প্রবাসী ভোটার নিবন্ধন বিষয়ে লন্ডন প্রবাসীদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনারের মতবিনিময়

প্রবাসী বাংলাদেশ যুক্তরাজ্য সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

সাঈদ চৌধুরী

যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশি ও লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের সাথে আয়োজিত অনলাইন মতবিনিময় সভায় নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেছেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই প্রবাসী ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করা হবে।

আজ বুধবার নির্বাচন ভবনে ‘আউট অব কান্ট্রি ভোটিং (ওসিভি)’ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) কর্তৃক মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ ও জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এ এস এম হুমায়ুন কবীর। লন্ডন থেকে অনলাইনে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার আবিদা ইসলাম।

মতবিনিময় অনুষ্ঠানে বিভিন্ন পেশার প্রায় ৩০জন প্রবাসী অংশ নেন। তাদের মধ্যে ছিলেন যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালেক, সাধারণ সম্পাদক কয়সর আহমেদ, জামায়াতের অল ইউরোপিয়ান মুখপাত্র আবু বকর মোল্লা, প্রবাসী ভোটাধিকার বাস্তবায়ন পরিষদ ইউকের কনভেনর জজ বেলায়েত হোসেন, এনসিপি ডায়াস্পোরা ইউনিটের যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি নুরুল হুদা জুনায়েদ, সদস্য মাকসুদুল হক শাকুর, সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দিন আহমদের উপদেষ্টা মোখলেছুর রহমান চৌধুরী, সাংবাদিক রহমত আলী প্রমুখ।

প্রবাসী ভোটাধিকার বাস্তবায়ন পরিষদের পক্ষ থেকে অনলাইনে অংশনেন সিনিয়র যুগ্ম কনভেনর ব‍্যারিস্টার নাজির আহমদ, সদস্য সচিব ব্যারিস্টার বদরে আলম দিদার, যুগ্ন কনভেনর যথাক্রমে সমাজসেবক সিরাজুল ইসলাম শাহীন, ব্যারিস্টার সাইফুদ্দিন খালেদ, সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমান, সিনিয়র সদস‍্য ব্যারিস্টার ইকবাল হোসেন, ব‍্যারিস্টার খালেদ নূর, সলিসিটর আব্দুল হালিম সরকার, আইনজীবী জুবের আহমদ আহাদ প্রমুখ।

মতবিনিময় সভায় নির্বাচন কমিশনার সানাউল্লাহ বলেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ভোট দিতে চাইলে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বাধ্যতামূলক নয়। ভোটার তালিকায় নাম থাকলেই তারা ভোট দিতে পারবেন। ২০০৮ সাল থেকে ছবিসহ ভোটার তালিকা চালু রয়েছে। যারা তালিকায় নাম নিবন্ধন করেছেন, তারা ভোট দিতে পারবেন এবং তাদের আলাদা এনআইডি থাকার প্রয়োজন নেই।

তিনি আরো বলেন, প্রবাসীদের জন্য দু’টি নিবন্ধন প্রক্রিয়া রয়েছে। প্রথমত ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া, দ্বিতীয়ত প্রবাস থেকে ভোট দেওয়ার জন্য আলাদা নিবন্ধন করা। যাদের হাতে স্মার্ট এনআইডি, ১০ বা ১৩/১৭ ডিজিটের লেমিনেটেড এনআইডি রয়েছে এবং যারা দেশের ঠিকানায় ভোটার তালিকাভুক্ত হয়েছেন, তারা বিদেশ থেকেও ভোট দিতে পারবেন। এ জন্য তাদের আলাদা রেজিস্ট্রেশন অ্যাপ ব্যবহার করতে হবে।

নির্বাচন কমিশনার জানান, ‘আউট অব কান্ট্রি ভোটিং রেজিস্ট্রেশন’ অ্যাপটি তৈরি হচ্ছে এবং এটি আগামী নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে উদ্বোধন করা হবে। বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে প্রবাসীরা এই অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন করতে পারবেন। সাধারণভাবে প্রতিটি অঞ্চলের জন্য ৭ থেকে ১০ দিন সময় দেওয়া হবে এবং পরে আরও ৩ থেকে ৭ দিন অতিরিক্ত সময় রাখার পরিকল্পনা রয়েছে, যাতে কোনো ভোটার বাদ না পড়ে।

সানাউল্লাহ বলেন, এবার প্রবাসী ভোটার নিবন্ধনে কোনো চার্জ নেওয়া হবে না। যদিও প্রতিটি ভোট কাস্ট করতে নির্বাচন কমিশনের প্রায় ৭০০ টাকা খরচ হবে। এর মধ্যে ৫০০ টাকা ব্যয় হবে প্রবাসে পরিবহন খাতে এবং বাকি ২০০ টাকা অন্যান্য খাতে। এটি একটি যৌক্তিক ব্যয় বলেই কমিশন মনে করছে।
তবে বিদেশ থেকে ভোটগ্রহণে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর থেকেই প্রবাসীরা ভোট দিতে পারবেন। এক্ষেত্রে কোনো আসনে আদালতের আদেশে শেষ মুহূর্তে প্রার্থী তালিকা পরিবর্তন হলে, সেই আসনে বিদেশ থেকে সংগৃহীত ভোট বাতিল হয়ে যাবে।

গ্লোবাল অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, অতীতে দেখা গেছে প্রবাসী ভোটের হার খুবই কম। বিশ্বব্যাপী মাত্র ২ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবাসী নিবন্ধন করে থাকেন এবং তাদের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ ভোট কাস্ট হয়। ভারতে প্রায় ৪ কোটি প্রবাসী ভোটারের মধ্যে মাত্র ১ লাখ ১৯ হাজার নিবন্ধিত হয়েছিলেন এবং ভোট দিয়েছিলেন মাত্র ২ হাজার ৯০০ জন। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাতেও এ ব্যবস্থা এখনও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা যায়নি। তারা এখনও ট্রায়াল ফেজে রয়েছে।

এনআইডি সেবা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০২৩ সাল থেকে প্রবাসে এনআইডি সেবা চালু করা হয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের লন্ডন, ম্যানচেস্টার ও বার্মিংহামে এনআইডি অফিস রয়েছে। ইউরোপে রোম ও মিলানে দু’টি অফিস চালু রয়েছে। এছাড়া সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, মালয়েশিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং খুব শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রে এ সেবা চালু হবে। এনআইডি সেবা মানেই মূলত ভোটার নিবন্ধন, পাশাপাশি এনআইডি সংগ্রহ ও সংশোধন সেবাও দেওয়া হচ্ছে।

মতবিনিময় সভায় যুক্তরাজ্য ও আয়ারল্যান্ডের প্রবাসীরা এনআইডি ও ভোটার নিবন্ধন সেবা আরও সহজ ও দ্রুত করার দাবি জানান। প্রবাসীদের জন্য সেবা সহজ করার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনার বলেন, আমরা ক্রমাগতভাবে এনআইডি ও ভোটার নিবন্ধন সেবাকে আরও সহজ করার চেষ্টা করছি। তবে দেশের বাস্তবতায় নিরাপত্তা ও নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করতে কিছু কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতেই হচ্ছে।

মো. সানাউল্লাহ বলেন, কমিশনের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ভোটার তালিকা হালনাগাদ ও বাদ পড়া ভোটারদের যুক্ত করার কাজ চলছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৪৫ হাজার নতুন ভোটার তালিকায় যুক্ত হয়েছেন। তিনি জানান, ভোটার তালিকায় নাম রেজিস্ট্রেশনের জন্য জন্মনিবন্ধন অথবা পিতা-মাতার এনআইডি প্রয়োজন। পিতা-মাতা মৃত হলে তাদের মৃত্যু সনদ দিয়েও নিবন্ধন সম্ভব।

সভায় বিএনপি নেতা এম এ মালেক প্রশ্ন করেন, নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা ভোট দিতে পারবেন কি না। কমিশনার সানাউল্লাহ বলেন, দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হতে পারে, তবে সমর্থকরা ভোট দিতে পারবেন।

জামায়াতে ইসলামীর ইউরোপ শাখার মুখপাত্র ব্যারিস্টার আবু বকর মোল্লা জুলাই আন্দোলনে প্রবাসীদের অবদান উল্লেখ করে দ্রুততম সময়ে তাদের ভোটাধিকার ব্যবস্থা করা উচিত বলে দাবি করেন। তিনি প্রস্তাব দেন, প্রবাসীরা যেন একদিনের মধ্যে হাইকমিশন বা দূতাবাসে গিয়ে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করতে পারেন। প্রবাসীদের জন্য দেশের মত জটিল প্রক্রিয়া অবলম্বন না করে বিদেশের বাস্তবতায় সহজ প্রক্রিয়া অবলম্বনের আহবান জানান।

প্রবাসী ভোটাধিকার বাস্তবায়ন পরিষদ ইউকের কনভেনর বেলায়েত হোসেন বলেন, ভোট দেওয়ার জন্য শুধুমাত্র এনআইডি প্রয়োজন হলে অনেক প্রবাসী ভোটে অংশ নিতে পারবেন না। তিনি প্রস্তাব দেন, ভোটারদের জন্য এনআইডি, পাসপোর্ট বা জন্মনিবন্ধন যে কোনো একটি বা দুটি থাকলেই যথেষ্ট।
এছাড়া যুক্তরাজ্যের হাইকমিশন বা সহকারী হাইকমিশনে সশরীরে ভোটদানের বিষয়টি বিবেচনার সুপারিশ করেন।

কমিশনার সানাউল্লাহ জানান, প্রবাসীদের অর্ধেকের বেশি মধ্যপ্রাচ্যে বসবাস করেন, যেখানে সশরীরে ভোট দেওয়া সম্ভব নয়। তাই সকলের জন্য একই প্রক্রিয়া বজায় রাখা জরুরি। তিনি আশ্বস্ত করেন, ভোটার তালিকায় নাম থাকলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে এনআইডি পাওয়া যাবে এবং ভোট দেওয়ার জন্য আলাদা এনআইডি প্রয়োজন নেই।

কমিশনার বলেন, পোস্টাল ব্যালট ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো গোপনীয়তা রক্ষা। তবে এটি প্রবাসীদের ভোটদানের জন্য সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। তিনি সকলকে দায়িত্বশীল থাকার আহ্বান জানান, যাতে প্রক্রিয়াটি বিতর্কিত না হয়। তিনি আরও জানান, ভোট প্রদানের জন্য যারা নিবন্ধন করবেন, তাদের সকলকে ভোট দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হবে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে প্রথমবার প্রবাসী বাংলাদেশিরা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে প্রবাসী ব্রিটিশ ও আইরিশ বাংলাদেশিদের ভোটার তালিকায় নিবন্ধনের জন্য উৎসাহিত করা এবং যে কোনো প্রশ্ন থাকলে হাইকমিশনের সঙ্গে যোগাযোগের আহ্বান জানানো হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *