নিরঙ্কুশ স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ ভাষা কণ্ঠে ধারনের সময় নিউরনের প্রতিটি অনুরণন মিলিত হয় ঐকতানে। ইন্টারনেটে প্রথম বাংলা অক্ষরটি টাইপ করার সময় ঠিক এই অনুভূতির সঞ্চার হয়েছিল প্রত্যেক বাংলা ভাষাভাষি মানুষের হৃদয়ে। সেখানে অভ্র শব্দটি যেন ইন্টারনেটের নিঃসীম জগতে এক টুকরো বাংলাদেশের অবিরাম প্রতিধ্বনি। ডিজিটাল বাংলা লেখনীর সেই অভ্র কি-বোর্ড এবং তার নেপথ্যের মানুষদের নিয়েই আজকের প্রযুক্তি কড়চা। চলুন, ঘুরে আসা যাক অভ্র সফ্টওয়্যারের ক্রমবিকাশের মঞ্চ থেকে, জেনে নেওয়া যাক কারিগরদের স্বপ্নগাঁথা।
সাবলীল বাংলা টাইপ ও একটি স্বপ্নের অঙ্কুরিদ্গম
২০০৩ সালের একুশে বইমেলায় বাংলা ইনোভেশন থ্রু ওপেন সোর্স বায়োস নামক স্টলে প্রদর্শনী করা হয়েছিল ‘বাংলা লিনাক্স’-এর। কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেম (ওএস)টির মেনু ও ফাইলের নামসহ সবকিছুই ছিল বাংলাতে। কতক তরুণদের এমন অভাবনীয় উদ্যোগের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিকটি ছিল পুরোপুরি বাংলায় বানানো ওয়েবসাইট।
এসব দেখে আর সব প্রযুক্তিপ্রেমিদের মতো যারপরনাই অবাক হয়েছিলেন মেহেদী হাসান খানও। স্কুল জীবন থেকেই কম্পিউটার নিয়ে তার অগাধ আগ্রহ। বিশেষ করে প্রোগ্রামিংয়ের বিষয়গুলো তার মধ্যে ভীষণ উদ্দীপনা তৈরি করে। এগুলোর উপর তার বেশ দখলও ছিল। তাই বাংলা লিনাক্সের ইউনিবাংলা নামের ফন্টটি যে ইউনিকোড সমর্থিত, তা বুঝতে তার একদম সময় লাগেনি।
বাসায় ফিরে মেহেদী ফন্টটি তার কম্পিউটারে ইন্সটল করে দেখলেন যে, এতে কঠিন যুক্তাক্ষরও লেখা যাচ্ছে। কিন্তু অক্ষরের তালিকা থেকে মাউস দিয়ে ক্লিক করে অক্ষর বসাতে হচ্ছে, যেটি বেশ ঝামেলার। তখনি সহসা মাথায় আসে একটা কি-বোর্ড লে-আউট থাকলে কাজটা অনেক সহজ হয়ে যেতো। ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো ইন্টারনেটে লে-আউটের অনুসন্ধান। কিন্তু কোথাও কিছু পাওয়া গেলো না। সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, এই লে-আউট বানানোর কাজটা তিনিই করবেন।
অভ্র কী-বোর্ডের পথচলা
ঢাকার আইডিয়াল স্কুল এবং নটরডেম কলেজ পাশের পর মেহেদী পড়াশোনা করছিলেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে। এরপরেও তার যথেষ্ট দক্ষতা ছিল তদানিন্তন বহুল প্রচলিত প্রোগ্রামিং ভাষা ভিজ্যুয়াল বেসিক ডটনেট-এ। মেহেদীর উদ্দেশ্য ছিল লিনাক্সের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত উইন্ডোজ ও এস-এও কি-বোর্ড ইন্টারফেসটি কাজ করবে। সে অনুযায়ী পুরোদমে শুরু হয়ে গেলো কোড লেখার কাজ।
অতঃপর ২০০৩ সালের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ-এ প্রকাশিত হলো ইউনিকোড ভিত্তিক বাংলা সফটওয়্যার অভ্রের প্রথম সংস্করণ। এখানে প্রথম লে-আউট হিসেবে সংযুক্ত করা হয়েছিল জনপ্রিয় বিজয় বাংলা কি-বোর্ড। কিন্তু এতে টাইপ করার সময় কোন ‘কী’তে কোন বর্ণ রয়েছে তা মনে রাখতে হতো। বিশেষ করে একদম নতুনদের জন্য এটি ছিলো বেশ বিড়ম্বনার। এই সমস্যা দূর করতে মেহেদী নিজেই বানিয়ে ফেললেন অভ্র ইজি।
সফ্টওয়্যার সহজে এবং বিনামূল্যে ডাউনলোড করার জন্য তৈরি করা হলো পরিপূর্ণ একটি ওয়েবসাইট; নাম ওমিক্রনল্যাব। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল অনলাইন ফোরাম, যেখানে অভ্র নিয়ে চলতো ব্যাপক আলোচনা। ব্যবহারকারীরা অভ্র সম্পর্কে বিভিন্ন কারিগরি প্রশ্ন করতেন এবং বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি পেশ করে প্রয়োজনীয় উন্নয়নের জন্য মতামত দিতেন।
পরবর্তীতে এই অভ্র উন্নয়নের কাজে আরও কিছু প্রোগ্রামার যুক্ত হন। এদের মধ্যে ছিলেন রিফাত উন নবী, তানবিন ইসলাম সিয়াম, রায়ান কামাল, শাবাব মুস্তাফা, নিপন হক, ওমর ওসমান, ও সারিম খান।
সফ্টওয়্যার বিকাশের ধারাবাহিকতায় অভ্রতে যুক্ত হয় ন্যাশনাল, প্রভা, ও মুনীর অপটিমার মতো নতুন নতুন লে-আউট। ফোনেটিক লে-আউট আসার পর আরও সহজ হয়ে ওঠে বাংলা টাইপিং। ইংরেজিতে ‘ami banglay gan gai’ লিখলেই বাংলা বর্ণমালায় রূপান্তরিত হয়ে স্ক্রিনে প্রদর্শিত হতো ‘আমি বাংলায় গান গাই’।
বিনামূল্যের পরিষেবার অমূল্য হয়ে ওঠা
পরিকল্পনা থেকে শুরু করে রিলিজ অতঃপর উত্তরোত্তর বিকাশে অভ্রকে কখনোই বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে দেখা হয়নি। অথচ মেহেদী নিয়মিত সফ্টওয়্যারের রিলিজ লগ লিখতেন, প্রতিবার জুড়ে দিতেন ক্রমিক ভার্সন নম্বর। একই সঙ্গে ব্যবহারকারীদের সুবিধার জন্য লেখা হতো বিশাল বিশাল ইউজার ম্যানুয়াল। সফ্টওয়্যারটি বিনামূল্যে সবার জন্য উন্মুক্ত করা হলেও সেবাটিকে পেশাদার রূপ দিতে তিনি এতটুকু কার্পণ্য করেননি। ওমিক্রনল্যাবের ফোরামের বদৌলতে ব্যবহারকারীদের অনেকেই ভাবতে শুরু করেছিলেন যে, এর পেছনে হয়ত কোনো বিদেশি সফ্টওয়্যার কোম্পানি রয়েছে।
সম্পূর্ণ বিনামূল্যে হওয়ায় অভ্রের নামের সঙ্গে কোনো ধরনের পাইরেসি জড়িয়ে পড়ার অবকাশ ছিল না। পরবর্তীতে ওপেনসোর্স করে দেওয়াতে এটি কপিরাইটের জটিলতা থেকেও মুক্ত ছিল। সুতরাং সর্বাঙ্গীনভাবে একটি আইনসিদ্ধ পেশাদার সফ্টওয়্যারে পরিণত হয়েছিল অভ্র। এর ‘ভাষা হোক উন্মুক্ত’ স্লোগানের মতো এটি আক্ষরিক অর্থেই জনসাধারণের জন্য স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গা তৈরি করেছিল। পরবর্তীতে মেহেদী তার এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেছেন। অথচ ডাক্তারি পড়াশোনার চাপে কখনোই থেমে থাকেনি অভ্রর উন্নয়ন।
বর্তমানে বিশ্বের যে প্রান্তেই বাংলা ভাষাভাষি জনগোষ্ঠির উপস্থিতি বিদ্যমান, সেখানেই রয়েছে অভ্রের পদচারণা। ২ দশকেরও বেশি সময় অতিক্রমের পরে এখনও এটি প্রথম দিনের মতোই বিনামূল্যে ব্যবহার করা যায়।
অভ্র কীবোর্ডের বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে অভ্র একটি ওপেন সোর্স গ্রাফিকাল কি-বোর্ড সফ্টওয়্যার যা মাইক্রোসফ্ট উইন্ডোজ ও লিনাক্স উভয় ওএসের জন্য সমর্থিত। এমনকি অ্যান্ড্রয়েড এবং অ্যাপলের মোবাইল ওএসের জন্য এর রয়েছে ফোনেটিক লেআউট। অভ্র বাংলা ইউনিকোড এবং এএনএসআই (অ্যামেরিকান ন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্টিটিউট) উভয় ধারার সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ।
অভ্র কি-বোর্ড একটি নির্দিষ্ট কি-বোর্ড লেআউট এবং “অভ্র ফোনেটিক” নামে ফোনেটিক লেআউট সমর্থন করে, যা রোমানাইজড ট্রান্সলিটারেশনের মাধ্যমে বাংলা টাইপ করার অনুমতি দেয়। সর্বশেষ হালনাগাদ করা অভ্রের সংস্করণ ৫.৬.০.০, যা ওমিক্রনল্যাব ওয়েবসাইট থেকে যেকোনো প্ল্যাটফর্মের জন্য বিনামূল্যে ডাউনলোড করা যায়।
মেহেদী হাসান খান ও তার দলের অর্জন
অভ্রর নেপথ্যে থাকা মেধাবী দলের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে বাংলা লিখতে পারা কোটি মানুষের ভালবাসা। দেশ ও দেশের সাধারণ মানুষের ভাষার প্রশ্নে তাদের প্রত্যেকে শামিল হয়েছিলেন এক কাতারে। সেখানে ছিল না কোনো বাণিজ্যিক চিন্তা-ভাবনা; শুধু ছিল প্রগাঢ় দেশপ্রেম। এর বাইরেও তাদের অবদান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্নভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ঘরানার বিশ্বখ্যাত ওয়েবসাইট সফ্টপিডিয়া অনুসারে স্পাইওয়্যার, অ্যাডওয়্যার ও ভাইরাস থেকে ১০০ ভাগ মুক্ত সফ্টওয়্যার এই অভ্র। ইন্ডিক ভাষা ইনপুটের জন্য মাইক্রোসফ্টের অনলাইন সমাধান ডিরেক্টরিতে জায়গা করে নিয়েছে অভ্র। ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামের বাংলা কম্পিউটিংয়ের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয় অভ্রকে।
২০১১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বেসিস (বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ সফ্টওয়্যার অ্যান্ড ইনফর্মেশন সার্ভিসেস) অভ্র টিমকে ‘আইটি অ্যাওয়ার্ডে বছরের বিশেষ অবদান’ সম্মাননায় ভূষিত করে। তবে শুরু থেকেই কোনো রকম পুরস্কার গ্রহণে আগ্রহী ছিলেন না প্রচার বিমুখ মেহেদী হাসান। বিশেষ করে চলতি বছর বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদকের জন্য তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিলে। কিন্তু তিনি বরাবরের মতোই অনাগ্রহ প্রকাশ করেন।
পরবর্তীতে তিনি পদক না নিলেও পুরস্কার কমিটি কৃতিত্ব স্বরূপ অনুষ্ঠানে তার নাম প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়। এ অবস্থায় তিনি সশরীরে পদক গ্রহণের জন্য একটি শর্ত জুড়ে দেন। আর সেটি হচ্ছে তার সঙ্গে অভ্রের অন্যান্য প্রধান সদস্যদেরকেও ক্রেডিট দিতে হবে। কেননা অভ্রের বর্তমান অবস্থায় আসার পেছনে তাদেরও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
অতঃপর মেহেদী হাসান খান সহ রিফাত উন নবী, তানবিন ইসলাম সিয়াম, এবং শাবাব মুস্তাফাকে অভ্র সফ্টওয়্যারের জন্য একুশে পদক দেওয়া হয়।
শেষাংশ : অভ্র কী-বোর্ড-এর মাধ্যমে মেহেদী হাসান খান ও তার দল বাংলা টাইপকে সাবলীল করে তুলেছিলেন বাংলাদেশি নেটিজেনদের মাঝে। শুরু থেকেই সম্পূর্ণ বিনামূল্যে হওয়ায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অমূল্য হয়ে উঠেছে সফ্টওয়্যারটি। এই নির্মাণ একই সঙ্গে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনা এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি প্রোগ্রামারের দেশপ্রেমের পরিচায়ক। তাদের এই অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ একুশে পদক সম্মাননা নতুন প্রজন্মের মাঝে দেশাত্ববোধের প্রেরণা যোগাবে। ইউএনবি