আয়নাঘরের চেয়েও ভয়াবহ ৮ গোপন বন্দীশালার সন্ধান পেয়েছে গুম কমিশন

বাংলাদেশ সময় সংবাদ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

গুম সংক্রান্ত কমিশনে এক হাজার ৬শ’র বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। ৫ নভেম্বর, মঙ্গলবার রাজধানীর গুলশানে কমিশনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান গুম সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারির সভাপতি বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী।

কমিশন সভাপতি বলেন, ‘এ পর্যন্ত ৪০০ অভিযোগ খতিয়ে দেখা হয়েছে এবং ইতোমধ্যে ১৪০ জনের সাক্ষাতকার নেয়া হয়েছে।’

সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, আয়নাঘরের চেয়েও ভয়াবহ ৮ গোপন বন্দীশালার সন্ধান পেয়েছে গুম কমিশন। রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় এ আটটি গোপন বন্দীশালার সন্ধান পাওয়া যায়। তবে তদন্তের স্বার্থে আটককেন্দ্রগুলো কারা পরিচালনা করতো সে সম্পর্কে কোনো তথ্য দেয়া হয়নি।

এই বিষয়ে গুম সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারির সদস্য সাজ্জাদ হোসেন বলেন, আয়নাঘরের মতো যতগুলো জায়গায় আমরা গিয়েছি সেখানে বন্দি অবস্থায় কাউকে পাইনি। অনেকগুলো বন্দিশালা ইতিমধ্যে ধ্বংস করা হয়েছে। ভিকটিমের বর্ণনা অনুযায়ী আমরা সেগুলো পেয়েছি। ৪০০ কেসের মধ্যে ১৭২টায় পেয়েছি র‍্যাবের সংশ্লিষ্টতা, সিটিটিসির সংশ্লিষ্টতা পেয়েছি ৩৭টি কেসে, ডিবি পুলিশের ৫৫টি, ডিজিএফআই ২৬টি, পুলিশের ২৫টি কেসে সংশ্লিষ্টতা পেয়েছি। সাদা পোশাকে পরিচয়ের পেয়েছি ৬৮টি কেস।

গোপন বন্দীশালা। ছবিঃ সংগৃহীত

তিনি আরও বলেন, আমরা শুনেছি অনেক জায়গায় বিভিন্ন বাহিনী ‘সেফ হাউস’ আছে। এগুলোর একজাক্ট লোকেশনগুলো কোথায় তা আমাদের সোর্সের মাধ্যমে আমরা জানার চেষ্টা করছি।

কমিশন সভাপতি বিচারপতি মইনুল ইসলাম বলেন, পুলিশ আসামিদের কীভাবে গ্রেফতার করবে, তার বিস্তারিত দিক-নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু সেটা অনুসরণ করা হয়নি। আটকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে নেয়ার কথা থাকলেও মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর আইনের তোয়াক্কা না করে আটকে রাখা হতো।

রাজনৈতিক কারণেই বেশিরভাগ ব্যক্তিদের গুম করা হয়েছে জানিয়ে কমিশন সভাপতি বলেন, তবে রাজনৈতিক কারণ ছাড়া স্বপ্রণোদিত হয়ে অভিযোগের বাইরেও অনেককে গুম করা হয়। এর মধ্যে র‍্যাবের বিরুদ্ধে ১৭২টি, সিটিসির ৩৭টি, ডিবির ৫৫টি, ডিজিএফআই ২৬টি, পুলিশের ২৫টি এবং অন্যান্যভাবে গুমের ৬৮টি ঘটনা। এসব ঘটনা তদন্তে গিয়ে এসব বাহিনীর আটটি গোপন বন্দিশালা পেয়েছে কমিশন, যেখানে বছরের পর বছর গুম হওয়া ব্যক্তিদের রেখে নির্যাতন করা হতো। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ৬শ’র বেশি গুম হওয়া মানুষকে এখনও শনাক্ত করা যায়নি বলেও জানান কমিশন সভাপতি।

গুমের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতজন সদস্য সংশ্লিষ্ট এমন প্রশ্নে কমিশন সভাপতি বলেন, ‘সেই সংখ্যাটা এখনো বলা যাবে না। ৭ তারিখ থেকে বাহিনীর সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হবে। আমরা সমন ইস্যু করে দিয়েছি। প্রথম দিন সাতজনকে ডাকা হয়েছে। তারপর তিনজন, সাতজন, পাঁচজন এভাবে চলতে থাকবে। এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ডিজিএফআই’র সদস্য রয়েছে। প্রাথমিকভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে ডিজিএফআই, র‍্যাব, ডিবি, সিটিটিসি, সিআইডি ও পুলিশের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।’

কমিশন সভাপতি বলেন, ‘আমরা স্বাধীন হয়েছি ৫৩ বছর হলো। কিন্ত দেশে সুশাসন এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি।’

কমিশনের সদস্য নাবিলা ইদ্রিস বলেন, চারটি কারণে অধিকাংশ গুম করা হয়েছে। তার মধ্যে রাজনৈতিক, জঙ্গি সন্দেহে, ব্যবসায়িক ও পারিবারিক কারণেও মানুষ গুম হয়েছেন। গোপন বন্দিশালা এ পর্যন্ত আমরা আটটা আনকাভার করেছি। আমাদের ধারণা ঢাকা শহরের প্রতিটি এলাকায় গোপন বন্দিশালা পাবো। ঢাকার বাইরেও প্রতিটি এলাকা পাওয়া যেতে পারে।

উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুমের ঘটনা তদন্তে হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলামের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিশন গঠন করে সরকার। গত ২৭ আগস্ট কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন—হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী, মানবাধিকারকর্মী নূর খান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাবিলা ইদ্রিস ও মানবাধিকারকর্মী সাজ্জাদ হোসেন।

কমিশন গঠন সম্পর্কে গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশের আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থার (পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, সিআইডি, বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা, আনসার ব্যাটালিয়ন, এনএসআই, ডিজিএফআই, কোস্টগার্ড) কোনো সদস্য দ্বারা গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানে সরকার এই কমিশন গঠন করে।

গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গুমের ঘটনায় ভুক্তভোগী নিজে অথবা পরিবারের কোনো সদস্য বা আত্মীয়স্বজন বা গুমের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী যেকোনো ব্যক্তি অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন। সশরীর কমিশনের কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে, ডাকের মাধ্যমে অথবা কমিশনের ই-মেইলে লিখিতভাবে অভিযোগ করতে পারবেন। সে অনুযায়ী অভিযোগ দাখিল করেন ভিকটিম ও তাদের স্বজনরা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে ৫ আগস্ট দেশ থেকে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে টানা প্রায় ১৬ বছরের শাসনের পতন হয়।

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সংস্কারে উদ্যোগ নেয়। গঠিত হয় বিভিন্ন সংস্কার কমিশন। এরই ধারাবাহিকতায় গুম কমিশন গঠিত হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *