সাঈদ চৌধুরী
বিরল প্রতিভার অধিকারী সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান (৬ অক্টোবর ১৯৩২– ৫ সেপ্টেম্বর ২০০৯) ছিলেন বাংলাদেশের প্রধান অর্থনৈতিক সংস্কারক ২০০৯ সালে মৌলভীবাজার থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় ইন্তেকাল করেন তিনি।
বাংলাদেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সকল প্রয়াস যখন একের পর এক ব্যর্থ হতে চলেছে, তখন ধুমকেতুর মত আবির্ভূত হন এম সাইফুর রহমান। তিনি ছিলেন মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি ও উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানের একজন বিশেষজ্ঞ। ছিলেন অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারিগর। তারই নেতৃত্বে দেশের অর্থনীতিতে দ্রুত পরিবর্তন আসতে থাকে। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে সর্বোচ্চ ১২ বার বার্ষিক বাজেট পেশ করার রেকর্ড সৃষ্টিকারী সফল অর্থমন্ত্রী।
সাইফুর রহমানের আগে বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল থেকে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী। ১৩ জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে ১৬ মার্চ ১৯৭৩ পর্যন্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। ১৬ মার্চ ১৯৭৩ থেকে ২৬ অক্টোবর ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী/রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অর্থ মন্ত্রণালয় নিজ দায়িত্বে পরিচালনা করেন। এরপর ২৬ অক্টোবর ১৯৭৪ সাল থেকে ২৬ নভেম্বর ১৯৭৫ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন ড. এ আর মল্লিক।
বঙ্গবন্ধুর সরকার গুরুতর অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ছিল। এর মধ্যে ১৯৭১ সালে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের পুনর্বাসন, খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবা উপকরণ সরবরাহ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়াবলী ছিল। ১৯৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব তখনো কাটেনি এবং যুদ্ধের ফলে অর্থনৈতিক অবস্থাও চরমভাবে ভেঙে পড়েছিল।
১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর মির্জা নূরুল হুদা বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নিযুক্ত হন। তাকে কৃষি, বাণিজ্য, অর্থ, শিল্প ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। ১৯৭৯ সালের ২৪ নভেম্বর তিনি অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করেন এবং ২৪ এপ্রিল ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন।
কোন কিছুতেই যখন অবস্থার অগ্রগতি হচ্ছিলনা তখন ১৯৮০ সালের ২৫ এপ্রিল জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে এম সাইফুর রহমান বাংলাদেশের অর্থনীতির হাল ধরেন। তিনি ১৯৮২ সালের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৯১ সালের ২০ মার্চ থেকে ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ পর্যন্ত ফের অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান এম সাইফুর রহমান। সবশেষে ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর থেকে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত আবারো অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আজ আমাদের অর্থনীতি যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে এগোচ্ছে, তার কারিগর ছিলেন এম সাইফুর রহমান। তাঁকে বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনের স্থপতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তিনি বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক সভায় নির্বাচিত গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
পেশাগত জীবনে সাইফুর রহমান ছিলেন একজন সুনামখ্যাত নিরীক্ষক। ইংল্যান্ডের ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট ইন ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়ালস থেকে তিনি চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হিসেবে ডিগ্রি নিয়েছেন। প্রখর মেধাবী সাইফুর রহমান ছিলেন অর্থনৈতিক সংগঠক। তিনি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টসের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
সাইফুর রহমান মুক্তবাজারে বিশ্বাস করতেন। বিভিন্ন সময় দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও উন্নয়ন প্রতিবেদন কালে তার সাথে রয়েছে অনেক স্মৃতি। লন্ডনে সাপ্তাহিক ইউরো বাংলা ও দৈনিক সময়’র জন্য আমাকে দেয়া তাঁর শিল্পবিপ্লব ও বর্তমান বাজার অর্থনীতি সম্পর্কে বিশ্লেষণ বিস্ময়কর মনে হয়েছে। সমকালীন বিশ্ব অর্থনীতি সম্পর্কে তিনি বেশ ওয়াকিবহাল ছিলেন।
সাইফুর রহমানের নেতৃত্ব ও তত্ত্বাবধানে ব্যাংকিং খাতে যুগোপযোগী সংস্কার সাধন করা হয়েছিল। তিনি স্বাধীন জাতীয় দুর্নীতি দমন কমিশন গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশে তৈরী পোশাক শিল্প এবং ভারী শিল্পকারখানার শক্ত ভিত্তি দিয়ে ছিলেন তিনি।
সাইফুর রহমান গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত স্থাপনে এবং দারিদ্র্য হ্রাসকরণে কর্মসূচি প্রণয়নে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন তা দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনে ব্যাপক সাফল্য বয়ে আনে। তিনি ছিলেন উদ্ভাবনী ক্ষমতার অধিকারী একজন কর্মবীর। যার স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও উন্নয়নের রূপকার হিসেবেই এ দেশের মানুষ তাকে স্মরণ করবে।
সাইফুর রহমান ছিলেন আমার প্রিয় মানুষদের একজন। ২০০০ সাল থেকে লন্ডনে যতবার এসেছেন আমি তার একান্ত সান্নিধ্যে ছিলাম। দেশে থাকাবস্থায় সিলেটের শিক্ষাঙ্গন-সহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন কালে, ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সিলেট বিভাগ প্রতিষ্ঠার সময়ে এবং উত্তর সিলেটের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বার বার তাঁর কাছে ছুটে গিয়েছি। বিশেষ করে জাতীয় প্রেস ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ও ভয়েস অব আমেরিকার প্রতিনিধি গিয়াস কামাল চৌধুরীর চিকিৎসার সুবিধার্থে লন্ডন হাইকমিশনে পাঠানোর ব্যাপারে আমার অনুরোধ রক্ষায় তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। সাইফুর রহমানের ঘটনা বহুল জীবনের সাথে রয়েছ আমার অনেক স্মৃতি। এই ছোট্ট পরিসরে তা লিখে শেষ হবেনা। স্বতন্ত্র গ্রন্থে প্রকাশের আশা রাখি।
সাইফুর রহমানের মৃত্যুর পর রাজধানী ঢাকায় আয়োজিত স্মরণ সভায় আমিও অংশ নিয়েছিলাম। সেখানে বক্তারা বলেছেন, দেশ যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তার মূল কারিগর ছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান। মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আরোপ ছিল তাঁর যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তিনি সব সময় মেধাকে মূল্যায়ন করতেন। দূররে সামাদ রহমান ও সাইফুর রহমান ফাউন্ডেশন এই আলোচনা সভার আয়োজন করে।
সাইফুর রহমানের সঙ্গে বিভিন্ন সময় কাজ করার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ টি এম শামসুল হুদা বলেন, সাইফুর রহমান কাজ করতেন গুণাগুণ বিচার করে। আর্থিক ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে এর ছাপ ছিল। তাঁর ভ্যাট প্রচলন, ব্যাংকিং খাতে সংস্কার সহ বিভিন্ন উদ্যোগ তুলে ধরে শামসুল হুদা বলেন, সাইফুর রহমান যেসব কাজ করেছেন তার ভিত খুব শক্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে পরবর্তী সময়ে কেউ এসব বাদ দিতে পারেনি, গ্রহণ করতে হয়েছে। তিনি বলেন, সাইফুর রহমান নিয়োগের ক্ষেত্রে কখনো কার বাড়ি কোথায় এসব দেখতেন না। কার কী কাজ আছে, সুনাম কেমন—এসব দেখে তিনি নিয়োগ দিতেন। শামসুল হুদা বলেন, বাইরে থেকে অনেকে সাইফুর রহমানকে বদরাগী মনে করতেন। কিন্তু আসলে তিনি ছিলেন প্রকৃতির মতো সরল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি যে এগিয়ে যাচ্ছে তার মূল কারিগর ছিলেন সাইফুর রহমান। তাঁর সময়ে ব্যাংক খাতে কোনো হস্তক্ষেপ করা হতো না। ভ্যাট চালুর উদ্যোগ ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাবেক সহ-সভাপতি (ডাকসুর ভিপি) সুলতান মোহাম্মদ মনসুর বলেন, সাইফুর রহমান দলবাজদের মতো আচরণ করেননি। দলের মধ্যে থেকেও তিনি যা সঠিক সমাজের কল্যাণে আসবে মনে করতেন, তাই করেছেন। অন্যদের মধ্যে সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ খান, ছিদ্দিকুর রহমান চৌধুরী, সাইফুর রহমানের ছেলে এম নাসের রহমান প্রমুখ আলোচনায় অংশ নেন।
সাবেক অর্থমন্ত্রী, বরেণ্য রাজনীতিবিদ এম সাইফুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে তার আত্মার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সাবেক অর্থমন্ত্রী, বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য এম সাইফুর রহমানের অবদান দেশবাসী ও দল চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এম সাইফুর রহমানের কৃতিত্ব সর্বজনবিদিত। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সুরক্ষা এবং জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি সবসময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। একজন প্রাজ্ঞ ও কীর্তিমান অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে যুগান্তকারী অবদান রেখেছেন। তার দক্ষ রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রভূত সুনাম অর্জন করে। তিনি স্বদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির অন্যতম পথিকৃত। স্বাধীনচেতা, স্পষ্টভাষী, অটুট মনোবল এবং ঈর্ষনীয় ব্যক্তিত্বের কারণে তিনি ছিলেন সবার নিকট অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি।
মির্জা ফখরুল বলেন, দেশের দুর্যোগের সময় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন কালে এম সাইফুর রহমান দেশকে কেবলমাত্র অর্থনৈতিক ভাবেই স্বাবলম্বী করেননি বরং স্বদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার অঙ্গীকারে বিএনপিকে সুসংগঠিত ও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। জাতীয়তাবাদী দর্শনকে বুকে ধারণ করে দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে স্বৈরাচারের কবল থেকে গণতন্ত্রের পথে উত্তরণে এম সাইফুর রহমানের অবদান দেশবাসী ও দল চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। সাইফুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা হিসেবে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন।
উল্লেখ্য, সাইফুর রহমান ১৯৩২ সালের ৬ অক্টোবর মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বাহারমর্দন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল বাছিত এবং মাতার নাম তালেবুননেসা। তিনি ১৯৪৯ সালে মৌলভীবাজার সরকারি হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৫১ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে আই.এ পাশ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত লন্ডনে পড়াশুনা করেন এবং ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট (ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস) থেকে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন।
সাইফুর রহমান ১৯৬২ সালে যুক্তরাজ্যে অ্যাডভান্সড ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি আর্থিক ও মুদ্রানীতি এবং উন্নয়ন অর্থনীতিতে বিশেষায়িত শিক্ষা গ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে সাইফুর রহমান ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দেন এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকার জন্য তিনি গ্রেফতার হন এবং এক মাস কারাবরণ করেন। ভাষা আন্দোলনে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৫ সালে সাইফুর রহমান একুশে পদকে ভূষিত হন। সাইফুর রহমান ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান জাতীয় বেতন কমিশনে প্রাইভেট সেক্টর হতে একমাত্র সদস্য মনোনীত হন। তিনি ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ জাতীয় বেতন কমিশনের সদস্য ছিলেন।
সাইফুর রহমান ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমানের সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। ১৯৭৭ সালে তিনি জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দলে যোগ দেন। এ দলটিই প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭৮ সালে জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি) রূপান্তরিত হয়। সাইফুর রহমান ১৯৭৯ সালে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মৌলভীবাজার সদর এলাকা থেকে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভায় বাণিজ্য ও অর্থমন্ত্রী এবং ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত টেকনোক্র্যাট অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সাইফুর রহমান বাংলাদেশে মুক্ত বাজার সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রবর্তক হিসেবে সমধিক পরিচিত। ১৯৭০- এর দশকের শেষের দিক থেকে এ প্রক্রিয়া চালু হয়। তিনি ১৯৯৬ সালে এবং পুনরায় ২০০১ সালে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায় অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।
সাইফুর রহমান অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো করের পরিসর বৃদ্ধি করে মূসক (মূল্য সংযোজন কর) প্রথা প্রবর্তন করেন। ১৯৯০-এর দশকের প্রথমদিকে তিনি ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন। এছাড়াও ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালে টেকনোক্র্যাট অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি ভাসমান মুদ্রাবিনিময় হার নীতিমালা প্রণয়ন, বাণিজ্য উদারিকরণ, বেসরকারীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর সূচনা করেন।
সাইফুর রহমান ১৯৮০ থেকে ১৯৯৬ সাল মেয়াদে ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সম্প্রদায় (ইইসি), এশিয়া ও প্যাসেফিকের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন (এসকাপ), কমনওয়েলথ এবং জাতিসংঘ বাণিজ্য ও উন্নয়ন সম্মেলনে (আঙ্কটাড) বাংলাদেশের অর্থ ও বাণিজ্য বিষয়ক প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। তিনি ১৯৯৫ সালে কলম্বিয়ায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। এছাড়া ঐ বছর বসনিয়ায় অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) সম্মেলনেও তিনি বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের প্রধান ছিলেন। তিনি বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) এবং ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট (ইফাদ)-এ বাংলাদেশের গভর্নর ছিলেন।
সাইফুর রহমান ১৯৯৪ সালে মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) এবং বিশ্বব্যাংকের ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন।
সাইফুর রহমান ১৯৬২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তাঁর দীর্ঘ পেশাগত জীবনে গড়ে তোলেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতমানের ‘রহমান রহমান হক’ নামীয় একটি নিরীক্ষা ফার্ম। এছাড়া তিনি কেমিক্যাল, তেল-গ্যাস উত্তোলন, ট্রান্সপোর্ট, ব্যাংকিং, ইন্স্যুরেন্স ইত্যাদি বিষয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করেন।
সাইফুর রহমান ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড একাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি)-এর প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল’ অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স-এর প্রিন্সিপাল এবং বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সাইফুর রহমানের আত্মজীবনী গ্রন্থ কিছু কথা কিছু স্মৃতি ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয়। এ বইতে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনের অকথিত বিষয় সহ বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য তুলে ধরেছেন।
লন্ডনে অনুষ্ঠিত প্রথম স্মরণ সভায় বিপুল সংখ্যক প্রবাসী অংশ নিয়েছিলেন।
* সাঈদ চৌধুরী সময় সম্পাদক, কবি ও কথা সাহিত্যিক