিনি (নীতীশ কুমার) আধুনিকতার সব নৈতিকতাকে অপমানজনকভাবে চ্যালেঞ্জ করেন, কারণ তিনি একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীকে তার গোপনীয়তা থেকে জোর করে বের করে আনেন।”
“তার পরিচয় প্রকাশ্যে আনেন এবং একজন শিশুর মতো আচরণ করেন। গল্পটা কিন্তু এতটা সহজ নয়! আধুনিকতাও চায় নারীরা যেন মুখ লুকাতে না পারে। যে সমস্ত নারী হিজাব বা পর্দায় মুখ লুকিয়ে রাখেন তাদের পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়নের অসহায় শিকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।”

সাম্প্রতিক সময়ে বিতর্ক
প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক সময়ে, একাধিক জনসভা এবং বিধানসভায় নীতীশ কুমারের আচরণ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন উঠেছে। চলতি বছরের ২১ অগাস্ট, মাদ্রাসার একটি অনুষ্ঠানে টুপি পরতে অস্বীকার করার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল।
প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালে নীতীশ কুমার এনডিএ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর তিনি বিজেপিকে আক্রমণ করে বলেছিলেন যে তিনি তিলকও পরেন, আবার টুপিও পরেন। তার সেই কথা মেনে ইফতার পার্টিতে প্রকাশ্যে টুপিও পরতেন নীতীশ কুমার।
এদিকে, সাম্প্রতিক সময়ে তার আচরণকে ঘিরে বিরোধীরা সরব হয়েছে। কয়েক মাস আগে নীতীশ কুমার এক আইএএস অফিসারের মাথায় একটি ছোট ফুলের পাত্র রেখেছিলেন। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর ৭৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানানোর পরে হঠাৎ হাততালি দিতে শুরু করেছিলেন তিনি।
গত বছর মার্চে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের সময় তাকে তার প্রধান সচিবের সঙ্গে কথা বলতে ও হাসতে দেখা যায়।
গত বছরই নীতীশ কুমার দ্বারভাঙ্গায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পা ছোঁয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এরপর বিরোধীরা বয়সজনিত কারণ দেখিয়ে তার মানসিক স্থিরতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, যেমনটি সোমবারের ওই ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পর ঘটছে। বিবিসি

