কতটুকু মুক্ত হলো সিরিয়া?

প্রবন্ধ-কলাম মধ্যপ্রাচ্য সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

আবু সালেহ ইয়াহইয়া

সন্দেহ নেই, শাম তথা সিরিয়ার কসাইখ্যাত বাশার আল আসাদের পতনে মুসলিম বিশ্ব আজ খুশি। স্বৈরাচারদের জন্য সাধারণত এভাবে পালিয়ে যাওয়া অথবা জনরোষে নিহত হয়ে অপমানকর মৃত্যুই হয় শেষ পরিণতি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাশারের পতনের মধ্য দিয়ে সিরিয়ার মুক্তিকামী মজলুম মানুষের মুক্তি হলো কিনা, আর হলেও তা কতটুকু স্থায়ী হতে পারে তার জন্য সম্ভবত আরও অপেক্ষা করতে হবে।

জুলুমের অবসান, মজলুমের মুক্তি এবং জালিমের পতন আমরা সবাই চাই। আপাতদৃষ্টিতে সিরিয়াতে তাই হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু ভবিষ্যত নিয়ে বাস্তবসম্মত যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, বাশারের পতন কেবল আরেকটি স্বৈরাচারের পতনই নয়, বরং একই সাথে পরাশক্তি রাশিয়া ও আঞ্চলিক শক্তি ইরানেরও পতন। দীর্ঘদিন সিরিয়ার এ প্রক্সি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বিশ্বের তাবৎ পরাশক্তিগুলো। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইজরাঈল ও তাদের মিত্ররা। অন্যদিকে রাশিয়া, ইরান ও বাশার পক্ষ। আরেক দিকে তুরস্ক ও বাশার-বিরোধী পক্ষ। এর বাইরেও আরও পক্ষ রয়েছে।

ফলে আপাতদৃষ্টিতে রাশিয়া, ইরান ও বাশারপক্ষের পতন আমরা দেখতে পাচ্ছি। সে হিসেবে তুরস্ক ও বাশার-বিরোধী বিজয়ী পক্ষই সবচেয়ে খুশি হওয়ার কথা। বাস্তবে তারা খুশিও। একে একে বন্দিরা ভয়ংকর সব কারাগার থেকে মুক্ত হচ্ছেন। অনেকেই নিজ বাড়ি কিংবা বসত-ভিটায় ফিরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে তুরস্কে আশ্রয় নেয়া ৩০ লাখেরও বেশি সিরিয়ানদের একটা অংশ হয়তো সিরিয়ায় প্রত্যাবর্তন করতে পারেন।

কিন্তু সিরিয়াকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্যবাদীদের ঐ অঞ্চলের দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের কি পরিসমাপ্তি হলো? আমার কাছে এখনো তা মনে হচ্ছে না। এমনটি মনে না হবার অন্য একটি কারণ হলো, বাশারের পতনে তুরস্ক ও বাশার-বিরোধী পক্ষের চেয়েও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইজরাঈল ও পশিচমা ব্লককে বেশি খুশি হতে দেখা। ইতোমধ্যে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য দামেস্ক দখলকারী গ্রুপটিকে সন্ত্রাসী তালিকা থেকে বাদ দেয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছে। এটা কি মুসলিম এই গ্রুপটির দাবির মুখে তারা করছে? নাকি কোন পূর্বশর্তের অংশ হিসেবে? কোন পুর্বশর্তের অংশ হিসেবে হলে অজানা বাকী শর্তগুলো কি কি? যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যেখানে বিশ্বের যে কোন দেশে মুসলিম কোন দলের উত্থানকে ভাল চোখে দেখে না, সেখানে সিরিয়াতে হওয়া এই উত্থানকে তারা এত সেলিব্রেট করছে কেন? যা সাধারণত তাদের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রের সাথে যায় না। মিশর ও তিউনিসিয়ায় তারা কি করেছে তা গোটা বিশ্ব দেখেছে। তাছাড়া আফগানিস্তানে দীর্ঘ দুই দশক তাদের লড়তে দেখেছে বিশ্ব।

এদিকে, যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড্যাভিড ল্যামি আজ সংসদে এক বক্তব্যে উচ্চসিত হয়ে বলেছেন, “বাশার আল আসাদকে অনেকেই ‘দামেস্কের সিংহ’ বলত। এখন দেখি, সে ‘দামেস্কের ঈদুরে’র মত লেজ গুটিয়ে মস্কোতে পালিয়েছে।” বুঝতে পারছেন তাদের খুশির মাত্রা?

এদিকে বিভিন্ন মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী ইজরাঈল গত কয়েক দিনে ২৫০-৩১০ বারের বেশি সিরিয়াতে হামলা করেছে। তাদের টার্গেট সিরিয়ার মিলিটারি স্থাপনা ও সরকারি পাবলিক সার্ভিসে নিয়োজিত অবকাঠামোগুলো। সব ধবংস করে দিচ্ছে। গোলান মালভুমির আরও কিছু অংশ দখল করে নিয়েছে। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কিংবা দামেস্ক দখলকারী বিজয়ী গ্রুপ কেউ এদের থামতে বলছে না। এদিকে তাদের বাঁধা দেয়ারও যেন এখন আর কেউ নেই। যুদ্ধ-বিধবস্ত সিরিয়া যাতে কোনভাবে দাড়াতে না পারে, সম্পুর্ণ বিনা বাঁধায় অবকাঠামো ধবংস করে তা যেন নিশ্চিত করছে ইজরাঈল।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও পশ্চিমা দেশগুলোর এই সেলিব্রেশন সিরিয়া থেকে শুধু রাশিয়া ও ইরানের বিদায়ের জন্য নাকি এর পেছনে রয়েছে আরও বড় কোন পরিকল্পনা? সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথ সুগম হওয়ার কোন আগাম ইঙ্গিত কি রয়েছে এই উচ্চসিত সেলিব্রেশনে? অন্যদিকে রাশিয়া কিংবা ইরান কি এ পরাজয় মেনে নিয়ে চুপ থাকবে?

তুরস্কের জন্য পশ্চিমের পালিত বিষফোঁড়া হচ্ছে তুরস্ক-সিরিয়া সিমান্তে গড়ে উঠা শক্তিশালী কুর্দিশ গ্রুপ। যারা তুরস্কের ভেতরের কুর্দিশ গ্রুপের সাথে মিলে আলাদা রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। সিরিয়া যুদ্ধে তুরস্কের অংশগ্রহণ ও কিছু এলাকা দখলে নেয়া মূলত এই গ্রুপটিকে নিয়ন্ত্রণ রাখা অথবা দূর্বল করার জন্য। অথচ এই গ্রুপটিকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তি নিয়মিত সহায়তা করে যাচ্ছে এবং এদের বিরুদ্ধে কোন একশন নিলেই তারা মানবাধিকার লংঘনের অজুহাত তুলে তুরস্ককে ধুয়ে দেয়।

এখন দেখার বিষয় হলো, বাশারের পতনে পশ্চিমাদের সহায়তায় এরা কি আরও শক্তিশালী হয়ে তুরস্কের উপর মরণ কামড় দেবে নাকি তুরস্ক আজকের এই বিজয়ী পক্ষের সহায়তায় এদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে? পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে তা এখনই জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। আজকের এই বিজয়ী পক্ষ যদি সত্যিকারার্থে পশ্চিমাদের সাথে কোন শর্তের ভিত্তিতে রাশিয়া ও ইরানকে সিরিয়া থেকে বিতাড়িত করতে বাশারের পতন ঘটিয়ে থাকে, তাহলে তুরস্ক সীমান্তের কুর্দিশ গোষ্ঠীকে দমনে তারা তুরস্ককে সহায়তা করবে কেন? তারাতো শর্ত অনুযায়ী পশ্চিমাদের কথার বাইরে যেতে পারবে না। বিশেষ করে এই ধবংস স্তুপ থেকে ধীরে ধীরে সিরিয়াকে আবার গড়ে তোলার জন্য হলেও তাদের পশ্চিমাদের সহায়তার দিকে তাকিয়ে থাকতে হতে পারে।

এই জটিল সমীকরণের উপরই নির্ভর করছে ২০২৪ সালে দক্ষিণ এশিয়ার গ্রেট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর মধ্যপ্রাচ্যের আরেক বড় স্বৈরাচার বাশার আল আসাদ পরবর্তী সিরিয়ার ভবিষ্যত।

* আবু সালেহ ইয়াহইয়া রাজনীতি বিশ্লেষক (তুরস্ক ও মধ্যপ্রাচ্য)। লন্ডন, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *