মুসলিম কমিউনিটি এসোসিয়েশনের (এমসিএ) কেন্দ্রীয় প্রেসিডেন্ট খ্যাতিমান আইনজীবী ও মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব ব্যারিষ্টার হামিদ হোসাইন আজাদ শক্তিশালী উম্মাহ গঠনের ক্ষেত্রে মহররম মাসের তাৎপর্য বর্ণনা করে বলেছেন, মানবতার জন্য ত্যাগের মাস, তাগুতের বিরুদ্ধে বিজয়ের মাস এবং হিজরি ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস মহররম হচ্ছে একতার মাস। শয়তানের মোকাবেলায় আমাদেরকে ঐক্য ও সংহতি অর্জনের মাধ্যমে এই মাসের শিক্ষাকে কাজে লাগাতে হবে।
শুক্রবার (১২ জালাই ২০২৪) লন্ডন বারা অব রেডব্রিজের চ্যাডওয়েলহিথ মুসলিম সেন্টারে জুম্মার খুতবায় তিনি এসব কথা বলেন।
ব্যারিষ্টার হামিদ আজাদ মুসল্লিদের উদ্দেশ্য করে বলেন, এই জামাতে উপস্থিত আপনারা অনেকেই গত মাসে হজে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন, হজের মাসে একতার স্বাদ উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছেন। আরাফার উন্মুক্ত ময়দানে সমবেত মুসলিম উম্মাহর লক্ষাধিক লোকের একটাই আকাঙ্ক্ষা ছিল, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এছাড়া আর কোন প্রত্যাশা ছিলনা। ইসলামী জনতার একটাই স্লোগান ছিল ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’। হে আমার প্রভু, আমি হাজির।
সব ধরণের জাগতিক প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে, সকল বর্ণ ও জাতিসত্তার মানুষ সারা বিশ্ব থেকে সাদা পোশাকে, সম্পদ, লাভজনক পেশা, ভৌগলিক সীমানা ও রাজনৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব বাদ দিয়ে, শ্রেণী, শিক্ষা, অর্থনৈতিক অবস্থা বা অন্যান্য অসমতা থেকে মুক্ত হয়ে সেখানে সমস্ত তীর্থযাত্রীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। হজের এই চিরন্তন চিত্রটি তার বৈচিত্র্যে এই উম্মাহর ঐক্যের বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। এটাই ইসলামের চেতনা এবং এটিই একে অপরের প্রতি ভালোবাসার শিক্ষা।
উম্মাহ যখন মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে অপমানজনক ও বিপর্যয়কর সময় পার করছে তখন আমাদের সেই ঐক্য ও সংহতি প্রয়োজন। এটাই সময় ইসলামী ভাতৃত্বের ভিত্তিতে এক উম্মাহ হিসেবে দাঁড়ানোর। আমরা একটি উম্মাহ হিসেবে আমাদের লক্ষ্য পূরণের জন্য ইসলামী ভাতৃত্বের বন্ধন অটুট রাখব, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে, যেখানে বহুমাত্রিকতা বিশ্বের অন্যান্য অংশের তুলনায় আরো বৈচিত্র্যময়!
ব্যারিষ্টার হামিদ আজাদ ইসলাম প্রচারে মহানবীর (স.) কর্মকৌশল ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বর্ণনা করে বলেন, মদীনার বৈচিত্র্যময় নগরীতে প্রথম ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠায় সাফল্যের মূল চালিকাশক্তি ছিল ঐক্য। এটি প্রথম দিকের মুসলমানদের অত্যাচারী কাফেরদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুদ্ধে জয়লাভ করতে সাহায্য করেছিল। এটিই অন্যায় ও আগ্রাসনের অবসান ঘটায়। তাই বিশ্বাসকে সমুন্নত রাখতে এবং শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়পরায়ণ সমাজ প্রতিষ্ঠায় সাফল্য অর্জনের চাবিকাঠি হল ঐক্য। আর এই ঐক্যের জন্য প্রয়োজন প্রেম, ত্যাগ, ধৈর্য এবং দ্বীনের গভীর উপলব্ধি। আমি আশা করি মহররম মাসের চেতনা আমাদের উম্মাহর ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা পূরণে সাহায্য করবে।
মুসলিম ঐক্যের বাধ্যবাধকতা বিশ্লেষন করে এমসিএ’র প্রেসিডেন্ট বলেন, ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ অনুশীলন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আমরা ভ্রাতৃত্বের মত অন্যান্য মৌলিক দিকগুলিকে উপেক্ষা করতে পারি না। এক্ষেত্রে ঐক্যের বিকল্প নেই। কুরআন ও হাদিস অনুসারে সকল মুসলমানের জন্য এটা অপরিহার্য। সূরা আল-ইমরানের ১০৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: তোমরা সকলে আল্লাহ্র রশি দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। আর তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর, তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু, অতঃপর তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন, ফলে তার অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। তোমর তো অগ্নিগর্তের দ্বারপ্রান্তে ছিলে, তিনি তোমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করেছেন। এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তার নিদর্শনসমূহ স্পষ্টভাবে বিবৃত করেন যাতে তোমরা হেদায়াত পেতে পার।
ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মতবিরোধ তথা ইখতিলাফ নিয়ে মনোমালিন্য না করার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িন, তবেতাবেয়িন বা প্রধান প্রধান ইমামদের মাঝেও কোন কোন বিষয়ে মতভেদ ছিল। কিন্তু তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ ও মনোমালিন্য ছিলনা। সূরা আল-ইমরানে ১০৩ আয়াতে আল্লাহ নির্দেশ করেছেন: তোমরা সকলে আল্লাহ্র রশি দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। আর তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর, তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু, অতঃপর তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন। ফলে তার অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। তোমরা তো অগ্নিগর্তের দ্বারপ্রান্তে ছিলে, তিনি তোমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করেছেন। এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তার নিদর্শনসমূহ স্পষ্টভাবে বিবৃত করেন যাতে তোমরা হেদায়াত পেতে পার।
সূরা আল-ইমরানের ১০৪ ও ১০৫ আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন: তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল হোক, যারা কল্যাণের দিকে আহবান করে, সৎ কাজের আদেশ করে এবং অসৎ কাজ হতে নিষেধ করে, আর এরাই সফলকাম। তোমরা সেই লোকদের মত হয়ে যেয়ো না, যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শন পৌঁছার পরে বিভক্ত হয়েছে ও মতভেদ করেছে এবং এ শ্রেণীর লোকেদের জন্য আছে মহা শাস্তি। সূরা আল-মুমিনুনের ৫২-৫৩ আয়াতে বলেছেন: নিশ্চয় তোমাদের এই জাতি একই জাতি এবং আমিই তোমাদের প্রতিপালক; অতএব তোমরা আমাকে ভয় কর। কিন্তু তারা নিজেদের মধ্যে তাদের দ্বীনকে বহু ভাগে বিভক্ত করেছে; প্রত্যেক দলই তাদের নিকট যা আছে, তা নিয়েই আনন্দিত।
দ্বন্দ-সংঘাত এবং উপহাস না করার জন্য মহান আল্লাহ (সূরা আল-আনআমের ১৫৯ আয়াতে বলেন: অবশ্যই যারা ধর্ম সম্বন্ধে নানা মতের সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের কোন কাজের দায়িত্ব তোমার নেই, তাদের বিষয় আল্লাহর এখতিয়ারভুক্ত। তিনিই তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে তাদেরকে অবহিত করবেন। সূরা আল-হুজুরাতের ১০ ও ১১ আয়াতে বলেন: মুমিনগণ তো পরস্পর ভাই ভাই; কাজেই তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে আপোষ মীমাংসা করে দাও। আর আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও। হে ঈমানদারগণ! কোন মুমিন সম্প্রদায় যেন অপর কোন মুমিন সম্প্রদায়কে উপহাস না করে; কেননা যাদেরকে উপহাস করা হচ্ছে তারা উপহাসকারীদের চেয়ে উত্তম হতে পারে। এবং নারীরা যেন অন্য নারীদেরকে উপহাস না করে; কেননা যাদেরকে উপহাস করা হচ্ছে তারা উপহাসকারিণীদের চেয়ে উত্তম হতে পারে। আর তোমরা একে অন্যের প্ৰতি দোষারোপ করো না এবং তোমরা একে অন্যকে মন্দ নামে ডেকো না; ঈমানের পর মন্দ নাম অতি নিকৃষ্ট। আর যারা তওবা করে না তারাই তো যালিম৷
হাদিস থেকেও বেশ কিছু দলিল পেশ করেন ব্যারিষ্টার হামিদ আজাদ। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন: আল্লাহ তোমাদের তিনটি বিষয়ের প্রতি সন্তুষ্ট হন এবং তিনটি বিষয়ের প্রতি রাগান্বিত হন। তিনি তোমাদের প্রতি এতে সন্তুষ্ট হন যে, তোমরা তারই ইবাদত করবে, তার সাথে কাউকে শরীক করবে না, সকলে মিলে আল্লাহর রজ্জুকে আকড়ে ধরবে ও পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হবে না, যাকে আল্লাহ তোমাদের দায়িত্বশীল বানান তোমরা তার কল্যাণ কামনা করবে। আর তোমাদের তিনটি বিষয়ের ব্যাপারে রাগান্বিত হন: ‘অনর্থক কথাবার্তা, অতিরিক্ত প্রশ্ন ও সম্পদ নষ্ট করা।’ এই তিনটি জিনিসের মধ্যে একটি, যেটি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে এবং আল্লাহ আমাদের জন্য তা পছন্দ করেন তা হচ্ছে আল্লাহর রজ্জুকে আকড়ে ধরা, বিচ্ছিন্ন না হওয়া। (সহীহ মুসলিম)
মুসলিম কমিউনিটি এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ব্যারিষ্টার হামিদ হোসাইন আজাদ যখন তার হৃদয় নিংড়ানো প্রাঞ্জল ভাষায় তাগুতি শক্তির মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ উম্মাহ গঠনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার কথা বলছিলেন, তখন উপস্থিত মুসল্লিরা প্রাণময় হয়ে শুনেছেন পিনপতন নিরবতায়। ঐক্য ও সংহতি অর্জনের জন্য তারা হয়েছেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
* সাঈদ চৌধুরী সময় সম্পাদক, কবি ও কথা সাহিত্যিক।