৬৯% বাংলাদেশি এ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাচ্ছে না

প্রবন্ধ-কলাম
শেয়ার করুন

মাসুম খলিলী

ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইন্সটিটিউট-আইআরআই এর বাংলাদেশ নিয়ে সাম্প্রতিক এক জরিপের ৯২ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন যে, তারা পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন বলে আশা করছেন। আর এই জরিপ অনুসারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমর্থন এখন নিম্নগামি অন্যদিকে বিরোধীদের জনসমর্থন বাড়ছে।

জরিপে বলা হয়, ৬৯ শতাংশ মানুষ বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন চাচ্ছে না। এর মধ্যে মুক্ত ও অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করতে সর্বোত্তম পথ হলো তত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরিয়ে নিয়ে আসা- এমনটি মনে করেন ৪৪ শতাংশ আর সর্বদলীয় অন্তর্বর্তী সরকার গঠন সমর্থন করে ২৫ শতাংশ। মাত্র ২৫ শতাংশ মনে করেন যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের অধীনে নির্বাচন হতে দেয়া উচিৎ।

গত ৮ আগস্ট, ২০২৩ আইআরআইয়ের এই জরিপটি প্রকাশ করা হয়।ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) সেন্টার ফর ইনসাইটস ইন সার্ভে রিসার্চ (সিআইএসআর) বাংলাদেশব্যাপী এই নতুন জরিপটি চালিয়েছে। এতে দেশের দিকনির্দেশনা সম্পর্কে জনগণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ ফুটে ওঠে।

বাংলাদেশে আইআরআই এর জরিপ কাজ শুরু হয় ডোনাল্ট ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকাকালে। অতীতে এর অধিকাংশ জরিপে শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি সমর্থন দেখানো হয়ে আসছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগের জরিপেও শেখ হাসিনার প্রতি বাংলাদেশের ব্যাপক মানুষের সমর্থন দেখানো হয়।

এবারের জরিপে একই ধরনের কিছু চিত্র দেখা গেলেও এতে তাৎপর্যপূর্ণ কিছু বিষয় ফুটে ওঠে। যেমন ২০১৪ সালের পর প্রথমবারের মতো, আইআরআই-এর জরিপে দেখা যায় যে, বেশিরভাগ বাংলাদেশি বিশ্বাস করেন যে দেশটি ভুল পথে চলেছে।

মাত্র ৪৪% বলেছেন যে বাংলাদেশ সঠিক পথে চলছে, যা সেপ্টেম্বর ২০১৯-এ ৭৬% থেকে অনেক নিচে নেমে এসেছে। হতাশাবাদের এই বৃদ্ধির মূল কারণ বলা হয়েছে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি। ফোকাস গ্রুপের একজন অংশগ্রহণকারী বলেন, “আমার স্বামীর বেতন বাড়েনি, কিন্তু নিত্যপণ্যের দাম প্রতিদিন বাড়ছে।”

জরিপ অনুসারে, বেশির ভাগ বাংলাদেশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের পারফরম্যান্সকে বিভিন্ন বিষয়ে অনুমোদন দিলেও বিরোধীদের শক্তি বাড়ছে বলে মনে হয়েছে। ৩০ শতাংশ বাংলাদেশি হাসিনার পারফরম্যান্সকে জোরালো সমর্থন করেন, মোটামুটি করেন ৪০ ভাগ। কিন্তু বিরোধীদের অনুমোদন ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ৩৬% থেকে বেড়ে এই জরিপে ৬৩% হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

জরিপ অনুসারে, নির্বাচনী স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা পরিস্থিতি উন্নত হলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশিরা ভোট দিতে আগ্রহী। উত্তরদাতাদের ৯২ শতাংশ বলেছেন যে, তাদের পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবার সম্ভাবনা রয়েছে (৫৭% উত্তর “খুবই সম্ভবত”)। যারা ভোট দিতে পারবেন বলে আশা করেন না তারা নির্বাচনী জালিয়াতি এবং ভোটার নিবন্ধন সংক্রান্ত সমস্যাকে ভোটদানের পথে প্রধান বাধা হিসেবে উল্লেখ করেন।

আইআরআইয়ের এই জরিপ অনুসারে, ২০১৮ সালের মে মাসে যেখানে ২২ শতাংশ মানুষ বাংলাদেশ ভুল দিকনির্দেশনায় যাচ্ছে বলে মনে করতেন সেখানে এপ্রিল ২০২৩ সালে এটি মনে করেন ৫৩ শতাংশ। এই পরিবর্তনের কারণ হিসাবে ৬১ ভাগ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, ১৩ ভাগ দুর্নীতি, ১২ ভাগ গণতন্ত্রহীনতা এবং ৫ ভাগ নিরাপত্তাহীনতাকে দায়ী করেছেন।

২০১৮ সালের মে মাসে ৩১ ভাগ মানুষ মনে করতেন রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ বা খুবই খারাপ। এখন সেটি মনে করেন ৪৯ শতাংশ উত্তরদাতা। আগামীতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে এমনটি ২০১৮ সালে মনে করতেন ২৬ শতাংশ আর এখন মনে করেন ৬৯ শতাংশ। এই দুই সময়ের ব্যবধানে দেশের নিরাপত্তাহীনতায় উদ্বিগ্ন মানুষের সংখ্যা ২১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এ সময়ে অর্থনীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন মানুষের সংখ্যা ২৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

দুর্নীতি ও অর্থপাচারের ঘটনা বাংলাদেশে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে । বাইডেন প্রশাসনের দুর্নীতি ও অর্থপাচার বিষয়ক সমন্বয়কারী বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। এই প্রসঙ্গে আইআরআইয়ের জরিপে বলা হয়েছে সর্বাধিক ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশি মনে করেন দুর্নীতি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা। এরপরে ২১ শতাংশ মূল্যষ্ফীতি আর ৭ শতাংশ রাজনৈতিক অস্থিরতাকে প্রধান সমস্যা মনে করেন। ১৮% বংলাদেশি ৫ বছর আগে বাংলাদেশের গনতন্ত্র পরিস্থিতিকে খারাপ বা খুবই খারাপ মনে করতেন এখন সেটি মনে করেন ৪৫ শতাংশ মানুষ। এখন সমসংখ্যক মানুষ রাজনৈতিক মত প্রকাশে তারা ভীত সন্ত্রস্ত বোধ করার কথা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশের আর্থসাামাজিক পরিস্থিতির একটি ভয়ানক চিত্র আইআরআইয়ের এই জরিপে ওঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে ৮৭ শতাংশ মানুষ মনে করেন বাংলাদেশে ধনী গরিবের বৈষম্য বাড়ছে। আর ৮৮ শতাংশ মানুষ মনে করেন রাজনৈতিক অভিজাত ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান বিদ্যমান রয়েছে।

এতে আরো বলা হয়েছে ৬২ শতাংশ বাংলাদেশি মনে করেন স্থানীয় জাতীয় বা আন্তর্জাতিক সুশিল সদস্যরা সাধারণ মানুষের পরিবর্তে বিশেষ একটি স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে।

আইআরআই আগের সব জরিপেই অবিশ্বাস্যভাবে শেখ হাসিনাকে গ্লোরিফাই করতে দেখা যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম ছিল না। জরিপ অনুসারে শেখ হাসিনার অনুমোদন ছিল ২০১৭ সালে ৮৩ শতাংশ এবং ২০১৮ সালে ৬৪ শতাংশ। ২০২৩ সালে তা ৭০ শতাংশে নেমেছে। একই সময়ে বিরোধি পক্ষের কাজের অনুমোদন ২০১৭ সালের ১১% থেকে বেড়ে ২০১৮তে ১৮% আর এখন ৩০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় এই জরিপে দেখা যাচ্ছে। সেটি হলো সেনাবাহিনীর এখনকার ভুমিকাকে সমর্থন করছে ৮৬ ভাগ বাংলাদেশি আর পুলিশের ভুমিকাকে সমর্থন করছে ৪৮ শতাংশ মানুষ। অন্যদিকে সংসদের ভুমিকাকে ৪২ শতাংশ মানুষ এখন সমর্থন করে আর বিরোধি দলগুলোর ভুমিকাকে সমর্থন করছে ৬৩ শতাংশ বাংলাদেশি, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে বিরোধি পক্ষের প্রতি এই সমর্থন ছিল ৩৬ শতাংশ।

জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশের ৯২ ভাগ মানুষ মনে করেন এমন একটি নির্বাচন ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে যেখানে তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। ৩৫ শতাংশ সেটি জোরালোভাবে মনে করেন। যদি ভোট নাই দিতে পারেন তবে সেটি কি কারণে হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে ৫৫ ভাগ জানিয়েছে ভোট জালিযাতির কারণে সেটি হতে পারে।

জরিপে বলা হয়, ৬৯ শতাংশ মানুষ বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন চাচ্ছে না। এর মধ্যে মুক্ত ও অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করতে সর্বোত্তম পথ হলো তত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরিয়ে নিয়ে আসা এমনটি মনে করেন ৪৪ শতাংশ আর সর্বদলীয় অন্তর্বর্তী সরকার গঠন সমর্থন করেন ২৫ শতাংশ এবং ২৫ শতাংশ মনে করেন যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের অধীনে নির্বাচন হতে দেয়া উচিৎ।

আইআরআইয়ের জরিপে বলা হয়, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ২০ ভাগ বাংলাদেশী ভারতের ভুমিকাকে নেতিবাচক মনে করতো। এখন সেটি দাঁড়িয়েছে ৪৬ শতাংশে। এই হারটি চীনের ক্ষেত্রে ১৮ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ শতাংশে। আর যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এটি ১৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

এই জরিপটি সম্পর্কে ঢাকাস্থ আমেরিকান দূতাবাসের সাবেক উপ প্রধান জন ড্যানিলোভিজ এক টুইটে বলেছেন,এই সমীক্ষায় চিন্তার জন্য প্রচুর উপাদান রয়েছে। যদিও পক্ষপাতীরা পূর্বের দৃষ্টিভঙ্গিগুলিকে শক্তিশালী করার জন্য ডেটা বেছে নেবে, যারা এর বাইরে যায় তারা বাংলাদেশের জনসাধারণের মেজাজ সম্পর্কে আরও ভাল ধারণা পাবার মাধ্যমে এখান থেকে উপকৃত হতে পারেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *