ট্রাম্প তথ্যচিত্র সম্পাদনা নিয়ে সমালোচনার মুখে বিবিসির মহাপরিচালক ও বার্তা প্রধানের পদত্যাগ

আন্তর্জাতিক সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

আলেকস ফিলিপস এবং হেলেন বুশবি, বিবিসি কালচারাল রিপোর্টার

বিবিসি প্যানারোমার এক তথ্যচিত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি বক্তব্য ভুলভাবে সম্পাদনার মাধ্যমে দর্শকদের বিভ্রান্ত করা নিয়ে সমালোচনার পর পদত্যাগ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক টিম ডেভি ও বার্তা প্রধান ডেবোরাহ টারনেস।

পাঁচ বছর ধরে এই পদে থাকা মি. ডেভি সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক বিতর্ক ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে পড়েছিলেন।

দ্য টেলিগ্রাফ সোমবার বিবিসির ফাঁস হওয়া একটি অভ্যন্তরীণ মেমো প্রকাশ করেছে, যাতে দেখা যায় প্যানারোমা প্রোগ্রামটিতে মি. ট্রাম্পের বক্তৃতার দুইটি অংশ একত্রে এমনভাবে সম্পাদনা করা হয়েছিলো, যাতে মনে হয় তিনিই ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ক্যাপিটল হিলের দাঙ্গাকে উস্কে দিয়েছিলেন।

যুক্তরাজ্যের রাজনীতিকরা আশা করেছেন যে, এই পদত্যাগের ফলে পরিবর্তনের সূচনা হবে। মি. ট্রাম্পও এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন।

একই দিনে বিবিসির মহাপরিচালক ও হেড অফ বিবিসি নিউজের পদত্যাগের ঘটনা নজিরবিহীন। রবিবার সন্ধ্যায় পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে ডেভি বলেছেন, “অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলাের মতো বিবিসিও নিখুঁত না, কিন্তু আমাদের অবশ্যই সবসময় উন্মুক্ত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হতে হবে”।

“বিবিসি নিউজকে ঘিরে চলমান বিতর্ক আমার এই সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলেছে, কিন্তু পদত্যাগের এটিই একমাত্র কারণ নয়।” “সার্বিকভাবে বিবিসি ভালো করছে, তবে কিছু ভুল হয়েছে এবং মহাপরিচালক হিসেবে আমাকেই এর দায়িত্ব নিতে হবে,” যোগ করেন মি. ডেভি।

ওদিকে, মিজ টারনেস তার বিবৃতিতে বলেছেন প্যানারোমা বিতর্ক “এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এটি বিবিসির ক্ষতি করছে”। তিনি বলেন, “চূড়ান্ত দায়িত্ব আমার”। তিনি বলেন, “পাবলিক লাইফের নেতাদের সম্পূর্ণ জবাবদিহি করতে হয় এবং সেকারণেই আমি পদত্যাগ করছি। যদিও কিছু ভুল হয়েছে কিন্তু আমি এটি পরিষ্কার করতে চাই যে বিবিসি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পক্ষপাতমূলক বলে যে অভিযোগ উঠেছে তা ভুল”।

টারনেস গত তিন বছর ধরে নিউজ অ্যান্ড কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সের প্রধান নির্বাহী হিসেবে কাজ করছিলেন।

এদিকে, টেলিগ্রাফ বিবিসির যে অভ্যন্তরীণ মেমো প্রকাশ করেছে তাও উদ্বেগ তৈরি করেছে যে, বিবিসির আরবি বিভাগে ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধের কাভারেজ নিয়ে পক্ষপাতিত্বের যে ‘পদ্ধতিগত সমস্যা’র কথা বলা হয়েছে তা সমাধানে যথাযথ দৃষ্টি দেয়া হয়নি।

ওয়াশিংটন ডিসিতে ২০২১ সালের ছয়ই জানুয়ারি ট্রাম্প তার বক্তৃতায় বলেছিলেন, “আমরা ক্যাপিটল হিলের দিকে যাবো এবং আমরা আমাদের সাহসী সিনেটর ও কংগ্রেস সদস্যদের উৎসাহ যোগাবো”।

যদিও প্যানারোমায় সম্পাদনার পর তাকে বলতে শোনা গেছে: “আমরা ক্যাপিটল হিলের দিকে যাবো…এবং আমি আপনাদের সাথে থাকবো। আমরা লড়বো। আমরা প্রাণপণ লড়াই করবো”।

যে দুই অংশকে একসাথে জোড়া দেয়া হয়েছিলো, যেগুলো মূলত ৫০ মিনিটের ব্যবধানে ছিলো। ফাঁস হওয়া মেমোর কারণে বিবিসির সমালোচনা শুরু হয়। হোয়াইট হাউজ সংস্থাটিকে “১০০% ভুয়া সংবাদ” বলে বর্ণনা করেছে।

রবিবার বিবিসির প্রধান দুই নির্বাহীর পদত্যাগের প্রতিক্রিয়ায় মি. ট্রাম্প বলেছেন, বিবিসির শীর্ষ ব্যক্তিরা পদত্যাগ করেছেন কিংবা বরখাস্ত হয়েছেন, “কারণ তারা ছয়ই জানুয়ারি আমার দেয়া একটি ভালো বক্তব্য বিকৃত করেছে”।

“এরা খুবই অসৎ মানুষ যারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে,” তিনি লিখেছেন, “গণতন্ত্রের জন্য কতটা ভয়াবহ বিষয়!”

সোমবার বিবিসির চেয়ারম্যান সামির শাহ যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টারি কমিটির সামনে বক্তব্য দেয়ার কথা, যেখানে তিনি বক্তব্যটি যেভাবে সম্পাদনা হয়েছে তা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

তার আগে ওই দুজনের পদত্যাগ করলেন। পদত্যাগের বিষয়ে মি. শাহ বলেছেন, “এটা বিবিসির জন্য একটি দুঃখের দিন এবং ডেভির প্রতি তার মেয়াদে আমার ও বোর্ডের পূর্ণ সমর্থন ছিল।”

তিনি বলেন, “যদিও আমি তার ওপর থাকা ব্যক্তিগত ও পেশাগত ক্রমবর্ধমান চাপের বিষয়টি বুঝতে পারছিলাম, যা তাকে আজ এই সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে গেছে। পুরো বোর্ড এ সিদ্ধান্তকে এবং এই সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণকে সম্মান করে।”

ফাঁস হওয়া মেমোটি লিখেছেন মাইকেল প্রেসকট। তিনি সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানটির এডিটরিয়াল স্ট্যান্ডার্ড কমিটির সাবেক একজন স্বাধীন এক্সটারনাল এডভাইজর ছিলেন। গত জুনে তিনি এই পদ ছেড়ে গিয়েছিলেন।

মেমোতে তিনি বিবিসির ট্রান্স বিষয়ক কাভারেজ নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তার মতে, এর কাভারেজ প্রো-ট্রান্স এজেন্ডাকে প্রোমোট করে এমন বিশেষজ্ঞ এলজিবিটি রিপোর্টারদের দিয়ে ‘সেন্সর’ করা হয়েছিলো।

তার ফাঁস করা মেমো বলছে যে, এসব ইস্যু যখন সামনে আসে তখন বিবিসি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেননি যাতে তিনি হতাশা বোধ করেছিলেন।

এদিকে, চলতি বছরের শুরুতে বিবিসি নিউজ চ্যানেলে প্রেজেন্টার মার্টিন ক্রোক্সাল লাইভ সংবাদ পাঠের সময় যেভাবে স্ক্রিপ্ট পরিবর্তন করেছিলেন, তা নিয়ে ওঠা ২০টি পক্ষপাতের অভিযোগ বিবিসি মেনে নিয়েছে। ওই স্ক্রিপ্টে ‘গর্ভবতীদের’ কথা উল্লেখ ছিল।

এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে গাজা বিষয়ে করা একটি তথ্যচিত্রে হামাস কর্মকর্তার ছেলের বিষয়টি প্রকাশ না করে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিলো বিবিসি।

কিছু মিডিয়া বিশ্লেষক সাম্প্রতিক বিতর্কগুলো বিবিসি যেভাবে মোকাবেলা করেছে তার সমালোচনা করেছেন। বিবিসি টিভি নিউজের সাবেক প্রধান রজার মোসি বলেছেন সবশেষ অভিযোগগুলোর বিষয়ে বিবিসি ধীরগতিতে পদক্ষেপ নিয়েছে।

বিবিসি বোর্ড এর চার্টারের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক নিয়োগ করে থাকে। ডেভি ২০২০ সালে লর্ড হল এর স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। তার আগে তিনি বিবিসি স্টুডিওর প্রধান ছিলেন। তারও আগে তিনি পেপসি অ্যান্ড প্রোক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বলের মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ ছিলেন।

ওদিকে টারনেস এর আগে সংবাদ সংস্থা আইটিএন ও এনবিসি নিউজ ইন্টারন্যাশনালে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এখন যারাই ডেভি ও টারনেস এর জায়গায় আসুন না কেন তাদের ধারাবাহিকভাবে সমালোচনামূলক সংবাদের মোকাবেলা করতে হবে।

মোসি বলেছেন বিবিসির মহাপরিচালককে ‘সু্পারহিউম্যান’ হতে হয় এবং তিনি প্রতিষ্ঠানটির কর্পোরেট ও সম্পাদকীয় দায়িত্ব আলাদা করার প্রয়োজনটি বিবেচনা করা উচিত কি-না সেই প্রশ্নও তুলেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *