কবি ফজলুল হক তুহিনের কাব্যসাধনা

প্রবন্ধ-কলাম সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

ড. মোজাফফর হোসেন

ইংরেজদের কাছে আমাদের দু’শ বছরের গোলামী বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের ধারাকে বিপদগ্রস্ত করেছিল। তবুও ইংরেজ মোহ আমাদের মস্তিষ্ক থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হতে পারেনি আজও। তবে সেই মোহ ধীর লয়ে এগিয়ে এখন একটু একটু কাটতে শুরু করেছে এবং শিল্প-সাহিত্যে এক নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। বাংলা কাব্য সাধনার এই নতুন পথ নতুন প্রাণ সঞ্চারে যারা সারিবদ্ধ হয়েছেন তাদের মধ্যে কবি ফজলুল হক তুহিন (১৯৭৮ খ্রি.) একজন সারথী।

ফজলুল হক তুহিন জন্মগ্রহণ করেছেন রাজশাহীতে। তাঁর পড়াশুনা ও গবেষণা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। তিনি কবি আল মাহমুদের চিন্তার স্বরূপকে উন্মোচন করে দিয়ে অর্জন করেছেন পিএইচডি ডিগ্রি।

ফজলুল হক তুহিন প্রকাশ করেছেন দ্বিমাসিক লিটল ম্যাগাজিন সিঁড়ি; ইংরেজি পত্রিকা বাংলা লিটারেচারের ছিলেন সহকারী সম্পাদক এবং তিনি নতুন এক মাত্রার নির্বাহী সম্পাদক। তাঁর সৃজন প্রতিভার চিহ্ন ফেরা না ফেরা; তুমি প্রকৃতির প্রতিদ্বন্দ্বী; সরাও তোমার বিজ্ঞাপন; বিহঙ্গ পিঞ্জর; বাজাও আপন সুর; সুন্দরের সপ্তপদী; এবং দীর্ঘ দুপুরের দাগ। উজানে উৎস তাঁর অনন্য কাব্যগ্রন্থ।

ফজলুল হক তুহিন তাঁর কাব্যপ্রতিভা নিয়ে তারুণ্যকে জয় করতে চেয়েছেন; জয় করতে চেয়েছেন ব্রিটিশ হিজোমুনিকে। তাঁর গবেষণাও অগ্রসর হচ্ছে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে কী উপায়ে বাঙালিকে পরিত্রাণ দেওয়া যায় সে লক্ষকে সামনে রেখে।

শূন্য দশকের পরে কবি ফজলুল হক তুহিন কবিতার ফ্রেমে বেঁধেছেন নতুন আঙ্গিকের বাঙালি সংস্কৃতি ও ইসলামী ঐতিহ্যের সমন্বিত রূপ। তাঁর কবিতায় নিসর্গের সমারোহ প্রাধান্য পেলেও তিনি একই সাথে শেকড় সন্ধানী বাগাড়াম্বরে দ্বিত্ব।

ঐতিহ্যের মূল্যবোধ ও মানবতার মুক্তি প্রত্যাশী এই কবি ‘বেহুলা ও সখিনা’ শিরোনামের কবিতায় তুলে এনেছেন পুরাণ ও ইতিহাসের গল্প। তিনি লিখলেন- কাসেমের হাতে তলোয়ার জ্বলে-এজিদ সৈন্য মরে সে আঘাতে/অতঃপর বীর ফিরে আসে শত তীর বুকে নিয়ে সখিনা হৃদয়ে। ইমাম হোসেনের সাথে এজিদের যুদ্ধ। কারবালার প্রান্তর। ফোরাত তট। সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ্ব। ইসলামের ইতিহাসে এ এক হৃদয় বিদারক ঘটনা। এই ঘটনাকে কবি খুব সন্তর্পণে তুলে ধরেছেন এবং সেই সাথে সখিনা ও কাসেমের প্রেম উপাখ্যানকেও এই কবিতায় তিনি সন্নিবেশিত করেছেন মুন্সিয়ানার সাথে।

এই কবিতায় বেহুলার উপাখ্যানও কবি স্মরণ করেছেন গভীর মমতায়। তিনি লিখলেন- অতঃপর এলো সেই কাল রাত! নাগিনীর বিষে আসমানে/ জমে বিষমেঘ। জমিনে ঘাসেরা সবুজ হারায়। হাওয়ায়/ হাওয়ায় রটে অলুক্ষণে কী এক পক্ষীর কাঁপা সুর।/ নিখুঁত বাসরে আহা, বেহুলার হৃদয়পুর কী সুমধুর’ (নির্বাচিত কবিতা)।

ইতিহাসের জ্ঞানে সমৃদ্ধ মানুষ ঝলমলে মানুষ। জ্ঞানের শক্ত খোলসও ইতিহাস। যে কবির ইতিহাসের চোখ স্বচ্ছ সেই কবির কবিতায় মাত্র একটি শব্দও ইতিহাসের পুরো অধ্যায়কে তুলে ধরতে পারে। ফজলুল হক তুহিন ইতিহাসকে উন্মুক্ত করতে চান, ¯পষ্ট করতে চান মিথ্যার আবরণকে উৎখাতের মাধ্যমে। সে জন্য তিনি লিখলেন ‘সরাও তোমার বিজ্ঞাপন’।

তিনি বললেন- ‘মনের ভূগোলে ইতিহাসে ক্যানভাসে/ আমার স্বপ্নের সেই মানবীকে অস্বচ্ছ, ঝাপসা করে দিচ্ছে সজ্জিত মডেল-বর্ণিল আলোর ঝলকানিতে/ আমার স্মৃতিতে যতগুলো নদী নারী নিসর্গের জলছবি আছে- সবগুলো এই আলোর ঝিলিকে/ দিকে দিকে দৌড়াচ্ছে, পালাচ্ছে। বিচলিত, বিলোড়িত/ঝলসিত সব শান্তিছবি-ছায়াছবি! কোথা রাখি/ এই চোখ এই মন?/সরাও তোমার বিজ্ঞাপন!/ সকাল সন্ধ্যায় আমি এইপথ দিয়ে হেঁটে যাবো আমার পদ্মায়/ চোখের তারায় চাঁদ দেখে সপ্তর্ষির ইশারায়/ লাইলির চেনাপথ ধরে জুলেখার আঁচল উড়িয়ে হেলেনের ট্রয় ঘুরে আসবে আমার মনপবনের নাও/পথের দুপাশ খুলে দাও!’ (নির্বাচিত কবিতা)।

আত্মপ্রত্যয়ী কবি ফজলুল হক তুহিন স্বপ্ন বোনেন ঐতিহ্যের। তিনি সানন্দে পরিচর্যা করেন ঐতিহ্যের বীজতলা। যে বীজতলা থেকে অঙ্কুর উদ্গমিত হতো স্বদেশ প্রেমের সবুজ নরম চারা। কবি স্মরণ করতে চান ব্রিটিশ কর্তৃক ভুলে দেওয়া সেই অতীত ঐতিহ্যকে।

আবহামান বাংলা ও পরিবর্তীতে বিশ্বের বদলে যাওয়া পরিবেশ ও বদলে যাওয়া চিন্তা নিয়ে কবি সাজিয়েছেন তাঁর কাব্যসম্ভার। উত্তর বাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীর মাঝে সমকালীন জীবনবোধের স্পন্দন ধারণ করায় তাঁর কবিতা অর্জন করে নিজস্ব কণ্ঠস্বর। শিল্পসজাগ কবি ফজলুল হক তুহিন পথ দেখাতে পারে হাজারও কবিতাপ্রেমীকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *