রাজনীতির মাঠে, সভা, সেমিনারে, বক্তৃতা মঞ্চে এবং গণমাধ্যমে কথা বলা এক নয়। একজন মানুষ যখন স্বাভাবিকভাবে কথা বলে তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সে কোনটি ভুল কিংবা কোনটি শুদ্ধ সেটি নিয়ে ভাবেনা। কিন্তু যখনই ‘In front of the Camera’ হয় তখন তার মস্তিষ্ক তাকে ‘খুব সতর্ক’ করে দেয়। তাকে সিগন্যাল দিতে থাকে, তুমি যা বলছো তা সঠিক তো? তোমার কাছে এর যথেষ্ট তথ্য, প্রমাণ আছেতো? ক্যামেরার সামনে কিন্তু মোটেও ভুল করা যাবেনা। কারণ, এটি Live বা As Live রেকর্ড হচ্ছে। ভুল তথ্য, তথ্যের বিকৃতি বা মিথ্যা, মনগড়া তথ্য তাকে, তার দল-গোষ্ঠী কিংবা জাতিকে চরম বিপদে ফেলে দিতে পারে।
তাই মানুষ যখনই ‘খুব সতর্ক’ হয়ে উঠে তখন সে Professional & Practicing না হলে বিরাট বিপদ হয়। মূলত ব্যক্তি কি বলবে, কতটুকু বলবে, কেন বলবে, কোনটা সুকৌশলে এড়িয়ে যাবে, কোন কথায় Defence নেবে, কোন কথায় মার্জিত অথচ শক্তভাবে Attack করবে তার যদি Proper research, work & planning না থাকে তাহলে তার একটি ‘শব্দ’ কিংবা ‘বাক্য’ দ্বারা বিশাল বিতর্ক ও বিপদ হওয়ার সম্ভাবনা ‘শতভাগ’ থাকে। সাধারণত Political Talk Show গুলোতে অন্য পক্ষ হতে সুকৌশলে নানামুখী ও স্পর্শকাতর Attack হয়ে থাকে। এটাই গণমাধ্যমের স্টাইল।
জামায়াতের একজন নেতা ও এমপি প্রার্থী দেশ টিভির একটি টক শোতে বলেছেন, ‘জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীরা নারীদের সামনে নাচবে, কোন সমস্যা নেই।’
উনি নির্বাচন সংক্রান্ত ক্যাম্পেইনের কিছু বিষয়ে আমার সাথে মিটিং করেছিলেন। তখন জানতে পারি, তিনি মিডিয়াতে কথা বলতে বেশ আগ্রহী। এবং নানান সময়ে টুকটাক টকশোতেও কথা বলেন। একজন এমপি প্রার্থী হিসেবে দূরদর্শিতা, প্রজ্ঞা, রিসার্চ, স্টাডি ও স্ট্রাট্যাজিক প্ল্যানিং এর বিষয়ে তার যে আগ্রহ তা আমার ভালো লেগেছে; যা একজন জনপ্রতিনিধির জন্য খুবই জরুরি। তার মতো অসংখ্য জামায়াত-শিবিরের জনশক্তি ক্ষমতায় যাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী হয়ে উঠেছে। এমন একটি আদর্শিক দল হিসেবে তাদের কোনভাবেই অন্যদলের মতো স্থুল বা লাগামহীন বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ নেই। কারন, সুদূরপ্রসারী Impact নিয়ে যখন Proper Research, Policy & Strategic Planning থাকবে তখন স্থুল বা লাগামহীন, সস্তা ও বিতর্ক সৃষ্টি করে এমন কথা কখনোই বলা যাবেনা।

সাম্প্রতিক সময়ে আরও একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে- জামায়াত মনোনিত এমপি প্রার্থী মুফতি আমির হামজা বলেছেন, তিনি নাকি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গিয়ে দেখেছেন, সেখানের ছাত্ররা আবাসিক হলে সকালবেলা মদ দিয়ে কুলি করে। তাই তিনি জাহাঙ্গীরনগরে ভর্তি হন নাই। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতির মাধ্যমে বলেছে, এই নামে জাহাঙ্গীরনগরে ঐ সময়ে ঐ ডিপার্টমেন্টে কেউ চান্সই পায় নাই। যা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এতে সম্মানহানী ঐ ব্যক্তির হলেও বৃহত্তরভাবে ক্ষতি হয়েছে মূলত জামায়াতের।
জামায়াত কিংবা বিএনপি যদি কোন ব্যক্তির মঞ্চের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে বা কারো পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে কাউকে এমপি বানাতে চায়, তাহলে সব ক্ষেত্রে তা যথার্থ বিবেচিত নাও হতে পারে। এই ক্ষেত্রে ইন্টেলেকচুয়াল পিপলদের গুরুত্ব দিয়ে আধুনিক যুগ-জিজ্ঞাসার সমাধান গ্রহণ করা উচিত বলে আমি মনে করি।
এছাড়াও নানান সময়ে বিভিন্ন অসংলগ্ন ও বিতর্কিত মন্তব্য করতে শোনা যায় বিএনপির নেতা-কর্মীদেরও। যেমন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বিএনপি চলে।’
অকাট্য প্রমান না থাকলে এই ধরনের কথাবার্তা বা উষ্কানিমূলক বক্তব্য একজন নেতা বা পরিচিত মুখের কোনভাবেই বলা উচিত নয়। এতে বিভেদ সৃষ্টি হয়।
এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু গত ২০ মে, ২০২৫ ইং রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক দলের উদ্যোগে ‘প্রতিহিংসার রাজনীতি গণতন্ত্র সুশাসন: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বলেন, ‘বিএনপি নেতারা যদি একত্রে প্রস্রাব করেন, তাহলে এই প্রস্রাবের তোড়ে ভেসে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়বা। এমন কোনো কথা বলবা না, যে কথার দায়িত্ব নিতে পারবা না। বিএনপির সম্পর্কে যে অভিযোগ করছো, সেই অভিযোগের জবাবে বিএনপি যদি শুধু থুথু ফেলে, সেই থুথুর মধ্যে তোমাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।’ তার এমন বক্তব্য গণমাধ্যমে বেশ আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্কের জন্ম দেয়।
পরবর্তীতে এমন অসংলগ্ন বক্তব্যের দায়ে দুদুকে সতর্ক করে নোটিশ দিয়েছে বিএনপি। পাশাপাশি অসংলগ্ন মন্তব্যের জেরে আরেক কেন্দ্রীয় নেতা বরকতউল্লা বুলুকেও নোটিশ দেয় দলটি।
On Camera বা Off Camera, গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, আলোচনা সভা কিংবা ঘরোয়া কোন আড্ডায় যেখানেই হোক না কেন, কোন প্রথিতযশা রাজনীতিবিদের পক্ষে কখনো, কোন অবস্থাতেই এমন কোন বিতর্কিত, অসংলগ্ন বক্তব্য কিংবা মন্তব্য প্রদান করা উচিত নয়, যা পরবর্তীতে তাকে বা তার দলকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
গণমাধ্যমকে ফেইস করা খুবই সহজ, আবার খুবই কঠিন। আমরা ভাবি খুব ভালো মানুষ, দক্ষ, দেশপ্রেমিক, পরহেজগার, ভালো বক্তা, ভালো ওয়াজ করতে পারলে, ভালো বিতার্কিক, পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক হলেই গণমাধ্যমকে হ্যান্ডেল করা বা ‘পাবলিক স্পিকিং’ করা সহজ। বিষয়টি মোটেই এমন নয়। এটি পুরোটাই ডিপেন্ড করে ‘On Camera’ বা ‘Live’ অথবা ‘Public Speaking’ এ সে কতোটা Experienced.
আমার দীর্ঘ Experience থেকে বলছি, একটি কথা সবসময় মাথায় রাখতে হবে সেটি হচ্ছে, গণমাধ্যমে যারা Host করেন বা যারা টকশোতে উপস্থাপনা করেন তাদেরকে সবসময় Backend থেকে একটি Powerful Research Team নানান তথ্য, উপাত্ত দিয়ে সহায়তা করে থাকেন। যার ফলে উপস্থাপক সকল বিষয়ে ইনফরমেশন পেয়ে তার টক শোয়ের গেস্টকে প্রশ্নের পর পর এবং সুকৌশলে Attack করতে থাকেন। যা তাৎক্ষণিকভাবে যে কোন টক শোকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যেতে পারে। প্রায়শই আমরা এমন অনেক ‘ভাইরাল’ টক শোয়ের ভিডিও ক্লিপ দেখি।
আমার মিডিয়া ক্যারিয়ারের এক পর্যায়ে আমি অনুভব করি Expertise Area তে যথেষ্ট পরিমানে Study, Research, Knowledge না থাকলে গণমাধ্যমে কথা বলা ঠিক নয়। এতে নিজের ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই বিভিন্ন দল ও সংগঠনের মধ্য হতে যারাই গণমাধ্যমের অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা, সেমিনার, বিতর্ক অনুষ্ঠানলোতে ভালো করেন তারা প্রচুর Study করেই যায়। অনেক ক্ষেত্রে তাদের Supporting Team এসকল Research & Study তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যার ফলশ্রুতিতে তারা ঘন্টার পর ঘন্টা যে কোন টপিক নিয়ে আলোচনা করতে পারে।
Talk Show বা ক্যামেরার সামনে কথা বলা এক বিশাল ‘পারফর্মিং আর্ট’। শব্দ চয়ন, বাক্য গঠন, ইনফরমেশন, যুক্তি, Sentence Throwing এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং, হুট করে মিডিয়ায় এসে কথা বলার আগে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। প্রয়োজনে নিয়মিত প্র্যাকটিস করতে হবে। ট্রেনিং নিতে হবে। So-called ব্যাকডেইটেড সিসটেমে চললে এগুনো সম্ভব হবেনা। তা না হলে অসংলগ্ন শব্দ চয়ন বা বাক্যের কারনে ব্যক্তি কিংবা দল বিতর্কিত হবে বহুগুণে…..
(গঠনমূলক এই সমালোচনা ও দিকনির্দেশনামূলক লেখা কোন ব্যক্তি, দল বা সংগঠনকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে লেখা নয়।)
© ফাহিম ফয়সাল
▫️ About: https://fahimfaisalofficial.com/profile-of-fahim-faisal
সংগীতশিল্পী, মিডিয়া ও আইটি প্রফেশনাল, মাল্টিমিডিয়া স্পেশালিস্ট, মিডিয়া গবেষক, কপিরাইট ও ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি গবেষক-বিশ্লেষক-পরামর্শক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, পলিসি মেকার ও পলিটিক্যাল অবজারভার-অ্যানালিস্ট-ফিলোসোফার।

