কোটা নিয়ে রাজপথে ঘটনার ঘনঘটা

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা

কোটা নিয়ে রিটের ওপর হাইকোর্টের সংক্ষিপ্ত রায়ের ফলে নতুন একটি প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। আন্দোলনরতরা চান দ্রুত সংস্কার, তবে আইনজীবীরা বলছেন, তা নির্ভর করছে আদালতের ওপর৷ রায়ে বলা হয়েছে, যাদের জন্য কোটা আছে তা বহাল রেখে সরকার চাইলে সংখ্যার অনুপাত পরিবর্তন করতে পারবে। কিন্তু কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা বলছেন, কোটার যৌক্তিক সংস্কারের জন্য সংসদে আইন পাশ করতে হবে।

তারা আরো বলেছে, শুধু প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি নয়, সব গ্রেডের সরকারি চাকরির কোটা সংস্কার করতে হবে, তবে সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ পাঁচ ভাগের বেশি কোটা রাখা যাবে না। মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা পুরোপুরি বাতিল করার কথাও বলা হচ্ছে কোটাবিরোধীদের পক্ষ থেকে। নারীদের কোটা রাখারও বিপক্ষে তারা। শুধু বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন(প্রতিবন্ধী) মানুষ, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী (যেমন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী)-র জন্যই কোটা রাখার পক্ষে তারা।

তবে আইন বিশ্লেষকরা বলছেন, এজন্য সংসদে আইন করার কোনো প্রয়োজন নেই, এটি সরকার প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমেই করতে পারে। কারণ, সংবিধানেই এর বিধান আছে। বরং আইন করলে নতুন সংকট হবে বলে মনে করেন তারা৷

প্রশ্ন হলো, সরকার এটা কখন করতে পারবে? এ নিয়ে আইনজ্ঞদের মধ্যে নানা মত আছে। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ সাইফুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, “আদালতের পুরো বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরই এটা করা যাবে।” সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, “সরকার দ্রুতই তা করতে পারে। আদালতের আদেশ মেনে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে আবার তা বাতিল করে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে। সময় নষ্ট না করে আপিল প্রত্যাহার করে সরকার প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তা করতে পারে।”

আবার কেন কোটা সংস্কারের দাবি?

২০১৮ সালে আন্দোলনের মুখে সরকার সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সব ধরনের কোটা বাতিল করে। এর মাধ্যমে নারী কোটা ১০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, উপজাতি কোটা পাঁচ ও প্রতিবন্ধীদের এক শতাংশ কোটা বাতিল করা হয়। তবে অন্যন্য গ্রেডের চাকরির ক্ষেত্রে কোটা বহাল আছে।

এই প্রজ্ঞাপনের মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ বতিল চ্যালেঞ্জ করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল ২০২১ সালে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করে। গত ৫ জুন রায় দেয় হাইকোর্ট। রায়ে ২০১৮ সালের সরকারের প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রপক্ষ’ আবেদন করলে ৪ জুলাই আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে নিয়মিত আপিল করতে বলেন। এর মধ্যে হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে দুই শিক্ষার্থী গত মঙ্গলবার আপিল বিভাগে আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষ ও দুই শিক্ষার্থীর আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে বুধবার আপিল বিভাগ কোটার বিষয়ে পক্ষগুলোকে চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দেন। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের আপিলের ওপর হাইকোর্টর সংক্ষিপ্ত রায় প্রকাশিত হয়। সেখানেও পরিস্থিতি শান্ত হয়নি। কোটাবিরোধীরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আর প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘‘আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের জন্য আদালতের দরজা খোলা আছে। তারা চাইলে সেখানে গিয়ে তাদের কথা বলতে পারেন।”

আপিল বিভাগের রায় না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা?

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ সাইফুজ্জামান বলেন,” হাইকোর্টের সংক্ষিপ্ত রায়ে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে সরকারের প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হলো। সব কোটাই থাকবে, তবে সরকার চাইলে এর আনুপাতিক সংখ্যা পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন করতে পারবে। তবে কোনো কোটা বাতিল করা যাবে না।” তিনি বলেন, ‘‘অন্যদিকে দুই ছাত্রের আবেদনে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের এই রায়কে আগেই আগামী চার সপ্তাহের জন্য স্থগিত করে দিয়েছে। ফলে আপিল বিভাগের বিচার কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত সরকার কিছুই করতে পারবে না। এটা এখন আদালতের বিচারের বিষয়। বিচার শেষ হলে সরকারের কিছু করার থাকবে।”
“আর রাষ্ট্রপক্ষও পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে আপিল করতে পারবে। ফলে বিচার কাজ এখনো শেষ হয়নি৷ বিচার চলাকালে সকাকারের কিছু আসলে করার নেই। কিছু করতে গেলে আদালত অবমাননা হবে,” বলেন তিনি।

তবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, “সরকার গত ৫০ বছরে পাঁচ-ছয়বার তো এই প্রজ্ঞাপন পরিবর্তন করেছে, আবারো পরিবর্তন করতে পারে। এতে কোনো আদালত অবমাননা হবে না। সরকার সেইফে থাকতে এক মাস পরে করতে পারে। কিন্তু ছাত্রদেরও তো আস্থায় আনতে হবে। তাই প্রক্রিয়া শুরু করে দিতে পারে। কমিশন গঠন করতে পারে।” “এজন্য সংসদে আইন পাশের কোনো দরকার নেই, তাতে আবার নতুন সমস্যা হতে পারে। কারণ, আবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কোটা সংস্কারের প্রয়োজন হলে আবার নতুন আইন লাগবে,” বলেন তিনি।

তবে ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক মনে করেন,” এটা সাবজুডিজ। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ে যেহেতু বলা হয়েছে সরকার এর আনুপাতিক সংখ্যা পরিবর্তন করতে পারে, তাই সরকার চাইলে কোটার সংস্কার এখন করতে পারে। সরকার এই পরিবর্তনের উদ্যোগ নিলে কোনো বাধা নেই। কিন্তু সেটা যেন আদালতের রায়ের স্পিরিটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। কিন্তু সরকার কোটা বাতিল করতে পারবে না। কমাতে-বাড়াতে পারে। আবার ধরুন, হিজড়াদের জন্য নতুন কোটা করতে পারে, এতে কোনো সমস্যা হবে না।” “তবে এরজন্য সংসদে আইন পাশের কোনো দরকার নেই। কারণ, কোটার বিষয়টি সংবিধানে অলরেডি আছে। আমার মনে হয়, আন্দোলনকারীরা সরকারকে আস্থায় নিতে পারছে না। সেজন্য আইনের কথা বলছে। আসলে ভুলটি সরকারই করেছে ২০১৮ সালে। তারা সব কোটা বাতিল করে ঠিক করেনি। সব কোটা বাতিল করায় এই সমস্যা হয়েছে, সংক্ষুব্ধরা আদালতে গেছেন।”

সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, “হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছে এবং আপিল বিভাগ যে স্থিতিবস্থা দিয়েছে সেটা সরকারের স্বাধীন সিদ্ধান্তে কোনো বাধা হতে পারে না। সরকার কোটা রাখবে কী রাখবে না এটা সরকারের একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত। একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সরকার যদি মনে করে ২০১৮ সালে তারা আন্দোলনের চাপে কোটা বাতিল করেছে। আবার এখন যদি মনে করে আন্দোলনের চাপ সহ্য করে তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকবে, এটা তাদের ব্যাপার।”

কার লাভ কার ক্ষতি

হাইকোর্টের আদেশ মতে কোটা বহাল হলে মোট কোটা হবে ৫৬ শতাংশ। এর মাধ্যমে নারী কোটা ১০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, উপজাতি পাঁচ ও প্রতিবন্ধীদের এক শতাংশ। কোটাবিরোধী আন্দোলনের এক সমন্বয়কারী আসিফ মাহমুদ বলেন, “আমরা সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ কোটার দাবি করেছি, এর বেশি নয়। এই পাঁচ শতাংশ কোটা হবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, যেমন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী তাদের জন্য। নারী, মুক্তিযোদ্ধা বা অন্য কোনো কোটার দরকার নেই। এটা শুধু প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরির জন্য নয়, সব ধরনের চাকরির জন্য করতে হবে।”

মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিরোধিতা করে তিনি বলেন, ” ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যে কোটা করেছিলেন, তা সঠিক ছিল। কিন্তু এখন আর প্রয়োজন নেই। কারণ, তাদের তৃতীয় প্রজন্ম চলছে।”

তবে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন বলেন,” ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কোটা থাকলেও মুক্তিযোদ্ধারা বাস্তবে সেই কোটা ৩০ বছর ধরে পাননি। তাদের নানা কৌশলে বঞ্চিত করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে কোটা সুবিধা পেতে শুরু করে। ওই ৩০ বছর যদি পেতেন, তাহলে এখন আর মুক্তিযোদ্ধাদের কোটার প্রয়োজন হতো না। আর ৩০ ভাগ বলা হলেও খালি থাকা কোটা সাধারণ কোটা দিয়ে পুরণ করা হয়।” তার কথা, “মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০ ভাগ কোটা কোনোভাবেই কমানো যাবে না।”

সরকারি তথ্য বলছে, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ২০ শতাংশ পদে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হতো, বাকি ৮০ শতাংশ পদে কোটায় নিয়োগ হতো। ১৯৭৬ সালে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ৪০ শতাংশে বাড়ানো হয়। ১৯৮৫ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে ৪৫ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের নিয়ম চালু করা হয়, বাকি ৫৫ শতাংশ অগ্রাধিকার কোটায় নিয়োগ দেওয়া হয়। সেই অগ্রাধিকার কোটার মধ্যে ছিল ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা ও পাঁচ শতাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী কোটা।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য চাকরির কোটা নিশ্চিত করে। তাদের আগে নানা কৌশলে বঞ্চিত করার অভিযোগ ছিল। সবশেষ ২০০৯ সালের ২০ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধার ছেলে ও মেয়ে, নাতি-নাতনি কোটা পুনর্বিন্যাস করা হয়। এই ৫৫ শতাংশ কোটায় পূরণযোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সেক্ষেত্রে এক শতাংশ পদে প্রতিবন্ধী নিয়োগের বিধান রয়েছে। সেই হিসাবে কোটা ৫৬ শতাংশ। কোটায় উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া না গেলে তা মেধাতালিকা থেকে পূরণ করা হয়। ২০১৮ সালে কোটাবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ১১ এপ্রিল তখনকার তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু জানান, ৪৪ ভাগ বলা হলেও মেধায় বাস্তবে গড় নিয়োগ ৭০ শতাংশ। কারণ, কোটা পুরণ না হলে তা মেধার ভিত্তিতে পুরণ করা হয়।

কোটা বাতিল নয়, সংস্কার

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাহবুব শফিক বলেন, “পৃথিবীর সব দেশে কোটা আছে৷ কোটা নিয়ে কোনো বিরোধ নাই। ভারতে আছে, শ্রীলঙ্কায় আছে। মালয়েশিয়ায় ৫৫ শতাংশ কোটা মালয় থেকে নিতে হবে। আমাদের এখানে প্রশ্ন উঠেছে কোটা কত শতাংশ থাকবে। এটা তো বাতিল করা যাবে না। এটা তো সংবিধানের বিষয়। কোটার মূল উদ্দেশ্য হলো পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে অন্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সমতায় নিয়ে আসা। ” “এখন সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোটা সে আনুপাতিক হারে কতটুকু রাখবে। সেখানে দেশের জনগণের আকাঙ্খার প্রতিফলন থাকতে হবে। এটা মোট জনসংখ্যার ভিত্তিতে ঠিক করতে হবে,” বলেন তিনি।

আর সাবেক জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, “কোটা তো থাকতে হবে। আমাদের সংবিধানেও পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে আনার জন্য কোটার কথা বলা আছে। এর সঙ্গে নারী কোটা, প্রতিবন্ধী কোটা থাকতে পারে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধা কোটাও থাকতে হবে। কারণ, তারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তবে এখন যে ৩০ শতাংশ আছে তত নয়। এটা যৌক্তিকভাবে কমিয়ে আনতে হবে।” “সরকার সবার সঙ্গে কথা বলে কোটার পুনর্বিন্যাস করতে পারে। কমিশন গঠন করতে পারে।অথবা অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে সরকারের প্রস্তাব আদালতেকেও জানাতে পারে। তবে এটা সরকারকেই করতে হবে,” বলেন তিনি।

ড. শাহদীন মালিক বলেন, “এখানে ১০-১২ শতাংশ কোটা রাখা যায় অনগ্রসর জনগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধীদের জন্য। মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রয়োজনীয়তা এখন নেই। কারণ, তাদের এখন থার্ড জেনারেশন চলছে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *